সোমবার, ৩০ জানুয়ারি, ২০১৭ ০০:০০ টা
লেখকের অন্য চোখ

এ ছবিটা এখন বদলে গেছে

সমরেশ মজুমদার

এ ছবিটা এখন বদলে গেছে

ছেলেবেলায় দেখতাম বয়স্ক মানুষ রঙিন জামা পরতেন না। সেই বয়সে বয়স্ক মনে হতো তাদেরই, যাদের চুলে সাদা ছোপ লাগত। আমার বাবার বিয়ে হয়েছিল তার একুশ বছর বয়সে। চব্বিশে আমি পৃথিবীতে এসেছিলাম। আমার কুড়ি বছর বয়সে বাবাকেও বয়স্ক মানুষ মনে হতো। তখন তার চুয়াল্লিশ বছর বয়স। আমার ঠাকুরদা তখন সত্তর। বাবার চুলে সাদার ছোপ আর ঠাকুরদার চুল কাশফুল। তিনিও বয়স্ক। ঠাকুরদা তো বটেই, বাবাও সাদা ছাড়া অন্য রং ব্যবহার করতেন না। সে সময় ছেলেমেয়েরা একটু বড় হয়ে গেলে স্বামী-স্ত্রী আর একসঙ্গে শোয়ার কথা ভাবতেন না। মেয়েরা মায়ের সঙ্গে আলাদা ঘরে চলে যেত। যে দম্পতির মেয়ে নেই তাদের ছেলেরাও বারো তেরো বছর না হওয়া পর্যন্ত মায়ের সঙ্গে থাকত। তখন তো প্রায় সব পরিবারই ছিল একান্নবর্তী। দাদু জ্যাঠা কাকা ঠাকুমা পিসিমা এবং কাকিমা জেঠিমারা সবাই একসঙ্গে। মেয়েদের একটা আলাদা জগৎ তৈরি হয়ে যেত। ঠাকুরদা যতদিন বেঁচে থাকতেন ততদিন তার কথাই শেষ কথা ছিল। তার অবর্তমানে জ্যাঠা দায়িত্ব নিতেন। এই কাঠামোতে কোনো দম্পতির ছেলেমেয়ে বড় হয়ে গেলে তাদের যুগল-জীবনের অর্ধেকটা শেষ হয়ে যেত। পরিস্থিতি এমন হয়ে যেত, অনেক সময় ব্যক্তিগত সমস্যা নিয়ে স্বামী-স্ত্রী আলোচনা করার জন্য নিভৃত পরিবেশ পেতেন না। স্পষ্টই বোঝা যাচ্ছে, পঞ্চাশে পৌঁছার অনেক আগেই পুরুষদের এবং চল্লিশের আগেই মেয়েদের যৌনজীবন শেষ হয়ে যেত। ব্যতিক্রম নিশ্চয়ই ছিল। মা এবং মেয়ে একই সঙ্গে সন্তান প্রসব করেছেন এরকম ঘটনাও তো ঘটেছে। কিন্তু সেসব ঘটনার সংখ্যা এত কম যে তা মূল ছবিটাকে পাল্টে দিচ্ছে না। এর ফলে কিছু ঘটনা ঘটত। বেশির ভাগ বয়স্ক পুরুষ দীক্ষা নিয়ে নিজের জগৎ তৈরি করতে চাইতেন। গুরুর নির্দেশিত পথে জীবনযাপন করে শান্ত থাকতে চেষ্টা করতেন। ষাট সাল পর্যন্ত বাঙালি পরিবারগুলোতে গুরুদের ভূমিকা সেই কারণে প্রবল ছিল। দেখেছি সেই গুরুর কাছে পরিবারের শিশুটিকে দীক্ষিত করার প্রবণতা ছিল। চল্লিশোর্ধ্ব মহিলারাও দীক্ষিত হয়ে ঠাকুরঘর নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়তেন। এর বাইরে আরও কিছু প্রবণতা দেখা দিয়েছিল। সাধারণত পুরুষরা চাকরির কারণে ষাট বছর বা আটান্ন বছর বয়স পর্যন্ত রোজ বাড়ির বাইরে যেতেন। সে সময় তারা ঠাকুরদা হয়ে গিয়েছেন। এই বাইরের জীবনের কিছু চোরা আনন্দ পাওয়ার প্রবণতা কারও কারও মধ্যে দেখা দিত, যা বাড়ির লোকজন টের পেত না। দ্বিতীয়ত, অল্প বয়সে লক্ষ্য করতাম, রকের সান্ধ্যআড্ডায় পঞ্চাশোর্ধ্ব ব্যক্তিরা যখন কথা বলতেন তখন তাদের কেউ অশ্লীল কথা অনায়াসে উচ্চারণ করতেন, যা তার সঙ্গীদের আনন্দিত করত। কিন্তু বাড়িতে ঢুকেই তারা মুখে কুলুপ দিতেন, ভুলেও সেসব বাক্য উচ্চারণ করতেন না। অর্থাৎ তাদের অবদমিত বাসনা পূর্ণ না হওয়াতে ওই অশ্লীল শব্দগুলো উচ্চারণে নিশ্চয়ই তৃপ্তি পেতেন। একান্নবর্তী পরিবারের যুগ শেষ হওয়ার পর সমস্যার চেহারাটা বদলাল। দেখা যাচ্ছে পরিবারের কোনো গুরুজন একই বাড়িতে থাকেন না, থাকেন না ননদ বা কোনো জা। আছে ছোট ছেলে অথবা মেয়ে অথবা একটি ছেলে একটি মেয়ে অথবা দুটিই ছেলে কিংবা মেয়ে। তাই তাদের দাম্পত্য জীবন চল্লিশ থেকে পঞ্চাশেই শেষ হওয়ার কোনো কারণ থাকতে পারে না। অথচ হচ্ছে। একটি সমীক্ষা চলছে বিয়ের পাঁচ থেকে সাত বছরের মধ্যা বেশির ভাগ স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে নানান ব্যাপারে মতভেদ শুরু হয়ে যায়। শিক্ষিত মানুষদের অধিকাংশই মারপিট করেন না, গালাগালি উঁচু গলায় দেন না। কিন্তু তাদের মধ্যে বাক্যালাপ দ্রুত কমে যায়। শোয়ার ঘর আলাদা হয়ে যায়। ছেলেমেয়েদের কথা ভেবে তারা একত্রিত থাকেন। কিন্তু যাদের মধ্যে বাক্যালাপ নেই তাদের যৌনজীবন থাকতে পারে না। এই পরিস্থিতির আগেও যে ঘটনা ঘটছে তাও সমীক্ষায় ধরা পড়েছে। বাবা-মায়ের পছন্দ অনুযায়ী বিয়ের আয়ুও বেশির ভাগ ক্ষেত্রে বেশি দিন হচ্ছে না। নিজেরা প্রেমে পড়ে বিয়ে করার পর কয়েক মাসের মধ্যে কোর্টে দৌড়াতে হচ্ছে। যদি মিউচুয়াল ডিভোর্স হয় তা হলে বছর দুয়েক, কনটেস্ট করলেই সর্বনাশ। তার ওপরে, ডিভোর্স হয়ে যাওয়ার পরে আর এক সমস্যা। অবিবাহিত সক্ষম ছেলেমেয়ের সংখ্যা এখন এত বেড়ে গেছে যে ডিভোর্সি ছেলেমেয়েকে আবার সংসারী হতে হলে ডিভোর্সির সন্ধান করতে হয়। এই করতে করতে বয়স বাড়ে। এক সময় মনে হয়, দূর, বিয়ে করে কী হবে। মানুষের গড় আয়ু এখন বেড়ে গেছে। ফলে জীবনযাপনের পদ্ধতিও বাবা-ঠাকুরদার থেকে আলাদা হবেই। আমি কোনো খোঁজখবর না নিয়েই জোর গলায় বলতে পারি, গত পঁচিশ বা তিরিশ বছর আগে যত লাঠি বিক্রি হতো, এখন তার শতকরা পাঁচ ভাগও বিক্রি হয় না। ষাট পার হলেই বাঙালি লাঠিনির্ভর হয়ে হাঁটাচলা করতেন। আর সেসব লাঠির কী বাহার ছিল। বিএ পরীক্ষার পর বন্ধুদের সঙ্গে যখন হরিদ্বার মুসৌরিতে বেড়াতে যাচ্ছি তখন ঠাকুরদা বলেছিলেন, ‘ওখানে ভালো লাঠি পাওয়া যায়। একটা এনো তো।’ তিনি তখন আশির কাছাকাছি। বাবা চল্লিশ পেরিয়েছেন। হরিদ্বারে যে লাঠি পাওয়া যায় তা কলকাতায় পাওয়া যায় না। ফিরে আসার দিন লাঠির দোকানে গিয়ে চোখ কপালে উঠল। মসৃণ লাঠি, গড়গড়ে লাঠি, তেলচুকচুকে লাঠি, নিচে লোহার নল লাগানো লাঠি, ধরার জায়গাটা কারও গোল, কারও বাঁকানো, কোনোটায় বাঘের মাথা বসানো। কোনটা ছেড়ে কোনটা কিনি! আবার রঙেরও পার্থক্য আছে। ঠাকুরদা ছিলেন খুব সরল জীবনযাপন করা মানুষ। তাই তার জন্য যে লাঠি কিনলাম তার দাম বেশি দিতে হলো না। সঙ্গে যে বন্ধু ছিল সে জিজ্ঞাসা করেছিল, ‘তোর বাবার বয়স কত?’ জবাব শুনে বলেছিল, ‘কয়েক বছরের মধ্যে তো পঞ্চাশে পৌঁছে যাবেন। ওঁর জন্য একটা লাঠি অ্যাডভান্স কিনে নে।’ বেশ কায়দা করা লাঠি কিনেছিলাম বাবার জন্য। বাড়িতে ফিরে বলিনি কার জন্য কোন লাঠি এনেছি। দুটো লাঠি দেখে ঠাকুরদা হেসে বলেছিলেন, ‘আহা, আমার জন্য দুটো কিনতে গেলে কেন? তা এনেছ যখন, এইটে বাজারে যাওয়ার সময় ব্যবহার করব, আর এইটে বিশেষ অকেশনে। সেই অকেশনটা প্রায় কখনো আসত না, বাবা পঞ্চাশ পার হতেই তার জন্য আনা লাঠিটা ব্যবহার করতে লাগলেন। পঞ্চাশে পৌঁছেও কোনো মহিলা যদি সুন্দরী থাকতেন অথবা তার স্বাস্থ্য যদি না ভাঙত, তা হলে তিনি আলোচনার বস্তু হয়ে যেতেন। বেশির ভাগ চেহারায় যখন মা-মা ভাব, বার্ধক্য উঁকি মারছে, তখন একজন ওই বয়সেও কেন যুবতী থাকবেন? তিনি যদি বিধবা হন তাহলে তো পঞ্চাশে পৌঁছতেই রোগগ্রস্ত হতে হবে। অন্তত পেটে আলসার না হলে লোকে অবাক হতো। দুপুর পার হলে একবেলা আলোচালের ভাত খেয়ে ঢেঁকুর তোলাটাই তো স্বাভাবিক ছিল। সময়টা যে প্রায় চলে গেছে তা জলের মতো পরিষ্কার। আমি হাজার চেষ্টা করেও বাবা মারা যাওয়ার পরে মাকে মাছ দূরের কথা, ডিম খাওয়াতে পারিনি। রঙিন শাড়ি পরেননি চল্লিশের পরে। এখন পঁয়ষট্টি-ছেষট্টির মহিলারা একুশ-বাইশের জীবনযাপন করেন। একজন পুরুষ বিপত্নীক হলেও যখন কোনো কিছু ত্যাগ করেন না, তখন একজন মহিলা কেন করবেন? এ প্রশ্নটাও এতদিনে পুরনো হয়ে গেছে। এখন পঁয়ষট্টিতেও মহিলারা ফিগার সচেতন। চল্লিশে পা দিয়েই তারা নিয়মিত ক্যালসিয়াম এবং ভিটামিন ট্যাবলেট খেতে আরম্ভ করেন, যা তাদের ভিতর শরীরকে তাজা রাখতে সাহায্য করে। পঁয়ষট্টিতেও তাদের হৃদয়ে প্রেম আসে। কেউ প্রকাশ করেন, কেউ সংকোচবোধ করেন। পুরুষদের ক্ষেত্রেও একই ব্যাপার। প্রকৃতিকে জয় করার জন্য অনেকেই চেষ্টা করেন। সারা দিন ব্যবসা সামলে সন্ধেবেলায় ক্লাবে চলে আসেন সত্তর থেকে পঁচাশির যুবকরা। গালগল্প, অল্পস্বল্প পান করে ১০টায় বাড়ি ফিরে গিয়ে বাড়ির লোকজনের সঙ্গে বসে ডিনার করেন। আমার ঠাকুরদা দূরের কথা, বাবাও এ জীবনযাপন করার কথা ভাবতে পারতেন না। আর ওই বয়সে প্রেমে পড়া! চিন্তা করতেও তারা শিউরে উঠতেন। এই কয়েক বছর আগে বাঙালির জীবনে যৌবনের বয়স কুড়ি কি পঁচিশ বছরের বেশি ছিল না। যৌনজীবন মানেই একটি নিষিদ্ধ আচরণ। সন্তান উৎপাদনের জন্য যেটুকু প্রয়োজন তার বেশি কিছু নয়। জোড়াসাঁকোর ঠাকুরবাড়ির একজন মহিলা তার আত্মজীবনীতে লিখেছেন যে, রাতের খাওয়া শেষ করে স্বামী ঘুমিয়ে পড়তেন সাড়ে ৯টায়। সংসারের সমস্ত কাজ শেষ করে রান্নাঘরের পাট চুকিয়ে তিনি যখন ঘরে ঢুকতেন, তখন রাত ১২টা। স্বামী শুয়ে আছেন বিছানার তিন-চতুর্থাংশ জায়গা নিয়ে। ফলে তাকে শরীর গুটিয়ে এক কোণে শুতে হতো। সারা দিন পরিশ্রমের ফলে ঘুম চলে আসত দ্রুত। কিন্তু একটা নাগাদ সেটা ভেঙে যেত স্বামীর বাথরুমে যাওয়ার শব্দ পেয়ে। ঘরে নিভু নিভু আলো জ্বলত। স্বামী বাথরুম থেকে ফিরে এসে স্ত্রীর শরীরের দখল নিতেন। তারপর আবার পাশ ফিরে ঘুমিয়ে পড়তেন। স্ত্রী জানতেন, এটাই নিয়ম। তাই শব্দহীন হয়ে থাকতেন। ৫টা বাজতে না বাজতেই তাকে শয্যা ত্যাগ করে সংসার দেখতে ঘর থেকে বেরুতে হতো। এ ছবিটা এখন প্রায় বদলে গেছে। স্ত্রীর অসম্মতিকে উপেক্ষা করা এখন বেশির ভাগ ক্ষেত্রে সম্ভব হয় না। লেখক : স্বনাম খ্যাত কথাসাহিত্যিক

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর