সোমবার, ১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

দেশ-বিদেশ কোথাও ভালো নেই নারী শ্রমিক

জিন্নাতুন নূর

কি দেশে কি বিদেশে—বাংলাদেশের নারীশ্রমিকরা কোথাও ভালো নেই। কাজ করতে গিয়ে একদিকে যেমন তারা মজুরি-বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন, অন্যদিকে নারীবান্ধব পরিবেশ না থাকায় দিনের পর দিন বহু নারীশ্রমিক কাজ হারানোর ভয়ে কর্মক্ষেত্রে লাঞ্ছনা সয়ে যাচ্ছেন। দেশ-বিদেশে গৃহশ্রমে জড়িত নারীশ্রমিকরা যথাযথ সহায়তা না পাওয়ায় গৃহকর্তার যৌন নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। এ নির্যাতন সহ্য করতে হচ্ছে পোশাক খাতে কর্মরত নারীশ্রমিককেও। অন্যদিকে দেশের চা-বাগানগুলোতে কর্মরত নারীশ্রমিকদের স্বাস্থ্যগত সমস্যা কখনোই আমলে আনে না সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ। গর্ভকালীন সময়েও অমানুষিক পরিশ্রমের কারণে এই নারীশ্রমিকদের অনেকের গর্ভপাত হচ্ছে। এ অবস্থায় আজ বিশ্বের অন্যান্য দেশের মতো বাংলাদেশেও পালিত

হচ্ছে শ্রমজীবী মানুষের অধিকার আদায়ের দিবস। রাজধানীতে পোশাক কারখানার নারীশ্রমিকদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, কর্মক্ষেত্রে প্রতিনিয়তই তাদের যৌন নিপীড়নের শিকার হতে হচ্ছে। নগরীর পোশাক কারখানার কয়েকজন নারীশ্রমিক জানান, কাজের সময় সুপারভাইজার বা মালিকশ্রেণির কর্তাব্যক্তিদের দ্বারা তারা নানাভাবে লাঞ্ছিত হচ্ছেন। কিন্তু চাকরি হারানোর ভয়ে বেশির ভাগ নারীশ্রমিক নিপীড়নের কথা কাউকে জানান না। শ্রমিকনেতারা জানান, একটি কারখানায় মালিক ও সংশ্লিষ্ট কর্তাব্যক্তিরা প্রেম বা বিয়ের প্রলোভন দেখিয়ে নারীশ্রমিকদের সঙ্গে অনৈতিক সম্পর্ক গড়ে তাদের সঙ্গে প্রতারণা করেন। দেশের শ্রম আইনে একজন নারীকে তার অনুমতি ছাড়া লেটনাইট ডিউটি করানোর নিয়ম নেই। যদি কোনো কারখানা এমন করে সে ক্ষেত্রে সেই নারীকে নিরাপদে তার গন্তব্যে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব কর্তৃপক্ষের। কিন্তু দেশের পোশাক কারখানাগুলোতে এই নজির নেই। ফলে প্রায়ই কর্মস্থল থেকে বাড়ি ফেরার পথে নারীশ্রমিকদের সহ্য করতে হয় বখাটেদের অপ্রীতিকর আচরণ। বেশ কয়েকজন নারীশ্রমিক জানান, লেটনাইট ডিউটি শেষে রাতে বাড়ি ফেরার পথে প্রায়ই তাদের বখাটেদের মুখোমুখি হতে হয়। বখাটেরা তাদের কুশ্রী মন্তব্য ও কুপ্রস্তাব করে। গার্মেন্ট শ্রমিক ঐক্য ফোরামের সভাপতি মোশারেফা মিশু বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, নারীদের রাত ৮টার পর কাজ করানোর নিয়ম না থাকলেও কারখানাগুলোতে রাতভর তাদের দিয়ে কাজ করানো হচ্ছে। বেশির ভাগ ক্ষেত্রে নারীশ্রমিকরা চাকরি হারানোর ভয়ে নিজেদের অপ্রাপ্তি নিয়ে প্রতিবাদ করার সাহস পান না। অন্যদিকে গৃহকর্মী সুরক্ষা ও কল্যাণ নীতি, ২০১৫ প্রণয়ন করা হলেও এর বাস্তবায়ন না হওয়ায় নারী-গৃহকর্মীরা এখনো নানাভাবে নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। কর্মঘণ্টা ও শ্রমের মানদণ্ডে মজুরির হিসাব না হওয়ায় তাদের বেতন-বৈষম্যের শিকার হতে হচ্ছে। এ ছাড়া তারা সাপ্তাহিক ছুটি ও পর্যাপ্ত খাবার এবং বিশ্রাম থেকেও বঞ্চিত। ছোটখাটো কাজের ভুলে গৃহকর্ত্রীর শারীরিক নির্যাতনের শিকার হতে হয় কম-বেশি প্রতিটি গৃহশ্রমিককে। আর দেশের বাইরে অভিভাবকহীন নারীশ্রমিকদের নির্যাতনের হার আরও বেশি। বাংলাদেশ থেকে উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক নারীশ্রমিক দেশের বাইরে কাজ করতে যাচ্ছেন। আর এদের মধ্যে অধিকাংশই যাচ্ছেন মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে। ব্যুরো অব ম্যানপাওয়ার, এমপ্লয়মেন্ট অ্যান্ড ট্রেনিংয়ের (বিএমইটি) পরিসংখ্যান অনুযায়ী, এ বছরের প্রথম তিন মাসে বিদেশে কাজ করতে গিয়েছেন মোট ৩০ হাজার ৪০৫ জন নারী। এর মধ্যে ২০ হাজার ৭২৩ জনই গিয়েছেন সৌদি আরবে। তবে মধ্যপ্রাচ্যের বিভিন্ন দেশে কাজ করতে যাওয়া নারীরা নানা রকম নির্যাতনের শিকার হচ্ছেন। গৃহশ্রমিক, নার্স, পরিচ্ছনতাকর্মী ইত্যাদি কাজের জন্য আকর্ষণীয় বেতন দেওয়ার লোভ দেখিয়ে সেখানে নিয়ে বাংলাদেশি নারীদের দেহব্যবসায় বাধ্য করানো হচ্ছে। রাজধানীতে নারীশ্রমিকদের প্রশিক্ষণকেন্দ্র কোরিয়া-বাংলাদেশ টেকনিক্যাল ট্রেনিং সেন্টারে বেশ কয়েকজন নারীশ্রমিকের কথা হয়। এদের অনেকের মধ্যপ্রাচ্যে কাজের অভিজ্ঞতা আছে। তারা জানান, সেখানে গৃহস্থালি কাজের জন্য ঠিকমতো খাবার দেওয়া হয় না। বিশ্রামও নিতে দেওয়া হয় না। মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতে কাজের চাপ খুব বেশি। সেখানে একজন গৃহকর্মীকে দিন-রাত মিলিয়ে ২০ ঘণ্টা পর্যন্ত কাজ করতে হয়। এদিকে বিদেশে কাজ করতে গিয়ে নির্যাতনের শিকার নারীদের অনেকেই মানসিক ভারসাম্য হারিয়ে দেশে ফেরেন। জানতে চাইলে দেশে ফিরে আসা প্রবাসী নারীশ্রমিক সাবিনা বলেন, সংসারের খরচ জোগাতে তিনি জর্ডানে কাজ করতে যান। কিন্তু তার মালিক তাকে প্রায়ই নির্যাতন করতেন। এমনকি দেশে তার পরিবারের সঙ্গে তাকে যোগাযোগ করতে দিতেন না। তিনি অসুস্থ স্বামীর জন্য টাকা চাইলে তাকে তাও দেওয়া হয়নি। প্রায়ই সাবিনাকে মারধর করা হতো। গায়ে গরম পানি ঢালা হতো। খাবার পর্যন্ত খেতে দেওয়া হতো না। এদিকে দেশের নারীশ্রমিকরা কাজ করতে গিয়ে কোনো খাতেই মাতৃত্বকালীন পর্যাপ্ত বিশ্রাম নেওয়ার সুযোগ পান না। বরং এ সময় তাদের মধ্যে কাজ হারানোর শঙ্কা তৈরি হয়। আর যারা ছুটি পান তারা বিনা বেতনে তা উপভোগ করেন। দেশের নারীশ্রমিকদের উল্লেখযোগ্য-সংখ্যক কাজ করেন চা-বাগানে। সাধারণ সময়ের মতো এই সময়ও রোদে পুড়ে, বৃষ্টিতে ভিজে টানা আট ঘণ্টা তাদের কাজ করতে হয়। মজুরির আশায় তারা মাতৃত্বকালীন ছুটিতে না গিয়ে ঝুঁকি নিয়ে কাজ করেন। আর গর্ভকালীন শুরু থেকে শেষ পর্যন্ত টানা কয়েক ঘণ্টা দাঁড়িয়ে পরিশ্রম করায় মা ও গর্ভের সন্তান উভয়ের ক্ষতি হয়। বেশ কয়েকজন নারীশ্রমিকের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, চা-বাগানে কাজ করতে গিয়ে প্রায়ই তাদের গর্ভপাত হয়। অথচ একজন প্রসূতি মায়ের এই সময়ে যে পরিমাণ বিশ্রাম ও সুষম খাদ্য খাওয়া প্রয়োজন, এর কিছুই তাদের কপালে জোটে না।

