রবিবার, ৩০ এপ্রিল, ২০১৭ ০০:০০ টা

কাঠগড়ায় তৃণমূল, কঠোর বার্তা আওয়ামী লীগের

রফিকুল ইসলাম রনি

‘জেলা পরিষদ নির্বাচনে আমি আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনার মনোনীত নৌকার প্রার্থী ছিলাম। কিন্তু আমার সভাপতি নির্বাচনে কোনোরকম সহযোগিতা না করে ষড়যন্ত্র করেন। ফলে নির্বাচনে যা হওয়ার তাই হয়েছে। এই অভিযোগ আমি ইতিমধ্যেই আপনাদের কাছে লিখিতভাবে জমা দিয়েছি।’ এমন অভিযোগ নীলফামারী জেলা আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মমতাজুল ইসলামের। জেলা নেতাদের সঙ্গে কেন্দ্রের ধারাবাহিক বৈঠকের অংশ হিসেবে গত বৃহস্পতিবার বিকালে ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগ সভানেত্রীর কার্যালয়ে কেন্দ্রীয় নেতাদের কাছে এ অভিযোগ করেন তিনি। জেলা সাধারণ সম্পাদকের এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে সভাপতি দেওয়ান কামাল আহমেদ তার সপক্ষে কিছু যুক্তি দেখান এবং নেতাদের কাছে অঙ্গীকার করেন যে, ভবিষ্যতে এমন ঘটনা আর হবে না।

শুধু নীলফামারী জেলাই নয়, ৩০টি জেলায় আওয়ামী লীগের অভ্যন্তরীণ কোন্দল চরম আকার নিয়েছে। নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্য হয়ে উঠেছে। তাদের ‘পন্থিরা’ রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়াচ্ছেন। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে— এ অবস্থায় অভ্যন্তরীণ কোন্দল ভাবিয়ে তুলছে দলের হাইকমান্ডকে। তাই মাঠ নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে কথা বলছেন কেন্দ্রীয় নেতারা। শুধু নেতাই নন, ডাকা হচ্ছে দলীয় এমপিদেরও। দিচ্ছেন কঠোর বার্তা। গ্রুপিং করলে কোনো ছাড় দেওয়া হবে না। দলীয় সূত্রমতে, কোন্দলে দলের ভাবম?ূর্তি নষ্ট ও সংগঠন দুর্বল হয়ে পড়লে নির্বাচনে নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বলে দলের নীতিনির্ধারকরা মনে করছেন। তাই আগামী নির্বাচনের আগে কোন্দল মিটিয়ে দলকে সুশৃঙ্খল করার ওপর গুরুত্ব দেওয়া হচ্ছে। নীতিনির্ধারক পর্যায়ের নেতারা জানান, অভ্যন্তরীণ কোন্দলের জেরে ইতিমধ্যে ঘটে যাওয়া কিছু ঘটনা ভাবিয়ে তুলেছে। বার বার সতর্ক করা সত্ত্বেও সুপথে না আসায় এসব ঘটনার সঙ্গে জড়িতদের বিরুদ্ধে শক্ত অবস্থান নেওয়া হয়েছে।

বৃহস্পতিবারের বৈঠকে নীলফামারী-৩ আসনের সংসদ সদস্য গোলাম মোস্তাফা জানান, ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে নৌকার প্রার্থী বাছাইয়ের ক্ষেত্রে জেলা সভাপতি, সাধারণ সম্পাদক তাদের কোনো মতামত নেননি। তারা একক সিদ্ধান্তে কেন্দ্রে নাম পাঠিয়েছেন। এমন অভিযোগের পরিপ্রেক্ষিতে আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘ভবিষ্যতে যাতে নিয়মবহির্ভূত এমন ঘটনা না ঘটে। আর যদি ঘটে তাহলে আমরা কেন্দ্রীয়ভাবে তদন্ত করব। তদন্তে যার বিরুদ্ধে অভিযোগ প্রমাণিত হবে তার বিরুদ্ধে সাংগঠনিক ব্যবস্থা নেওয়া হবে। আমরা কিন্তু জেলা পরিষদ নির্বাচন নিয়ে তদন্ত করে এমন অভিযোগের সত্যতার প্রমাণ পেয়েছি। আপনারা দলীয় স্বার্থে ঐক্যবদ্ধ হয়ে এখন থেকেই আগামী জাতীয় নির্বাচনের কাজ শুরু করে দিন।’ চট্টগ্রামের রাজনীতিতে নগর আওয়ামী লীগের সভাপতি এ বি এম মহিউদ্দিন চৌধুরী ও সাধারণ সম্পাদক আ জ ম নাছিরের মধ্যে আধিপত্যের প্রতিযোগিতা নতুন নয়। তবে দুজনের রাজনৈতিক এই প্রতিযোগিতা সম্প্রতি ব্যক্তিগত দ্বন্দ্বে রূপ নিয়েছে। সাবেক ও বর্তমান মেয়রের এই দ্বন্দ্ব্ব সাংঘর্ষিক পরিস্থিতির দিকে ঠেলে দিচ্ছে বন্দরনগরকে। এই দ্বন্দ্ব মেটাতে স্থানীয় এবং কেন্দ্রীয়ভাবে দফায় দফায় উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। সর্বশেষ দলের সাধারণ সম্পাদক চট্টগ্রামে এসে দুজনের সঙ্গে বসেছেন। গত শুক্রবার রাতে চট্টগ্রামের বিভাগীয় সাংগঠনিক সম্পাদক এনামুল হক শামীম দুই নেতাকে নিয়ে বৈঠক করেছেন। গতকাল মহানগর আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভায় আওয়ামী লীগ সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের বলেছেন, ‘আপনি সবার মুরব্বি। নাছির (আ জ ম নাছির) কোনো কিছু করলে ঘরে ডেকে শাসন করবেন। কিন্তু ঘরের কথা তো পরকে বলতে পারেন না।’ ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচন কেন্দ্র করে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে প্রকাশ্যে দ্বন্দ্ব শুরু হয় প্রবীণ নেতা প্রাণিসম্পদমন্ত্রী ছায়েদুল হকের। মন্ত্রীর সঙ্গে জেলা আওয়ামী লীগ সভাপতি ব্রাহ্মণবাড়িয়া-৩ আসনের এমপি র আ ম উবায়দুল মোকতাদির চৌধুরীর দ্বন্দ্ব এখন প্রকাশ্যে।

একাধিক ধারায় বিভক্ত কুষ্টিয়া জেলা আওয়ামী লীগের রাজনীতি। এই বিভক্তি প্রকাশ্যে রূপ নেয় ২০১৪ সালের ২৫ নভেম্বর দলের সম্মেলনের দিন থেকে। সম্মেলনে ৫ জানুয়ারির জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দলীয় সিদ্ধান্ত অমান্য করে বিদ্রোহী প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করা ‘বিতর্কিত’ সদর উদ্দিন খানকে সভাপতি ও আগের কমিটির সাধারণ সম্পাদক ‘মধ্যপন্থি’ আজগর আলীকে একই পদে রেখে কমিটি ঘোষণা করা হয়। অন্যদিকে কাউন্সিলে কমিটি ঘোষণার আগেই শহরের আড়ুয়াপাড়ায় আওয়ামী লীগের পুরাতন জেলা কার্যালয়ে সংবাদ সম্মেলন ডেকে জেলা আওয়ামী লীগের সাবেক সিনিয়র সহসভাপতি পৌর মেয়র আনোয়ার আলীকে সভাপতি ও কুষ্টিয়া-৪ (খোকসা-কুমারখালী) আসনের এমপি আবদুর রউফকে সাধারণ সম্পাদক করে আরেকটি কমিটি ঘোষণা করা হয়। সে থেকেই রাজনীতিতে বিভক্ত জেলা আওয়ামী লীগ। আরেক গ্রুপের নেতৃত্ব দিচ্ছেন শহর আওয়ামী লীগের আতাউর রহমান আতা। সিনিয়র নেতাদের বাদ দিয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন তিনি একা। জেলার কোন্দল চরম আকার ধারণ করায় গত রবিবার ধানমন্ডিতে ডাকা হয় নেতা ও এমপিদের। দলের সাধারণ সম্পাদক ওবায়দুল কাদের সাফ জানিয়ে দিয়েছেন নির্বাচনের আগে কোন্দলে জড়ালে মাশুল দিতে হবে। কোনো গ্রুপিংয়ের রাজনীতি চলবে না। দলের নেতা-কর্মীদের নিয়েই চলতে হবে। দলের স্বার্থে সবাইকে ঐক্যবদ্ধ থাকতে হবে। যশোর জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি শহীদুল ইসলাম মিলন ও সাধারণ সম্পাদক শাহীন চাকলাদার দুটি গ্রুপে রাজনীতি করেন। কেউ কাউকে জিজ্ঞাসা করে দলীয় কর্মসূচি পালন করেন না। গত সোমবার ধানমন্ডিতে আওয়ামী লীগের কেন্দ্রীয় নেতাদের সামনেই বাগ্যুদ্ধে লিপ্ত হন দুই নেতা। শাহীন চাকলাদার বলেন, জেলা সভাপতি আলাদা গ্রুপ নিয়ে চলেন। জবাবে শহীদুল ইসলাম মিলন বলেন, ‘আপনাকে (শাহীন) নিয়ে দলীয় কর্মসূচি পালন করলে মারামারি করেন।’ সে সময় ওবায়দুল কাদের জিজ্ঞাসা করেন এমন অভিযোগ কি কখনো করেছিলেন? জবাবে মিলন বলেন, অভিযোগ করা হয়নি। ওবায়দুল কাদের বলেন, এখন থেকে একসঙ্গে কাজ করবেন। কোনো সমস্যা হলে কেন্দ্র ব্যবস্থা নেবে।

যশোর, কুষ্টিয়া, চট্টগ্রাম ছাড়াও আওয়ামী লীগের তৃণমূলের কোন্দলে জর্জরিত সাংগঠনিক জেলাগুলোর মধ্যে রয়েছে— খাগড়াছড়ি, বান্দরবান, নারায়ণগঞ্জ, মুন্সীগঞ্জ, নরসিংদী, জামালপুর, কিশোরগঞ্জ, শেরপুর, ফরিদপুর, শরীয়তপুর, খুলনা জেলা, রাজশাহী জেলা, নওগাঁ, বরিশাল মহানগর, ভোলা, পিরোজপুর, মৌলভীবাজার ও সুনামগঞ্জ। এসব এলাকায় জেলা-উপজেলার নেতাদের সঙ্গে এমপি-মন্ত্রীদের দূরত্ব তৈরি হয়েছে। একাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচন সামনে রেখে কোন্দল কমিয়ে আনতেই কেন্দ্রের নেতারা এখন তৃণমূলে যাচ্ছেন। পাশাপাশি বেশি বিরোধপূর্ণ জেলা নেতাদের ঢাকায় ডেকে এনে কথা বলছেন। সমস্যা সমাধান করে দিচ্ছেন। এ প্রসঙ্গে আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘কিছু জেলায় সমস্যা রয়েছে, সেসব জেলার নেতাদের ঢাকায় এনে কথা বলছি। সমস্যা সমাধান করা হচ্ছে। বিরোধপূর্ণ অনেক জেলার নেতারাই এখন এক টেবিলে বসে দলীয় কর্মসূচি পালন করছেন।’ তিনি আশা করেন, কয়েক মাসের মধ্যে দ্বন্দ্ব দূর করতে সক্ষম হবেন।

সর্বশেষ খবর