বুধবার, ১০ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভ্যাটের শঙ্কা ভোটে

চিন্তিত সরকার, প্রধানমন্ত্রীর দিকনির্দেশনা আসছে কাল ভ্যাট কমে ১২ শতাংশ হচ্ছে, ব্যবসায়ীরা চান ১০

রুহুল আমিন রাসেল

এবার নতুন মূল্য সংযোজন কর—মূসক বা ভ্যাট আইন নিয়ে গভীর চিন্তায় পড়েছে সরকার। সব পণ্যের ওপর ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের প্রভাবে ভোক্তাদের পাল্টা আঘাত আগামী সংসদ নির্বাচনের ভোটে পড়ার শঙ্কাও দেখা দিয়েছে। বিএনপি যখন নির্বাচনে আসছে, তখন এই উচ্চহারে ভ্যাট আরোপকে ‘মড়ার উপর খাঁড়ার ঘা’ হিসেবেই নয়, চক্রান্তও মনে করছেন সরকারসংশ্লিষ্টরা। এ প্রসঙ্গে অর্থনীতি সমিতির সাধারণ সম্পাদক ড. জামাল উদ্দিন আহমেদ গতকাল বাংলাদেশ   প্রতিদিনকে বলেন, আগামী বছর সংসদ নির্বাচনের আগে কোনো ধরনের ষড়যন্ত্র ও চক্রান্তে পা দেওয়া উচিত হবে না সরকারের। ভ্যাট আইন বাস্তবায়ন ও হার নির্ধারণের বিষয়টি সরকারের রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমলারা এই রাজনৈতিক হিসাব করেন না। কিন্তু সরকার যেহেতু জনগণের রাজনীতি করে, তাই জনগণের স্বার্থে ভ্যাটের হার কমিয়ে সরকারকে বুদ্ধিমত্তার পরিচয় দিতে হবে। ব্যবসায়ী-শিল্পপতিদের শীর্ষ সংগঠন বাংলাদেশ শিল্প ও বণিক সমিতি ফেডারেশন—এফবিসিসিআইর প্রথম সহসভাপতি শফিউল ইসলাম মহিউদ্দিন বলেন, ‘জাতীয় রাজস্ব বোর্ড—এনবিআর ভ্যাট আইন ব্যবসাবান্ধব না করে চাপিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করছে। এ চেষ্টা প্রতিরোধে ব্যবসায়ীরা ঐক্যবদ্ধ। আমি স্পষ্টভাবে বলতে চাই, যত চক্রান্তই থাকুক না কেন, ব্যবসায়ীদের সঙ্গে যে সাত দফা লিখিত সমঝোতা হয়েছে, তার স্পষ্ট সুরাহা না করে ভ্যাট আইন কার্যকর করতে দেওয়া হবে না।’ প্রধানমন্ত্রী ও অর্থমন্ত্রীর ওপর আস্থা রাখার কথা উল্লেখ করে তিনি আরও বলেন, ‘ওই দফা করা হয় ২০১৪ সালে। এখন ২০১৭ সাল। এই তিন বছরের মূল্যস্ফীতি বিবেচনায় নিয়ে টার্নওভার ট্যাক্সে পরিবর্তন আনতে হবে।’ জানা গেছে, আগামীকাল বৃহস্পতিবার নতুন ভ্যাট ও সম্পূরক শুল্ককর আইন নিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা সংশ্লিষ্টদের নতুন দিকনির্দেশনা দিতে যাচ্ছেন। এই দিকনির্দেশনায় ২০১৭-১৮ অর্থবছরে ১৫ শতাংশের পরিবর্তে ভ্যাটের হার ১২ থেকে ১৩ শতাংশ হতে পারে বলে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে নিশ্চিত করেছেন আওয়ামী লীগ সভাপতির উপদেষ্টা ও এফবিসিসিআইর সাবেক দুই সভাপতি। তারা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেছেন, প্রধানমন্ত্রীকে ব্যবসায়ী সমাজের পক্ষ থেকে সমস্যাসমূহ বিশদভাবে তুলে ধরা হয়েছে। প্রধানমন্ত্রী এই সমস্যাসমূহ এবং এর ঘাত-প্রতিঘাত কী হতে পারে, তা গভীরভাবে উপলব্ধি করেছেন। এসব সমস্যা সমাধান করে প্রধানমন্ত্রী নতুন ভ্যাট আইন আগামী ১ জুলাই থেকে বাস্তবায়নের দিকনির্দেশনা দেবেন। ব্যবসায়ী ও অর্থনীতিবিদের মতে, ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের সিদ্ধান্ত অর্থনীতির জন্য আত্মঘাতী। যেখানে দক্ষিণ এশিয়ার কোনো দেশে ১৫ শতাংশ ভ্যাট আদায়ের নজির নেই, সেখানে বাংলাদেশে এত উচ্চহারে ভ্যাট আদায় হলে বিদ্যুৎসহ নিত্যপণ্যের দাম বাড়বে। ভয়াবহ সংকটে পড়বে জনগণ। শিল্প কারখানা বন্ধ ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নৈরাজ্য সৃষ্টি হতে পারে। কনজুমার অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ—ক্যাব সভাপতি গোলাম রহমান বলেন, ‘সকল প্রকার নিত্যপ্রয়োজনীয় জিনিসপত্রের দাম যাতে না বাড়ে এবং কোনোভাবেই যাতে ভোক্তাস্বার্থ ক্ষুণ্ন না হয়, সে বিষয়টি বিবেচনায় নিয়েই সরকারের নতুন ভ্যাট বাস্তবায়ন করা উচিত। আমাদের দাবি নিত্যপণ্য ভ্যাটমুক্ত রাখা হোক।’ জানা গেছে, আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিল—আইএমএফের ‘একটি শর্তযুক্ত ঋণ কর্মসূচি’র চাপে সরকার বাধ্য হয়ে তৈরি করে ভ্যাট আইন, ২০১২। আর্থ-সামাজিক বাস্তবতাবিবর্জিত এই আইনটি তৈরি করার সঙ্গে সঙ্গে ব্যবসায়ীরা ঘোরতর আপত্তি জানিয়েছেন। তারা বলছেন, নতুন ভ্যাট আইন জনবিরোধী। এ আইনের কোনো দরকার নেই। প্রচলিত আইনে যে অসংগতি আছে, তা সংশোধন করাই শ্রেয়। এমনকি ব্যবসায়ীদের দেওয়া বেশকিছু সুপারিশও আমলে নিচ্ছে না এনবিআর। যদিও এনবিআর ও ব্যবসায়ীদের সমন্বয়ে গঠিত একটি যৌথ কমিটি এই সুপারিশমালা তৈরি করেছে। সরকার গঠিত এই কমিটির চেয়ারম্যান ছিলেন এনবিআরের সাবেক সদস্য আলী আহমাদ ও এফবিসিসিআইর সাবেক প্রথম সহসভাপতি জসিম উদ্দিন। ওই কমিটির ১০টি সুপারিশের ১টিতে বলা হয় : নতুন আইনের ১৫ (৩) ধারায় সকল ক্ষেত্রে ১৫ শতাংশ একক হারে ভ্যাট আরোপ করা হয়েছে। অর্থাৎ কোনো ভোক্তা পর্যায়ের ক্রেতা বা জনসাধারণ যে পণ্য কিনবেন, তাতে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাট যুক্ত হবে। এই ধারায় আপত্তি জানিয়ে কমিটির সুপারিশে বলা হয় : উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণে অসমর্থ প্রতিষ্ঠানের করযোগ্য সরবরাহের ক্ষেত্রে সরকার কর্তৃক হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপের বিধান আইনে অন্তর্ভুক্ত করা হোক। হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট প্রদানকারী এবং টার্নওভার কর প্রদানকারী উপকরণ কর রেয়াত গ্রহণ করতে পারবেন না। এই সুপারিশের পক্ষে যুক্তি তুলে ধরে বলা হয় : সকল করযোগ্য আমদানি ও সরবরাহের ক্ষেত্রে অভিন্ন হারে ১৫ শতাংশ ভ্যাটের বিধান করা হয়েছে। কিন্তু অনেক উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশেও একাধিক হ্রাসকৃত হারে এবং বহুস্তরে ভ্যাট হার বহাল আছে। বিদ্যুৎ বিতরণ, নির্মাণ সংস্থা সেবায় বর্তমানে ৫ ও ৫ দশমিক ৫ শতাংশ ভ্যাট প্রযোজ্য আছে। এ ছাড়া এমএস পণ্যসহ অন্যান্য কিছু খাতে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপিত আছে। তাই বাংলাদেশের বাস্তব অর্থনৈতিক কাঠামোর প্রেক্ষাপটে ১৫ শতাংশ হারে ভ্যাটের পরিবর্তে হ্রাসকৃত হারে ভ্যাট আরোপের সুপারিশ করা হয়েছে। বর্তমানের সংকুচিত ভিত্তিমূল্য এবং ট্যারিফ মূল্যের বিকল্প হিসেবে উন্নত ও উন্নয়নশীল দেশে প্রচলিত ব্যবস্থার আলোকে এই সুপারিশ করা হয়েছে।