ফলে প্রসবের সময় এই শ্রমিকদের অনেকের সন্তান প্রতিবন্ধিতা নিয়ে জন্ম নেয়। গান্ধিছড়া চা-বাগানে চলতি বছরের ফেব্রুয়ারিতে দুই গর্ভবতী নারীশ্রমিক রীনা ও বিনতীর সঙ্গে এই প্রতিবেদকের কথা হয়।

তারা জানান, প্রতিদিন সকাল ৮টা থেকে বিকাল ৪টা পর্যন্ত টানা কাজ করার জন্য তাদের নানা ধরনের শারীরিক সমস্যা দেখা দিয়েছে। কিন্তু উপায় না থাকায় কষ্ট সহ্য করে তারা কাজ করছেন। বাংলাদেশ চা-শ্রমিক ইউনিয়নের সাধারণ সম্পাদক রামভজন কৈরী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, দরিদ্র শ্রমিকরা বেশি মজুরির আশায় গর্ভধারণের শেষ সময়ে এসেও ঝুঁকি নিয়ে কাজ করছেন, যাতে ছুটিতে ভালো মজুরি পান। তার মতে, এ সময় চা-বাগানে কর্মরত প্রসূতিদের জন্য একটি নির্দিষ্ট ভাতা প্রণয়ন করা দরকার। আর গর্ভবতীদের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় সংশ্লিষ্টদের সপ্তাহে অন্তত দুই হাজার টাকা অর্থ বরাদ্দ করা উচিত।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর