বুধবার, ১০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

আদালতের সঙ্গে উত্তপ্ত বিতর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল

নিজস্ব প্রতিবেদক

আদালতের সঙ্গে উত্তপ্ত বিতর্কে অ্যাটর্নি জেনারেল

সুপ্রিম কোর্টের বিচারক অপসারণ ক্ষমতা জাতীয় সংসদের হাতে দিয়ে করা সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী অবৈধ ঘোষণা করে হাই কোর্টের দেওয়া রায়ের বিরুদ্ধে রাষ্ট্রপক্ষের আপিলের ওপর শুনানিতে গতকাল মঙ্গলবার অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমের সঙ্গে আদালতের উত্তপ্ত বিতর্ক হয়েছে। রাষ্ট্রপক্ষের সময় আবেদন ও আপিল বিভাগের সব বিচারপতির উপস্থিতিতে এ মামলার শুনানি করতে রাষ্ট্রপক্ষের আবেদনকে কেন্দ্র করে এ ঘটনা ঘটে। শুনানির এক পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল নিজেকে মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়া ও আদালতের প্রতি অনাস্থা জানানোর হুমকিও দেন।

জবাবে আদালত বলেছে, এ মামলার সঙ্গে বিচারকদের শৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত। সংবিধানের অভিভাবক হিসেবে বিষয়টি দেখার দায়িত্ব সুপ্রিম কোর্টের। তাই এ বিষয়টি দ্রুত নিষ্পত্তি হওয়া প্রয়োজন। এদিকে কোন কোন সংসদ সদস্য ফৌজদারি অপরাধে জড়িত তার একটি তালিকা দাখিল করতে হাই কোর্টকে নির্দেশ দিতে আপিল বিভাগে আবেদন জানিয়েছেন অ্যাটর্নি জেনারেল। হাই কোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধে জড়িত থাকার বিষয় উল্লেখ থাকার প্রেক্ষাপটে এ আবেদন জানানো হয়েছে। 

প্রধান বিচারপতি সুরেন্দ্র কুমার সিনহার নেতৃত্বে আপিল বিভাগের পাঁচ বিচারপতির বেঞ্চে সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী বিষয়ে মামলার শুনানি চলছে। বেঞ্চের অপর চার বিচারপতি হলেন— বিচারপতি মো. আবদুল ওয়াহাব মিঞা, বিচারপতি মোহাম্মদ ইমান আলী, বিচারপতি হাসান ফয়েজ সিদ্দিকী ও বিচারপতি মির্জা হোসেইন হায়দার। গতকাল ছিল শুনানির দ্বিতীয় দিন। শুনানির শুরুতেই রাষ্ট্রপক্ষ পৃথক দুটি আবেদন দাখিল করে। একটি আবেদনে আপিল বিভাগের সব বিচারপতির (বর্তমানে সাতজন) উপস্থিতিতে শুনানির আরজি জানানো হয়। এ জন্য শুনানি দুই সপ্তাহ মুলতবি রাখার আবেদন জানানো হয়। আরেকটিতে হাই কোর্টের প্রতি নির্দেশনা জারির আবেদন জানিয়ে বলা হয়, হাই কোর্টের রায়ে বলা হয়েছে যে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড আছে। কোন কোন সংসদ সদস্যের বিরুদ্ধে ফৌজদারি অপরাধের রেকর্ড আছে তার তালিকা হাই কোর্ট দাখিল করুক। গতকাল আদালতে রাষ্ট্রপক্ষে আইনজীবী ছিলেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম ও অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা। রিট আবেদনকারীপক্ষে ছিলেন অ্যাডভোকেট মনজিল মোরসেদ। এ ছাড়া অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে ড. কামাল হোসেন, ড. আবদুল ওয়াদুদ ভুইয়া, ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম, অ্যাডভোকেট এম আই ফারুকী উপস্থিত ছিলেন। শুনানিতে প্রধান বিচারপতি বলেন, বিচারকদের বিরুদ্ধে অভিযোগ তদন্তের বিষয়টি জাতীয় সংসদের হাতে নাকি সুপ্রিম জুডিশিয়াল কাউন্সিলের হাতে থাকা উচিত তা নির্ধারণ হওয়া দরকার। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনি তো আগামী জানুয়ারি পর্যন্ত আছেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, এ মামলার সঙ্গে বিচারকদের শৃঙ্খলার বিষয়টি জড়িত। এক্ষেত্রে কোনো শূন্যতা থাকতে পারে না। দ্রুত বিষয়টি নিষ্পত্তি হওয়া দরকার।

এ পর্যায়ে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘এটা ঠিক। কিন্তু আপিল বিভাগে এখন বিচারপতির সংখ্যা সাতজন। সবাই এ মামলা শুনবেন— এটাই আমার আবেদন। কিন্তু শুনছেন পাঁচজন। এভাবে বিচার চললে আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হব।’ তিনি বলেন, ‘আপনারা বলেছেন যে সবাই শুনবেন। আজ তা শুনছেন না। সাতজনকে শুনতে বলায় ভুল কোথায়?’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি আদালতকে খাটো করে (আন্ডার মাইন্ড) দেখছেন।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘তা করছি না। আমাদের আবেদন, হাই কোর্টের রায়ে সংসদ সদস্যদের বিরুদ্ধে কিছু মন্তব্য করা হয়েছে...।’  প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘বৈরী কিছু থাকলে সেটা আমরা দেখব।’  অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রায়ে অনেক কথা আছে।’ এ সময় বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিয়া বলেন, ‘এখনো তো মামলা শুনলামই না।’  প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি শুনানি বিলম্বিত করছেন।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমাদের আরেকটি আবেদন আছে। পৃথিবীর কোনো দেশেই বিচার বিভাগ (হাই কোর্টের রায় প্রসঙ্গে) এভাবে কথা বলতে পারে না। আমি অসহায়। এভাবে শুনানি অব্যাহত রাখলে ন্যায়বিচার হবে না। শুনানিতে অংশ নিতে আমাকে বাধ্য করবেন না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি আদালতকে এমন পর্যায়ে নিয়ে যাচ্ছেন যে আপনি নিজেই বিপদে পড়বেন।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনি কি আমাকে ভয় দেখাচ্ছেন? গতকাল বলেছেন যে সবাই শুনবেন। কিন্তু তাতো দেখছি না। আমরা তো আদালতকে সহযোগিতা করতে চাই।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘হাইকোর্টের রায় উপস্থাপন করতে সমস্যা কোথায়? আপনি লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করুন।’ অ্যাটর্নি জেনারেল রায় উপস্থাপন না করে আগের মতোই একই কথা বলতে থাকেন। এসময় প্রধান বিচারপতি একাধিকবার বলেন, ‘আপনি পিড়াপিড়ি করছেন কেন?’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আপনি বলেছিলেন যে সাতজনই শুনবেন। কিন্তু এখন তা শুনছেন না। আমি তো বলেছি, মে মাসেই শুনানি শেষ হয়ে যাবে। কিন্তু এভাবে হলে তো আমি এ মামলা থেকে নিজেকে প্রত্যাহার করতে বাধ্য হব।’ এরপরও প্রধান বিচারপতি রায় উপস্থাপন করতে বললে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘রায় উপস্থাপন করব। তবে আমাকে সময় দিতে হবে।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমরা আগে বলেছিলাম লিখিত যুক্তিতর্ক প্রস্তুত করে তা দাখিল করতে। আপনার দপ্তরে ১৫৫ জন আইন কর্মকর্তা আছেন। এটা প্রস্তুত করতে এতো সময় লাগবে কেন?’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘দুই সপ্তাহ সময় চেয়েছি। এই সময় দিলে আকাশ ভেঙে পড়বে না। আশা করছি, এ সময়ের মধ্যে উনারা (বিচারপতি নাজমুন আরা সুলতানা ও বিচারপতি সৈয়দ মাহমুদ হোসেন ) ফিরে আসবেন।’  প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আপনি হাইকোর্টে শুনানি করেছেন। আপনার সব মনে থাকার কথা।’ এটর্নি জেনারেলকে উদ্দেশ করে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা বলেন, ‘আপনি আদালতের প্রধান আইন কর্মকর্তা। তাই মামলা থেকে প্রত্যাহার করে নেওয়ার কথা বলা ঠিক হয়নি।’  অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘আমি নিরুপায় হয়ে বলেছি। আপনারা যখন পাঁচজন শুনবেন বলেছেন, তখন এটা বলেছি।’ এরপর অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল মুরাদ রেজা পেপারবুক থেকে পড়া শুরু করেন। তাঁর বক্তব্য উপস্থাপন শেষ হলে প্রধান বিচারপতি অ্যাটর্নি জেনারেলের দৃষ্টি আকর্ষণ করে বলেন, ‘আপনারা কি বিভক্ত রায়ের মধ্যে একজন যে (ডিসেন্টিং অংশ) রায় দিয়েছেন তা সমর্থন করেন?’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘কী অবান্তর প্রশ্ন! আমরা এসেছি মেজোরিটির বিরুদ্ধে। মাইনরিটি এখানে আলোচ্য বিষয় নয়।’ প্রধান বিচারপতি হাসতে হাসতে বলেন, ‘আপনি খুব চালাক।’ জবাবে অ্যাটর্নি জেনারেলও হাসতে হাসতে বলেন, ‘তবু ভালো যে আপনি আমাকে ধুরন্দর বলেননি।’  এ পর্যায়ে প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘গতকাল (সোমবার) সিনিয়র আইনজীবী টি এইচ খান উপস্থিত ছিলেন। আজ ড. কামাল হোসেন, এমআই ফারুকী আছেন। আমরা আশা করি, আপনারা (রাষ্ট্রপক্ষ) লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করবেন।’ এ পর্যায়ে ড. কামাল হোসেন দাঁড়িয়ে বলেন, ‘আমি লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করেছি।’ এসময় ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ও ড. আবদুল ওয়াদুদ ভুইয়া অ্যামিকাস কিউরি হিসেবে লিখিত যুক্তিতর্ক দাখিল করেন। প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আশা করি, বাকি যারা আছেন তারাও দাখিল করবেন।’ এরপর প্রধান বিচারপতি আগামী রবিবার (১৪ মে) পরবর্তী শুনানির দিন ধার্য করেন। অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, আপনারা ন্যায়বিচারের স্বার্থে অপরাপর সকল মামলায় সকল কিছু যুক্ত করেছেন বা করে থাকেন। এ মামলায় সেটা করছেন না কেন? আমরা তো দুই সপ্তাহ সময় দেওয়ার আবেদন করছি।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, এখানে বিচারকদের শৃংখলার বিষয়টি জড়িত। এটার দায়িত্ব আদালত নেবে নাকি আপনারা (সংসদ) নেবেন, তার সুরাহা হওয়া দরকার। সুপ্রিম কোর্ট সংবিধানের অভিভাবক। আমাদেরকে একদিকে যেতে হবে। এভাবে চলতে পারে না। এরপর আদালত আগামী ২১ মে বেলা সাড়ে ১১টা পর্যন্ত শুনানি মূলতবি করেন। এরপর অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, ‘করজোড়ে বলছি, সবাইকে নিয়ে শুনানি করুন।’

প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘সবাইকে নিয়ে শুনতে হবে এমন শর্ত দেওয়া যায় না। একজন বিচারপতি অসুস্থ থাকতে পারেন। একজন বিদেশে থাকতে পারেন। একজন তো জুলাইয়ে অবসরে যাবেন। কেউ জুলাই পর্যন্ত অসুস্থ থাকতে পারেন। সব পরিস্থিতি বিবেচনা করেই প্রধান বিচারপতিকে আদালত চালাতে হয়।’

এ পর্যায়ে বিচারপতি আবদুল ওয়াহহাব মিঞা এটর্নি জেনারেলকে বলেন, ‘আপনি আবেদন জানাতে পারেন। চাপিয়ে দিতে পারেন না।’ প্রধান বিচারপতি বলেন, ‘এ মামলায় আমরা সকলকে যুক্ত করার চেষ্টা করছি।’

অ্যাটর্নি জেনারেলের ব্রিফিং : গতকাল আদালতের কার্যক্রম শেষ হওয়ার পর দুপুরে নিজ কার্যালয়ে অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম সাংবাদিকদের বলেন, হাইকোর্ট বিভাগ রায়ে একটি জায়গায় বলেছেন, সংসদ সদস্যদের মধ্যে একটা বিরাট অংশের বিরুদ্ধে ক্রিমিনাল রেকর্ড আছে। আমরা একটি আবেদন দিয়ে বলেছি, কারা অপরাধের সঙ্গে যুক্ত তাদের তালিকা হাইকোর্টের কাছে চাওয়া হোক। আদালত বলেছেন, এটা শুনানির সময় বা রায়ের সময় দেখবেন। তিনি বলেন, ‘দুজন বিচারপতি এ শুনানিতে অনুপস্থিত আছেন। তাদের উপস্থিতিতে অর্থাৎ সকল বিচারপতিই যেন এ শুনানিতে থাকেন— আগে থেকেই এটা বলে আসছি। কারণ এটা সাংবিধানিক ব্যাপার। কিন্তু দুইজন ছাড়াই শুনানি চলছে। একারণে তাঁদের ফিরে না আসা পর্যন্তু সময় চেয়ে আরেকটি আবেদন দিয়েছি। আমি বলেছি, সবাইকে যদি যুক্ত না করেন তাহলে এ মামলা থেকে নিজকে প্রত্যাহার করার চিন্তাও করতে পারি।’ অ্যাটর্নি জেনারেল বলেন, গত তারিখে প্রধান বিচারপতি বলেছিলেন সব বিচারপতিকে যুক্ত করেই এ মামলাটি শুনবেন। কিন্তু আজ উনি (প্রধান বিচারপতি) বললেন যে পাঁচজনই শুনবেন। তখন আমি বললাম, এটা হলে আমি অনাস্থা দিতে বাধ্য হব। তিনি বলেন, কোনো বিচারক যদি অসুস্থ থাকেন, কোনো বিচারক যদি অপারগতা প্রকাশ করতেন সেক্ষেত্রে তো আমাদের কিছু করার নেই। আমি বলতে চাচ্ছি, বিষয়টি সাংবিধানিক। যেহেতু দুটি কোর্ট ভেঙে একটি কোর্টে বিষয়টি শুনানি হচ্ছে, এখানে সবাইকে যুক্ত করতে হবে। আমার মূল বক্তব্য হলো সব বিচারপতিকে যুক্ত করা। আপনারা সবাই মুক্তমনে জিনিসটি শুনবেন।

সংবিধানের ১৬তম সংশোধনী অবৈধ বলে হাইকোর্টের দেওয়া রায় প্রকাশের পর তা চূড়ান্ত নিষ্পত্তির জন্য রিট আবেদনকারীপক্ষে গত বছর ২৮ নভেম্বর আপিল বিভাগে আবেদন করা হয়। পরদিন আপিল বিভাগ ওই আবেদনের ওপর ৫ জানুয়ারি শুনানির দিন ধার্য করে। এরপর থেকে রাষ্ট্রপক্ষে কয়েক দফা করা সময় আবেদনে বারবার শুনানি পিছিয়ে যায়। শেষ পর্যন্ত ৮ মে থেকে শুনানি শুরু হয়। গতকাল ছিল শুনানির দ্বিতীয় দিন।

সর্বশেষ খবর