ওই সুপারিশ বাস্তবায়নে এনবিআরের সঙ্গে ব্যবসায়ীরা বার বার বৈঠক করলেও, তাতে বিন্দুমাত্র কর্ণপাত করেনি এনবিআর। বরং ব্যবসায়ীদের দাবি উপেক্ষা করে ১৮ এপ্রিল নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নে পরিপত্র জারি করেছে এনবিআর।

জানা গেছে, অর্থমন্ত্রী এনবিআরকে নির্দেশ দিয়েছিলেন ব্যবসায়ীদের সঙ্গে সমঝোতার ভিত্তিতে নতুন ভ্যাট আইন বাস্তবায়নের। সে অনুযায়ী ২০১৪ সালে যৌথ কমিটি এবং গত বছরের ৫ সেপ্টেম্বর কোর ওয়ার্কিং কমিটি গঠন করা হয়। এ দুটি কমিটি বেশ কয়েকটি ইস্যুতে ঐকমত্যে পৌঁছায়। কিন্তু এখন পর্যন্ত একটি সুপারিশও বাস্তবায়ন করেনি এনবিআর। এমনকি ভ্যাটের সমস্যা সমাধানে প্রধানমন্ত্রীর নির্দেশনাও আমলে নিচ্ছে না এনবিআর।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর