বুধবার, ১৯ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

কৃষকের সন্তান বলেই তাদের সুখ-দুঃখ আমার হৃদয় ছোঁয়

সুনামগঞ্জ প্রতিনিধি

কৃষকের সন্তান বলেই তাদের সুখ-দুঃখ আমার হৃদয় ছোঁয়

মো. আবদুল হামিদ

অকালবন্যায় হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ ভেঙে সুনামগঞ্জে বোরো ফসলের ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতির পর ক্ষতিগ্রস্ত এলাকা পরিদর্শন করতে দুই দিনের সফরে এসে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ বলেন, ‘বৈশাখে ধান তোলার সময় এলে সুনামগঞ্জে যে কান্না শুরু, তা কিশোরগঞ্জে গিয়ে থামে। একজন কৃষকের সন্তান হিসেবে এই কান্না আমার হৃদয়কে স্পর্শ করে বলেই আপনাদের দাওয়াতের অপেক্ষা না করে ফসলহারা মানুষের কষ্ট দেখতে এখানে ছুটে এসেছি। এসেছি যখন তখন কিছু না কিছু ফল হবে। হাওরের কোনো মানুষ না-খেয়ে মরবে না।’

সুনামগঞ্জে রাষ্ট্রপতির আগমন উপলক্ষে সোমবার রাতে জেলা শিল্পকলা একাডেমির হাছন রাজা অডিটোরিয়ামে আয়োজিত এক মতবিনিময় সভায় এসব কথা বলেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। রাত সাড়ে ৯টা থেকে সাড়ে ১০টা পর্যন্ত এক ঘণ্টার অলিখিত বক্তব্য চলাকালে উপস্থিত সুধীজন মন্ত্রমুগ্ধের মতো তা উপভোগ করেন। হাওরের বিপন্ন মানুষের জন্য তার দরদ ও পাশে থাকার আশ্বাসের কথা শোনার পর উচ্ছ্বসিত মানুষের করতালিতে মুখরিত হয়ে ওঠে সভাস্থল। সোমবার বিভিন্ন সংগঠনের প্রতিনিধির সঙ্গে হাওরের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে একাধিক মতবিনিময় সভায় মিলিত হওয়ার পর রাতযাপন শেষে গতকাল দুপুরের পর সুনামগঞ্জ ত্যাগ করেন রাষ্ট্রপতি। মতবিনিময় সভায় রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ বলেন, ‘আমাদের নদী আর হাওরগুলো ভরাট হয়ে গেছে। এগুলো খনন করে পানির ধারণক্ষমতা বৃদ্ধি করা না হলে দীর্ঘ মেয়াদে হাওরের একমাত্র বোরো ফসলকে আগাম বন্যার হাত থেকে রক্ষা করা যাবে না।’ এ ব্যাপারে পদক্ষেপ নিতে সরকারের সঙ্গে কথা বলবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন তিনি। রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘পাহাড়ি নদী থেকে শুরু করে ভৈরব বাজার পর্যন্ত ক্যাপিটাল ড্রেজিংয়ের আওতায় নিয়ে আসা জরুরি। হাওরের মাটির বাঁধের পরিবর্তে পাকা ডুবন্ত বাঁধ নির্মাণ করা হলে বোরো ফসল আরও সুরক্ষিত হবে। এই ডুবন্ত পাকা সড়ক আমার এলাকায় উদ্ভাবন করে পরীক্ষামূলক চালু করে ভালো ফল পেয়েছিলাম। এগুলো একদিকে ফসল রক্ষা বাঁধের কাজ দেবে, অন্যদিকে হেমন্তে যাতায়াতের সড়ক হিসেবেও ব্যবহার হবে।’ রাষ্ট্রপতি বলেন, হাওরে বিকল্প কর্মসংস্থান সৃষ্টির লক্ষ্যে বিশেষ শিল্পাঞ্চল স্থাপন করা দরকার। না হলে ফসলহারা মানুষ স্রোতের মতো ঢাকার দিকে প্রবাহিত হবে। মানুষের সেই চাপ সহ্য করার ক্ষমতা যে ঢাকা ইতিমধ্যে হারিয়ে ফেলেছে। আগামী ২ মে শুরু হওয়া অধিবেশনে হাওরাঞ্চলের দুর্যোগ নিয়ে স্থানীয় সংসদ সদস্যদের সমস্বরে সংসদে কথা বলার পরামর্শ দিয়ে রাষ্ট্রপতি বলেন, ‘না কাঁদলে দাবি আদায় হবে না।’ এদিকে রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদের সঙ্গে অনুষ্ঠিত মতবিনিময় সভায় জেলার সব সংসদ সদস্য, জেলা পরিষদের চেয়ারম্যান, পৌর মেয়রসহ জনপ্রতিনিধিরা হাওরের ফসল রক্ষা বাঁধ নির্মাণে দুর্নীতির বিরুদ্ধে সোচ্চার বক্তব্য দিয়ে জড়িতদের শাস্তি দাবি করেন। রাষ্ট্রপতি তাদের কথার পরিপ্রেক্ষিতে বলেন, সবাই (জনপ্রতিনিধি) যেখানে দুর্নীতির বিরুদ্ধে, সেখানে দুর্নীতি হয় কী করে! রাষ্ট্রপতি তার স্বভাবসুলভ রসাত্মক ভঙ্গিতে বলেন, ‘আমি আজীবন রাজনীতি করে এলেও ডেপুটি স্পিকার, স্পিকারের মতো নিরপেক্ষ পদগুলো আমার ভাগ্যে জুটেছে। আর এখন তো রাষ্ট্রপতির মতো মহানিরপেক্ষ জায়গায় আছি। তাই আমি সরকারের কেউ না। এ দুর্যোগের সময় আপনাদের জন্য কতটুকু কী করতে পারব জানা নেই। তবে হাওরের মানুষের দুর্দশা নিয়ে প্রধানমন্ত্রীসহ সরকারের সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয়গুলোর সঙ্গে কথা বলব, যাতে তারা মানুষের দুর্দশা দূর করতে পারেন। ফসলহানির পর আগামী বোরো ফসল তোলার আগ পর্যন্ত সরকারের সব খাদ্যবান্ধব কর্মসূচির আওতা বৃদ্ধি করে তা অব্যাহত রাখার সুপারিশ করব।’ জেলা প্রশাসক শেখ রফিকুল ইসলামের সঞ্চালনায় মতবিনিময় সভায় অন্যান্যের মধ্যে বক্তব্য দেন অর্থ ও পরিকল্পনা প্রতিমন্ত্রী এম এ মান্নান, মুহিবুর রহমান মানিক এমপি, জয়া সেনগুপ্তা এমপি, মোয়াজ্জেম হোসেন রতন এমপি, পীর ফজলুর রহমান মিসবাহ এমপি, রেজওয়ানুল আহমদ তৌফিক এমপি, শামছুন্নাহার বেগম শাহানা এমপি, সিলেটের বিভাগীয় কমিশনার ড. মোছাম্মৎ নাজমান আরা খানুম, সিলেটের ডিআইজি কামরুল আহসান, জেলা পরিষদ চেয়ারম্যান নূরুল হুদা মুকুট, পুলিশ সুপার মো. বরকত উল্লাহ খান, সুনামগঞ্জ পৌরসভার মেয়র আয়ুব বখত জগলুল, সাবেক এমপি আবদুল মজিদ, দোয়ারাবাজার উপজেলা চেয়ারম্যান ইদ্রিছ আলী, দক্ষিণ সুনামগঞ্জ উপজেলা চেয়ারম্যান হাজী আবুল কালাম, সাংবাদিক কামরুজ্জামান চৌধুরী সাফি, বিজন সেন রায়, পঙ্কজকান্তি দে প্রমুখ। এর আগে সোমবার বেলা ২টা ২০ মিনিটে সুনামগঞ্জের পুলিশ লাইনস মাঠে এসে অবতরণ করেন রাষ্ট্রপতি। সার্কিট হাউসের সম্মেলনকক্ষে বোরো ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে ২০ মিনিটের ভিডিওচিত্র উপস্থাপন করেন জেলা প্রশাসক। এ সময় রাষ্ট্রপতিকে জানানো হয়, জেলায় আবাদকৃত সোয়া ২ লাখ হেক্টর বোরো ফসলের মধ্যে ৮২ ভাগ পানির নিচে তলিয়ে গেছে। এতে প্রায় ২ লাখ ৭১ হাজার কৃষক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছেন। গতকাল বিকাল সাড়ে ৫টায় সার্কিট হাউস মিলনায়তনে জেলা আইনজীবী সমিতির নেতারা ফসলের ক্ষয়ক্ষতি নিয়ে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে মতবিনিময় করেন। এরপর ডিএস রোডের ‘ঐতিহ্য জাদুঘর’ পরিদর্শনে যান রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। চৈত্রের আগাম বন্যায় হাওরাঞ্চলের বিস্তীর্ণ এলাকার বোরো ফসল সরেজমিনে পরিদর্শনে তিন দিনের সফরে বের হন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ। রবিবার প্রথম দিনের সফরে কিশোরগঞ্জের মিঠামইনে আসেন তিনি। সফরের দ্বিতীয় দিন সোমবার বেলা ১২টায় তিনি মিঠামইন থেকে হেলিকপ্টারে সুনামগঞ্জের উদ্দেশে যাত্রা করেন। এ সময় লো-ফ্লাই করে নেত্রকোনার মোহনগঞ্জ, ধর্মপাশা, শাল্লা, দিরাই ও বিশ্বম্ভরপুরের ক্ষতিগ্রস্ত হাওরের অবস্থা পরিদর্শন করেন রাষ্ট্রপতি।

আজ রাষ্ট্রপতি ময়মনসিংহ যাচ্ছেন : ময়মনসিংহ প্রতিনিধি জানান, ময়মনসিংহের ত্রিশালে প্রতিষ্ঠিত জাতীয় কবি কাজী নজরুল ইসলাম বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম সমাবর্তনে যোগ দিতে আজ ত্রিশাল যাচ্ছেন রাষ্ট্রপতি মো. আবদুল হামিদ। তার আগমন উপলক্ষে জেলা প্রশাসন ও বিশ্ববিদ্যালয় সার্বিক প্রস্তুতি সম্পন্ন করেছে। রাষ্ট্রপতির প্রটোকল অফিসার শেখ রাসেল হাসান স্বাক্ষরিত পত্র থেকে জানা যায়, বেলা দেড়টায় ঢাকার তেজগাঁও হেলিপ্যাড থেকে ত্রিশালের উদ্দেশে রওনা দেবেন। পরে আড়াইটায় তিনি নজরুল বিশ্ববিদ্যালয়ের সমাবর্তনে যোগ দেবেন। সমাবর্তন শেষে ৩টা ৪০ মিনিটে ঢাকার উদ্দেশে রওনা দেবেন রাষ্ট্রপতি।

সর্বশেষ খবর