বৃহস্পতিবার, ৪ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

মেগা প্রকল্প শেষ হচ্ছে না দুই বছরে

কাজে ধীরগতি, আছে অর্থ সংকটও। বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে আগামী বাজেটে

নিজামুল হক বিপুল

মেগা প্রকল্প শেষ হচ্ছে না দুই বছরে

মেগা প্রকল্পের অন্যতম ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে

সরকারের নেওয়া বড় প্রকল্পগুলোর বেশির ভাগেরই কাজ শেষ হচ্ছে না আগামী দুই বছরেও। কাজে ধীরগতি, অর্থ বরাদ্দ না হওয়া ইত্যাদি কারণে আগামী জাতীয় নির্বাচনের আগে এসব প্রকল্পের বেশির ভাগের কাজ শেষ করা সম্ভব হচ্ছে না; যদিও আগামী বাজেটে এসব মেগা প্রকল্পের জন্য অর্থ বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে। ২০০৮ সালের ২৯ ডিসেম্বরের নির্বাচনে নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতা নিয়ে ক্ষমতায় আসে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বাধীন মহাজোট সরকার। ওই সময়ই অগ্রাধিকার প্রকল্প হিসেবে যেগুলো হাতে নেয় তার মধ্যে আছে : পদ্মা সেতু, রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র, মেট্রোরেল, পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর, দোহাজারী-কক্সবাজার রেলপথ নির্মাণ, ঢাকা এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে, কর্ণফুলী টানেল নির্মাণ, মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ প্রকল্প, সোনাদিয়া গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ এবং তরল প্রাকৃতিক গ্যাস টার্মিনাল (এলএনজি) নির্মাণ প্রকল্প অন্যতম। সবচেয়ে বেশি অগ্রাধিকার ছিল পদ্মা সেতু প্রকল্পে। এই বৃহৎ প্রকল্প বাস্তবায়নে বিশ্বব্যাংকের সহযোগিতা নেয় সরকার। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগ তুলে বিশ্বব্যাংক এই প্রকল্প থেকে সরে দাঁড়ায় (বিশ্বব্যাংকের অভিযোগ পরে মিথ্যা প্রমাণিত হয়)। এরপর সরকার নিজস্ব অর্থায়নে প্রকল্প বাস্তবায়ন কাজ শুরু করে। ২৮ হাজার ৭৯৩ কোটি টাকার পদ্মা সেতু প্রকল্প ২০১৮ সালের মধ্যে শেষ করার কথা। প্রকল্পসূত্রে জানা গেছে, ইতিমধ্যে এ প্রকল্পের ৪২ শতাংশ কাজ শেষ হয়েছে। সড়ক পরিবহন ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের রবিবার বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ২০১৮ সালেই পদ্মা সেতুর কাজ শেষ হবে। তিনি বলেন, সেতুতে মোট ৪১টি স্প্যান বসবে। এর মধ্যে ৪টি ইতিমধ্যে চলে এসেছে। বাকিগুলো দ্রুতই চলে আসবে। ওবায়দুল কাদের বলেন, ‘প্রধানমন্ত্রী সাহস দেখিয়েছেন তার সোনালি ফসল আশা করি আমরা ঘরে তুলব।’ তবে সেতুসংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, পদ্মা সেতু প্রকল্পের কাজ ২০১৮ সালের মধ্যে পুরোপুরি শেষ করা সম্ভব হবে না। ২০১৮ সালে যান চলাচলের জন্য সেতু খুলে দেওয়া হবে সত্য, তবে সেতুর অন্যান্য কাজ শেষ করতে আরও সময় লাগবে। এর অন্যতম হচ্ছে এই প্রকল্পে রেলওয়ের অংশ। অবশ্য ২০১৮ সালে এই সেতু দিয়ে কোনোভাবেই ট্রেন চলা সম্ভব হবে না। রেলপথ মন্ত্রণালয় বলছে, ২০১৮ সালে পদ্মাতে ট্রেন চলবে। অবশ্য পদ্মা প্রকল্পের সূত্রগুলো বলছে, সেতু উদ্বোধনের দিন হয়তো সেতুর এক প্রান্ত থেকে অন্য প্রান্তে ট্রেন চালানো যাবে। এর বেশি কিছু হবে না। কারণ রেললাইন নির্মাণের কাজ শেষ হতে আরও দীর্ঘ সময় লাগবে। সূত্র বলছে, পদ্মা সেতুর রেলসংযোগ প্রকল্পে চলতি অর্থবছরে বরাদ্দের পরিমাণ ছিল ৪ হাজার ১০২ কোটি টাকা; যার মধ্যে গত মার্চ পর্যন্ত ব্যয় হয়েছে মাত্র ৪ কোটি টাকা। পদ্মা সেতু রেলসংযোগ প্রকল্পে আগামী অর্থবছরে বরাদ্দ দেওয়া হচ্ছে ৫ হাজার ৬৩ কোটি টাকা। সব মিলিয়ে রেলসংযোগ প্রকল্পটি হচ্ছে ৩৪ হাজার ৯৮৮ কোটি টাকার।

