শুক্রবার, ২৭ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা

মরে যাচ্ছে ছোট ছোট নদী ফসলও হচ্ছে না জমিতে

পঞ্চগড়

মাহমুদ আজহার ও সরকার হায়দার, পঞ্চগড় থেকে

মরে যাচ্ছে ছোট ছোট নদী ফসলও হচ্ছে না জমিতে

পরিবেশ ও জীববৈচিত্র্যকে হুমকির মুখে ফেলে পঞ্চগড়ে বোমা মেশিনে পাথর উত্তোলন চলছেই। স্থানীয় পুলিশ প্রশাসনের একটি অংশের ছত্রচ্ছায়ায় অসাধু চক্র রাতের আঁধারে এই অবৈধ কর্মকাণ্ড চালিয়ে যাচ্ছে। প্রতিদিনই পঞ্চগড় ও তেঁতুলিয়ার বিভিন্ন স্থানে ফসলি জমি ও নদীতে পাইপ বসিয়ে বিশাল গর্ত করে এই পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। এতে ছোট ছোট কয়েকটি নদী এখন মৃতপ্রায়। ফসলি জমিতেও চাষাবাদ হচ্ছে না। সরকার বঞ্চিত হচ্ছে লাখ লাখ টাকার জাতীয় রাজস্ব থেকে।

স্থানীয় পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, বাংলাদেশে সবচেয়ে বেশি ভূমিকম্পপ্রবণ এলাকা পঞ্চগড়। এভাবে বোমা মেশিনে পাথর তোলার কারণে হাজার হাজার একর ফসলি জমি নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। ভূগর্ভে পানির স্তর নিচে নেমে যাচ্ছে। অবিলম্বে এ প্রক্রিয়ায় পাথর উত্তোলন বন্ধের দাবি জানিয়েছেন এলাকার সর্বস্তরের মানুষ। এ প্রসঙ্গে জেলা প্রশাসক অমলকৃষ্ণ মণ্ডল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘বোমা মেশিন বন্ধের ব্যাপারে আমরা কঠোর অবস্থানে। আমরা সাধ্যমতো চেষ্টা করছি। কিন্তু সবাই এগিয়ে না এলে বন্ধ করা সম্ভব নয়। এই ব্যবসায়ীদের প্রতি সামাজিকভাবে সবার প্রকাশ্যে ঘৃণা প্রকাশ করা উচিত।’ পঞ্চগড় পরিবেশ পরিষদের সভাপতি তৌহিদুল বারী বলেন, ‘বোমা মেশিন দিয়ে পাথর তোলায় গভীরে বিশাল শূন্যতার সৃষ্টি হচ্ছে। এতে মাঝারি মাত্রার ভূমিকম্প হলেই ভয়াবহ ক্ষতির সম্মুখীন হওয়ার আশঙ্কা রয়েছে। সম্প্রতি পঞ্চগড়ে কয়েকবার বিভিন্ন মাত্রায় ভূমিকম্প অনুভূত হয়েছে।’ তবে পুলিশের জড়িত থাকার বিষয়টি অস্বীকার করেছেন তেঁতুলিয়া মডেল থানার অফিসার ইনচার্জ সরেস চন্দ্র। তিনি বলেন, ‘পুলিশের জড়িত থাকার প্রশ্নই ওঠে না। এ ছাড়া যেসব প্রত্যন্ত এলাকায় এসব কাজ করা হয়, সেখানে আমরা যাওয়ার আগেই হোতারা পালিয়ে যায়। তবে আমরা এ ব্যাপারে খুবই কঠোর অবস্থানে। অভিযান অব্যাহত রয়েছে।’ সরেজমিনে ঘুরে দেখা গেছে, জেলার চিলকা, ভেরসা, চাওয়াই, করতোয়া, ডাহুক, বেরং, গবরা, বড় বিল্লাহসহ বেশ কয়েকটি নদীর গতিপ্রবাহকে আটকে দিয়ে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনের মহোৎসব চলছে। নদীর বুকে বালি ফেলার পাশাপাশি অসাধু চক্রটি নদী দখল করে বিভিন্ন পয়েন্ট থেকে পাথর উত্তোলন করছে। এতে নদীগুলো মৃতপ্রায়। রাত নামার সঙ্গে সঙ্গেই চক্রটি ছড়িয়ে পড়ে নদীগুলোতে। একইভাবে বুড়াবুড়ি ইউনিয়ন, ভজনপুর ও দেবনগর ইউনিয়নেও ফসলি জমি খুঁড়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। আগে শুধু গুটিকয় স্থানে বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন চললেও এখন তা ছড়িয়ে পড়ছে অন্যান্য উপজেলাতেও। কিছু পাথর দুষ্টু পাথর-ব্যবসায়ী এ কাজে সম্পৃক্ত। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালালেও গোপনে ওই চক্রের সঙ্গে ভাগ-বাটোয়ারায় লিপ্ত হয় পুলিশের ক্ষুদ্র একটি অংশ। জানা যায়, সবচেয়ে বেশি পাথর উত্তোলন করা হয় তেঁতুলিয়া উপজেলায়। তেঁতুলিয়ার গবরা নদী, দেবনগর ইউনিয়নের শিবচণ্ডী জয়গোনজোত, কালিয়ামণি গ্রামের করতোয়া নদী ও আশপাশ এলাকায় গভীর রাত পর্যন্ত পাথর উত্তোলন করা হয়। ঝালেঙ্গিগছ ও ধানশুকা গ্রামের করতোয়া নদী-সংলগ্ন এলাকা, পাথরঘাটা, আঠারখারী, সুরিগছ, শেকগছ, ময়নাগুঁড়ি গ্রামের বিভিন্ন সমতলভূমি গর্ত করে তোলা হচ্ছে পাথর। ভজনপুর ইউনিয়নের বোগলাহাগী, চোয়ামতি, ফকিরহাট, ভাঙ্গিপাড়া, বাসবারী, ভদ্রেশ্বর, কুকুরমুহা, গনাগছ গ্রামের করতোয়া নদী-সংলগ্ন খাসজমি ও পার্শ্ববর্তী সমতল এলাকায়ও একই কায়দায় পাথর তোলা হচ্ছে। একই ইউনিয়নের খনিয়াগছ ঘগারখাল, কাউরগছ, ডাঙ্গি গ্রামের বিভিন্ন সমতলভূমি, বুড়াবুড়ি ইউনিয়নের হারাদীঘি, বালাবাড়ী, শিলাইগুঁড়ি, কালদাসপাড়া বালাবাড়ী, কাটাপাড়া গ্রামের ডাহুক নদী-সংলগ্ন এলাকায়, শালবাহান হাট ইউনিয়নের মাঝিপাড়া গুচ্ছগ্রাম থেকে চার কিলোমিটার উত্তরে লোহাকাচি গ্রাম পর্যন্ত ডাহুক নদীর বিস্তীর্ণ এলাকায় রাত-দিন বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলন করা হচ্ছে। সদর উপজেলার সাতমেড়া ইউনিয়নের মাঝিপাড়া এলাকায় চাওয়াই এবং চিলকা নদী ও আশপাশ এলাকায় চলছে বোমা মেশিন। এ ছাড়া জগদল, কাঁকনপাড়া, শালমারা ও ময়নাগুঁড়িতে ড্রেজার মেশিন দিয়ে গোপনে রাতে পাথর উত্তোলন করা হয়। জানা যায়, ২০১৫ সালে পরপর কয়েকবার ভূমিকম্প হয়, যার উৎপত্তিস্থল ছিল পঞ্চগড় থেকে ১০০ কিলোমিটারের মধ্যে নেপাল ও ভারতে। পরিবেশবিদদের আশঙ্কা, নেপালের মতো ৭.৯ মাত্রার ভূমিকম্প হলেই তেঁতুলিয়ার বিস্তীর্ণ এলাকায় ভূমিধসের সৃষ্টি হবে।

জানমালের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির আশঙ্কাও করছেন তারা। স্থানীয় বাসিন্দারা জানান, প্রতি রাতে বিভিন্ন স্থানে শতাধিক বোমা মেশিন বসানো হয়। একেকটি মেশিনে প্রতি রাতে ৮০ থেকে ৯০ হাজার টাকার পাথর উত্তোলন করা হয়। এর মধ্যে পুলিশ প্রশাসনসহ প্রভাবশালী রাজনৈতিক নেতাদের মেশিনপ্রতি দেওয়া হয় সাত হাজার টাকা। মাসে কোটি কোটি টাকা ভাগ-ভাটোয়ারা হয় তাদের মধ্যে। এ কারণে ভূমি নষ্ট করে পাথর উত্তোলন দেখেও না দেখার ভান করে পুলিশ প্রশাসন। মাঝেমধ্যে ভ্রাম্যমাণ আদালত অভিযান চালায়। এরই মধ্যে দুই শতাধিক মেশিন পুড়িয়ে দেওয়া হয়েছে। কিন্তু পুলিশের একটি ক্ষুদ্র অংশের যোগসাজশে ওই চক্রটি আবারও জড়িয়ে পড়েছে পাথর উত্তোলনে। জানা যায়, বোমা মেশিন ঘিরে গড়ে উঠেছে একশ্রেণির দালাল চক্র। তারা বিভিন্ন মেশিন থেকে চাঁদা তুলে লোকজনকে ম্যানেজ করছে। আর প্রশাসনের লোকজনকে ম্যানেজ করার নাম দেওয়া হয়েছে লাইন দেওয়া। লাইন দেওয়ার নাম করে চলছে চাঁদাবাজি। চক্রটি নিয়ন্ত্রণ করছে কল বাহিনী নামক আরেকটি চক্রকে। এই কল বাহিনী বিভিন্ন রাস্তার মোড়ে দাঁড়িয়ে থাকে। প্রশাসনের অভিযানের আলামত দেখলেই তারা মেশিন-মালিকদের খবর দেয়। খবর পেয়েই মালিকরা মেশিন লুকিয়ে ফেলে। কল বাহিনীর সদস্যদের জনপ্রতি প্রতিদিন ১ হাজার টাকা করে দেওয়া হয়। অনেক সময় পুলিশ নিজেরাই তাদের অভিযানের আগাম বার্তা জানিয়ে দেয় কল বাহিনীকে। সম্প্রতি বোমা মেশিন দিয়ে পাথর উত্তোলনকারী ব্যবসায়ীদের নামের একটি তালিকা দেওয়া হয়েছে প্রশাসন ও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার কাছে। তালিকা ধরেই আইনগত ব্যবস্থা নেওয়া হবে বলে সচেতন মহল আশা করছেন। তেঁতুলিয়া উপজেলা নির্বাহী অফিসার সানিউল ফেরদৌস বলেন, ‘আমরা প্রতিনিয়ত অভিযান চালাচ্ছি। বোমা মেশিন ভেঙে ফেলা হচ্ছে। কিন্তু তিনটা ভাঙলে যুক্ত হচ্ছে পাঁচটা।’

সর্বশেষ খবর