বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধকে যারা কেবল ১৯৭১ সালের ৯ মাসের ঘটনাবলির ভিতরই সীমাবদ্ধ ছিল বলে মনে করেন, তাদের সেই ভাবনা সঠিক নয়। মুক্তিযুদ্ধ গড়ে ওঠে বহু আগে থেকে, বছরের পর বছর ধরে জনগণের অধিকার আদায়ের বহুমুখী সংগ্রামী কর্মকাণ্ডের মধ্য দিয়ে। ব্রিটিশ আমলে ঔপনিবেশিক শাসনের বিরুদ্ধে বাঙালিসহ গোটা ভারতবাসী যে রক্তঝরা সংগ্রাম পরিচালনা করেছিল, তাও ছিল আমাদের মুক্তিসংগ্রামেরই একটি গুরুত্বপূর্ণ অংশ। সে লড়াই ছিল সাম্রাজ্যবাদের শাসন ও শোষণের হাত থেকে জাতীয় মুক্তি অর্জনের। সূর্যসেন, ক্ষুদিরাম, বাঘা যতীনসহ যারা অকাতরে জীবন দিয়ে ব্রিটিশ শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই করেছিলেন, তাদেরও আমি আমাদেরই মুক্তিসংগ্রামের মুক্তিযোদ্ধা বলে বিবেচনা করি। কিন্তু ব্রিটিশ শাসকরা মুসলিম ও হিন্দু সাম্প্রদায়িক শক্তির সহযোগিতায় আমাদের জাতীয় মুক্তি আন্দোলনকে বিপথে পরিচালিত করে সাম্প্রদায়িক বিচার-বিতর্কে কৃত্রিম পাকিস্তান রাষ্ট্রের জন্ম দিয়েছিল। পাকিস্তানের শাসকরা সাম্রাজ্যবাদী নয়া ঔপনিবেশিক শোষণ অব্যাহত রাখার পাশাপাশি নিজেরাও বাঙালির ওপর চাপিয়ে দিয়েছিল নির্মম ও তীব্র জাতিগত শোষণের অতিরিক্ত বোঝা। বিজাতীয় শোষণ-শাসনের জাঁতাকলে পিষ্ট বাঙালি তাদের এই করুণ পরিণতি মেনে নেয়নি। ধীরে ধীরে গড়ে উঠেছিল গণপ্রতিরোধ। ভাষা, ভোটাধিকার, গণতন্ত্র, শোষণমুক্তি, সাম্রাজ্যবাদের শৃঙ্খলের অবসান প্রভৃতি দাবিতে গঠিত হয়েছিল বীরত্বপূর্ণ ও সাহসী আন্দোলনের উজ্জ্বল অধ্যায়। ভাষা আন্দোলন, যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনে মুসলিম লীগের ভরাডুবি, আইয়ুব শাসনের বিরুদ্ধে লড়াই, ’৬০-এর দশকের শিক্ষা আন্দোলন, শ্রমিকদের ট্রেড ইউনিয়ন আন্দোলন, কৃষকের বাঁচার দাবিতে সংগ্রাম, ৬ দফা আন্দোলন, ১১ দফার ভিত্তিতে ’৬৯-এর গণঅভ্যুত্থানের মাধ্যমে আইয়ুব শাহির পতন ইত্যাদি বাঙালি জাতির মুক্তির সংগ্রামকে পরিপুষ্ট করে তুলেছিল। ১৯৭০-এর নির্বাচনে বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেলেও গণরায় অনুযায়ী ক্ষমতা হস্তান্তর না করে পাকিস্তানি শাসকরা সংঘটিত করেছিল নিষ্ঠুরতম গণহত্যা। পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর কামান, বন্দুক, মর্টার, ট্যাঙ্ক, জঙ্গিবিমান ইত্যাদি দিয়ে বাঙালির মুক্তিসংগ্রামকে রুদ্ধ করা যায়নি। সশস্ত্র প্রতিরোধে গর্জে উঠেছিল লাখো কোটি বাঙালি। ঘরে ঘরে দুর্গ গড়ে উঠেছিল। বাঙালির সে লড়াই হঠাৎ করে শুরু হওয়া কোনো ‘বিচ্ছিন্নতাবাদী’ আন্দোলন ছিল না। তা ছিল দীর্ঘকাল ধরে পরিচালিত সাম্রাজ্যবাদবিরোধী জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের ধারায় পরিচালিত। মার্চ মাস থেকে শুরু হওয়া সশস্ত্র প্রতিরোধের ৯ মাসের পর্বটি ছিল বহু বছর ধরে চলতে থাকা জাতীয় মুক্তি আন্দোলনের শীর্ষ অধ্যায়। মুক্তিযুদ্ধের বিজয়ের মধ্য দিয়ে নতুন প্রতিষ্ঠিত রাষ্ট্র বাংলাদেশ গণতন্ত্র-ধর্মনিরপেক্ষতার ধারার পাশাপাশি সাম্রজ্যবাদবিরোধিতা ও সমাজতন্ত্র অভিমুখিতাকে রাষ্ট্রীয় নীতি হিসেবে ঘোষণা করেছিল। আজ ৪৬ বছর পরে গণতন্ত্র খর্বিত, ধর্মনিরপেক্ষতা আক্রান্ত। শুধু তাই নয়, দেশ এখন সাম্রাজ্যবাদী বিশ্বায়নের শিকার ও বিদেশি আধিপত্যবাদী শক্তির পদানত। দেশ চলছে সমাজতন্ত্রের বিপরীতমুখী লুটেরা ধনতন্ত্র ও পুঁজিবাদী বাজার অর্থনীতির ধারায়। মুক্তিযুদ্ধের চেতনা ধারায় আজ বুর্জোয়া শাসকদের দ্বারা পদদলিত। এ অবস্থা চলতে দেওয়া যায় না। শহীদের রক্ত বৃথা যেতে দেওয়া যায় না। আজ তাই প্রয়োজন চলমান মুক্তিসংগ্রামের নতুন অধ্যায় সূচনার। প্রয়োজন উত্তাল মার্চের মতো আরেকটি জাগরণ। নতুন প্রজন্মকে সেজন্য ঘরে ঘরে প্রস্তুত হতে হবে। তাদের ওপর ইতিহাস ভরসা করে আছে। এখনো আমাদের জাতীয় মুক্তির সংগ্রাম শেষ হয়নি। অনুলিখন : রুহুল আমিন রাসেল।