রাজধানীর যানজট নিরসনের লক্ষ্যে সরকার মেট্রোরেলের মতো আরেকটি বড় প্রকল্প হাতে নিয়েছে। এই প্রকল্পের কাজ এখন চলমান হলেও নির্ধারিত সময়ের মধ্যে শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প থেকে মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত এমআরটি-৬ লাইনের কাজ শেষ হওয়ার কথা ২০২২ সালে। তবে ২০১৯ সালের মধ্যেই উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত এই প্রকল্পের একাংশ চালু করার কথা ভাবছে সরকার। বর্তমানে এই প্রকল্পের আওতায় মিরপুরে সেবা খাতের বিভিন্ন লাইন সরানোর কাজ চলছে। মূল কাজ শুরু হতে এখনো অনেক বাকি। মন্ত্রণালয় সূত্র জানিয়েছে, মোট আটটি প্যাকেজের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। আজ প্রকল্পের তিনটি প্যাকেজের চুক্তি হওয়ার কথা। তার পরই দৃশ্যমান কাজ শুরু হবে। তবে ২১ হাজার ৯৮৫ কোটি টাকার এ প্রকল্পের কাজ নির্ধারিত সময়ে শেষ না হওয়ারই সম্ভাবনা বেশি। সড়ক পরিবহন ও মহাসড়ক বিভাগের তথ্যমতে, আটটি প্যাকেজের মাধ্যমে এটি বাস্তবায়ন হচ্ছে। এসব প্যাকেজের দরপত্র মূল্যায়নের কাজ চলছে। চট্টগ্রামের কর্ণফুলী নদীতে টানেল নির্মাণ প্রকল্প হচ্ছে আরেকটি বড় প্রকল্প। সরকারের লক্ষ্য ২০১৮ সালের মধ্যে টানেলের কাজ শেষ করা। কিন্তু এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কোনো কাজই হয়নি। সেতু বিভাগ সূত্রে জানা গেছে, এই টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৯ কিলোমিটার। এর মধ্যে একাধিক লেনবিশিষ্ট মূল টানেলের দৈর্ঘ্য হবে ৩ দশমিক ৪ কিলোমিটার। টানেলটি নির্মাণে ব্যয় হবে প্রায় ৯ হাজার কোটি টাকা। সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, আগামী দুই বছরেও এই প্রকল্পের কাজ শেষ হওয়ার সম্ভাবনা নেই। তবে মন্ত্রণালয়ের একটি সূত্র বলছে, চেষ্টা করা হচ্ছে ২০১৮ সালের মধ্যে অন্তত টানেলের একটি টিউব চালু করার। আরেকটি মেগা প্রকল্প হচ্ছে রূপপুর পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ১ লাখ ১৩ হাজার ৪৫৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পে গত মার্চ পর্যন্ত সরকারের ব্যয় হয়েছে ৪০০ কোটি টাকা। বিজ্ঞান ও প্রযুক্তি মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে, আগামী বছরের শুরুতেই ভারতের বিশেষজ্ঞরা বাংলাদেশে আসবেন। আর আগামী বছরের এপ্রিলে রাশিয়া থেকে পারমাণবিক বিদ্যুৎ কেন্দ্রের উপকরণ আসা