অগ্নিঝরা মার্চ ছিল একটি জাতির অধিকার আদায়ের জন্মসূত্র। ১৯৭১ সালের পর প্রতিটি মার্চ মাস আমাদের কাছে
একটি বিশেষ গুরুত্ব নিয়ে হাজির হয়। বিশেষ করে ভাষা আন্দোলনের মাসের পর এই মার্চের আন্দোলন আমাদের সবাইকে অনুপ্রাণিত করে। এই গুরুত্ব আজও সমানভাবে আমাদের জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করে। ১৯৭১ সালের মহান মুক্তিযুদ্ধে জাতি হিসেবে যে আকাঙ্ক্ষা ছিল সেটা এই মার্চ আমাদের দিয়েছে। মার্চ হচ্ছে বাঙালি জাতিকে তার নিজস্ব অধিকার বঞ্চিত করার প্রতিবাদ ও অধিকার আদায়ের একটি মাস। মার্চের স্মৃতিচারণ করতে বললে আমি বলি এখানে শুধু আমি জড়িত ছিলাম না, দেশের প্রত্যেক সাধারণ নাগরিক, কৃষক, শ্রমিক, ব্যবসায়ী থেকে শুরু করে সরকারি চাকুরে—সবাইকে ঐক্যবদ্ধ করেছিল। ’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ আসন পেয়েও আওয়ামী লীগকে ক্ষমতা দেওয়া হয়নি। এটা আওয়ামী লীগ নয়, পশ্চিম পাকিস্তানের ষড়যন্ত্র ছিল বাঙালিদের হাতে ক্ষমতা দেওয়া যাবে না, তার অংশ।
’৭০ সালের সাধারণ নির্বাচনে সংখ্যাগরিষ্ঠ বাঙালি সংসদ সদস্যদের নেতা শেখ মুজিবুর রহমান সংসদের প্রথম অধিবেশন ঢাকায় অনুষ্ঠানের দাবি তুলেছিলেন। তা গৃহীত হয়েছিল। ৩ মার্চ ঢাকায় সংসদ অধিবেশন বসবে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ঘোষণা দিলেন। অধিবেশন আয়োজনের নির্দেশও দিয়েছিলেন। জেনারেল ইয়াহিয়া ১ মার্চ আকস্মিক এক বেতার ভাষণে ঢাকার অধিবেশন বাতিল ঘোষণা করেন। অগ্নিগর্ভ বাংলায় স্ফুলিঙ্গ থেকে দাবানল সৃষ্টি হলো তড়িৎ গতিতে। সমগ্র বাংলার তাবৎ মানুষ প্রতিরোধে উঠে দাঁড়ালেন সংঘবদ্ধভাবে। বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান তখন ব্যস্ত ছিলেন আসন্ন সংসদ অধিবেশন নিয়ে বিজয়ী সদস্যদের সঙ্গে আলোচনায়। সাংবাদিক আর অগণিত মানুষ জড়ো হলেন বৈঠকের স্থান পূর্বাণী হোটেলে। তীব্র ক্ষোভ, ঘৃণা প্রকাশ করে প্রতিবাদ জানালেন বটে কিন্তু ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে কর্মসূচি ঘোষণা করবেন বলে জানালেন।ওই দিন পূর্বাণী হোটেলে বঙ্গবন্ধু বৈঠক করলেন। তিনি অধিবেশন বাতিল করার প্রতিবাদ করলেন। বঙ্গবন্ধু ঘোষণা দিলেন ৭ মার্চ জনসভা করবেন। ওই দিন তিনি সব নির্দেশনা দেবেন, একই সঙ্গে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করবেন। জনগণের প্রত্যাশা : কর্মসূচিতে স্বাধীনতার ঘোষণা আসতে পারে। এটা বন্ধ করার জন্য ইয়াহিয়া আবারও ষড়যন্ত্র করে তা বন্ধ করার চেষ্টা করেন। এর অংশ হিসেবে আলোচনার ডাক দেন। কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই ষড়যন্ত্রের পথে যাননি। ৭ মার্চের ঐতিহাসিক জনসভায় মুক্তিসংগ্রামের পুরো নির্দেশনা দিলেন। যদিও একই সঙ্গে ইয়াহিয়ার সঙ্গে বৈঠকও করলেন। ৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধু নেতা হিসেবে দেশের সবকিছু নিয়ন্ত্রণ করেছেন। ক্ষমতায় বসতে পারেননি। তবে সবকিছু তার কথায় চলছিল।
বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের পর আমরা সবাই এটাই ধরে নিয়েছিলাম, মুক্তিসংগ্রামের জন্য আমাদের সশস্ত্র আন্দোলনে যেতে হবে। যদিও বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ইয়াহিয়ার বৈঠকের সময় আমরা বিষয়টিকে প্রকাশ্যে আনিনি। তবে ভিতরে ভিতরে আমরা সারা দেশে মুক্তিসংগ্রামের জন্য সংগঠিত করতে কাজ করেছিলাম। ১৯৭০-এর নির্বাচন-পরবর্তী উত্তাল সময়ে সাংবাদিক ফয়েজ আহমদ সম্পাদিত সাপ্তাহিক ‘স্বরাজ’ পত্রিকায় আমি মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে কয়েকটি প্রতিবেদন লিখেছিলাম। ১৯৭১ সালের ১৯ মার্চে জয়দেবপুর ক্যান্টনমেন্টে বাঙালি জওয়ানদের বিদ্রোহ প্রসঙ্গে প্রতিবেদন উল্লেখযোগ্য যা স্বরাজে প্রকাশিত হয় ‘বিদ্রোহ ন্যায়সঙ্গত’ ব্যানার হেড লাইনে। এ সময়ে সাংস্কৃতিক কর্মী ও সংগঠনগুলোকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংঘবদ্ধ করে ‘বিক্ষুব্ধ শিল্পী সমাজ’ গঠনে তত্পর ছিলাম। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউনের পর অবস্থার অবনতিতে অবশেষে এপ্রিলের শেষে মুক্তিযুদ্ধে যোগদানের চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত নিলাম। মে মাসের প্রথম দিকে কুমিল্লা থেকে ত্রিপুরা রাজ্যের সীমান্ত এলাকার ধর্মনগর থেকে আগরতলা হয়ে কলকাতা পৌঁছলাম। ক-দিন বাদে বাংলাদেশ মিশন খুঁজে পেলাম আমার ছোটবেলার সার্কাস এভিনিউয়ে। দাঁড়িয়ে আছি। পরিচিত কাউকে পাই কিনা ভাবছি। কারণ তখন আমার মাথায় চিন্তা, এতদিন যে গলা ফাটানো স্লোগানে রাজপথে অথবা জনসভায় ধারা বিবরণী পাঠে উচ্চকিত ছিল, তাকে বিদ্রোহী বেতারে মুক্তিসংগ্রামের কাজে লাগাতে হবে। কাকতালীয়ভাবে বাদশার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমিনুল হক বাদশা, দৈনিক আজাদ পত্রিকার রিপোর্টার ছিলেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুব কাছের। বাদশা বললেন, লোহানী ভাই, দাঁড়ান আমি ভিতর থেকে আসছি। আমি বাইরে দাঁড়িয়ে মিশনের সামনে নজরুলজয়ন্তীর প্যান্ডেল তৈরির কাজ দেখছি আর বাল্যস্মৃতি রোমন্থন করছি। একি! বাদশা কি চলে গেল? কিছুক্ষণ পরে এসে অবশ্য বাদশা বললেন, চলুন, আপনাকে এক জায়গায় নিয়ে যাই। আপনার পছন্দসই জায়গা। পার্ক সার্কাস মোড় থেকে একটা ট্যাক্সি নিলাম, চলল কংগ্রেস এক্সিবিশন রোড ছাড়িয়ে বালীগঞ্জের দিকে। অবশেষে গিয়ে পৌঁছলাম সেই বাড়িটায়। দোতলার একটা ঘরে ঢুকে একটা টার্কিস টাওয়েল হাতে দিয়ে বাদশা বললেন, এটাই আপনার গামছা, বিছানা সবকিছু। স্থান হলো আশফাক-শহীদের সঙ্গে। দেখলাম, বেতার সম্প্রচারের প্রস্তুতি চলছে। কবি নজরুল ইসলাম বিদ্রোহের কবি, তাই তার জন্মদিনটাই বেছে নিয়েছিলেন, তবে এর পেছনে হয়তো একটা আবেগও জড়িত ছিল। যাই হোক, লেগে গেলাম। নতুন অভিজ্ঞতা, কী করব, কীভাবে করব জানি না। আমি যেহেতু সাংবাদিক, তাই আমাকে প্রস্তাবিত বেতারের সংবাদ বিভাগ দেখার দায়িত্ব নিতে হলো। আগেই বলেছি, ঢাল নেই, তলোয়ার নেই, তবু নিধিরাম সর্দারকে প্রয়োজন মেটাতে হবেই। ক’জন সাংবাদিক বন্ধু এলেন। শিল্পী, ঘোষক, কলাকুশলী অনেকেই এলেন। এগুলো আরেক ইতিহাস।
আমি মার্চের কথার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকি। মার্চ মাস আমাদের কাছে একটি অধিকার আদায়ের, মাথা উঁচু করে দাঁড়ানোর মাস। এই মাসের আলাদা গুরুত্ব রয়েছে, মাহাত্ম্য রয়েছে। বিশেষ করে ১ মার্চ, ৭ মার্চ, ২৫ মার্চ, ২৬ মার্চের ঘটনাবলী বাঙালিকে যেভাবে ঐক্যবদ্ধ করেছিল সেটা এখন আর নেই। এই মার্চের আরও একটি দিন গুরুত্বপূর্ণ সেটা হচ্ছে ১৭ মার্চ। ওই দিন বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের জন্মদিন। মার্চ শুধু বঙ্গবন্ধুর জন্ম হয়নি। মার্চে একটি জাতির জন্ম হয়েছে। কিন্তু দুঃখজনক কথা, যে আকাঙ্ক্ষা নিয়ে আমরা স্বাধীন হয়েছিলাম সেটা ক্রমাগত পেছনের দিকে যাচ্ছে। অসাম্প্রদায়িক বাংলাদেশের স্বপ্ন আমাদের অধরা থেকে যাচ্ছে। রাষ্ট্র আত্মসমর্পণ করছে মৌলবাদের কাছে। এটা আত্মহত্যার শামিল। আজ পাঠ্যপুস্তক মৌলবাদী, সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর পরামর্শে সংশোধন করা হয়। মার্চের যে আকাঙ্ক্ষা, যে সংগ্রামের তার সঙ্গে এটা বেইমানি। রবীন্দ্রনাথ, জসীমউদ্দীন, জীবনানন্দ দাশকে বাদ দিতে হবে। এই চিন্তা যারা করে তারা স্বাধীনতার সঙ্গে বেইমানি করে। এই সাম্প্রদায়িক গোষ্ঠীর বিরুদ্ধে আমাদের ঐক্যবদ্ধ হতে হবে। আমাদের সংগ্রামে নামতে হবে।
অনুলিখন : আলী রিয়াজ