শুরু হবে। অর্থাৎ আগামী অর্থবছরে পুরোদমে শুরু হবে এ প্রকল্পের কাজ। তবে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজও খুব বেশি যে শেষ হবে তা বলা যাবে না। রামপাল থারমাল পাওয়ার প্লান্ট হচ্ছে সরকারের অগ্রাধিকার প্রকল্পের অন্যতম। মোট ১৪ হাজার ৫৮৪ কোটি টাকা ব্যয়সাপেক্ষ এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত মোট ৪২০ একর জমি অধিগ্রহণের কাজ সম্পন্ন হয়েছে। মূল বিদ্যুৎ কেন্দ্রের ফেন্সিং কাজও শেষ। স্প্যান প্রটেকশনের কাজ ৯০ শতাংশ শেষ হয়েছে। বর্তমানে প্রি-ফ্যাব্রিকেটেড সাইট অফিস নির্মাণকাজ চলছে। এর আরেকটি মেগা প্রকল্প মাতারবাড়ী কয়লাভিত্তিক বিদ্যুৎ কেন্দ্র। ৩৫ হাজার ৯৮৪ কোটি টাকার এ প্রকল্পের জন্য ভূমি অধিগ্রহণ কাজ শেষ হয়েছে। আগামী জুনের মধ্যে ১৩২/৩৩ কেভি সাবস্টেশন এবং সেপ্টেম্বরের মধ্যে ১৩২ কেভি সঞ্চালন লাইনের নির্মাণকাজ সম্পন্ন হবে। ২০১৩ সালে সরকার পায়রা গভীর সমুদ্রবন্দর প্রকল্প হাতে নেয়। পরে একে অগ্রাধিকারভুক্ত করা হয়। ১ হাজার ১২৮ কোটি টাকার এ প্রকল্পের আওতায় ভূমি অধিগ্রহণ, সংযোগ সড়ক নির্মাণ, অফিস ভবন নির্মাণ, ড্রেজিং কার্যক্রমসহ বেশকিছু কাজ শেষ হয়েছে। সরকারের আরেকটি মেগা প্রকল্প হচ্ছে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত রেললাইন নির্মাণ। এ প্রকল্পের প্রথম পর্যায়ে দোহাজারী থেকে রামু হয়ে কক্সবাজার পর্যন্ত ১০০ দশমিক ৮ কিলোমিটার মূল রেললাইন এবং ৩৯ দশমিক ২ কিলোমিটার লুপ লাইনসহ ১৪০ কিলোমিটার নতুন সিঙ্গেল লাইন ডুয়েল-গেজ ট্র্যাক রেলপথ নির্মাণ প্রকল্প। সংশোধিত ডিপিপি অনুযায়ী এই রেলপথ নির্মাণে ব্যয় হবে ১৮ হাজার ৩৪ কোটি ৪৭ লাখ টাকা। তবে এই প্রকল্পের কাজ আগামী দুই বছরে শেষ হওয়ার কোনো সম্ভাবনা নেই। যদিও ইতিমধ্যে জমি অধিগ্রহণসহ অনেক কাজই শেষ হয়েছে। তার পরও এই প্রকল্পের কাজ শেষ হতে চার থেকে পাঁচ বছর লাগবে বলে রেলসূত্রে জানা গেছে।

রাজধানীকে যানজটমুক্ত করতে বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত এলিভেটেড এক্সপ্রেসওয়ে বা উড়ালসড়ক নির্মাণ প্রকল্প হাতে নেয় সেতু বিভাগ। মহাজোট সরকারের সময় নেওয়া এই প্রকল্পের অগ্রগতিও খুব সামান্য। প্রথম দিকে অর্থের সংস্থান নিয়ে জটিলতা দেখা দেওয়ায় কাজ শুরু হতে বিলম্ব হয়। গত বছর দৃশ্যমান কাজ শুরু হলেও চলছে ধীরগতিতে। ফলে আগামী দুই বছরের মধ্যে এই প্রকল্পের কাজও শেষ হচ্ছে না।

সর্বশেষ খবর