বৃহস্পতিবার, ১১ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতায় ভারসাম্য চান খালেদা

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রীর একক ক্ষমতায় ভারসাম্য চান খালেদা

ক্ষমতায় গেলে প্রধানমন্ত্রীর ‘একক ক্ষমতায়’ ভারসাম্য আনতে চান বিএনপি চেয়ারপারসন বেগম খালেদা জিয়া। গতকাল বিকেলে রাজধানীর হোটেল ওয়েস্টিনে ‘ভিশন-২০৩০’ নামের রূপকল্প ঘোষণায় এ কথা বলেন সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, ‘বিদ্যমান সাংবিধানিক কাঠামোয় প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতা এককভাবে প্রধানমন্ত্রীর ওপর ন্যস্ত। সংসদীয় সরকার পদ্ধতিতে এটা স্বীকৃত রীতির পরিপন্থী। প্রধানমন্ত্রীর একক নির্বাহী ক্ষমতা সংসদীয় সরকারের আবরণে একটি স্বৈরাচারী ও একনায়কতান্ত্রিক শাসনের জন্ম দিয়েছে। বিদ্যমান অবস্থার অবসানে সংবিধানে প্রয়োজনীয় সংশোধনী এনে প্রজাতন্ত্রের নির্বাহী ক্ষমতায় ভারসাম্য আনা হবে।’

দলের স্থায়ী কমিটির সদস্যদের আপত্তির মুখে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্টের ঘোষণা থেকে সরে আসেন বিএনপি চেয়ারপারসন। এর আগে কাউন্সিলে সংক্ষিপ্ত ভিশনে বেগম জিয়া প্রতিশ্রুতি দেন, ক্ষমতায় গেলে দ্বিকক্ষবিশিষ্ট পার্লামেন্ট ব্যবস্থা চালু করা হবে। সেই অবস্থান থেকে সরে এসে তিনি এবার বললেন, সংবিধানের এককেন্দ্রিক চরিত্র অক্ষুণ্ন রেখে বিদ্যমান সংসদীয় ব্যবস্থা সংস্কারের অংশ হিসেবে জাতীয় সংসদের উচ্চকক্ষ প্রতিষ্ঠা করার বিষয়ে পরীক্ষা-নিরীক্ষা করা হবে।

সংবাদ সম্মেলনে ঘণ্টাব্যাপী বক্তব্যে ‘ভিশন ২০৩০’-এর সংক্ষিপ্ত সারসংক্ষেপ তুলে ধরেন খালেদা জিয়া। বিকাল ৪টা ৫০ মিনিটে শুরু করা এ সংবাদ সম্মেলন চলে টানা সন্ধ্যা ৬টা ৫২ মিনিট পর্যন্ত। এই সময়ে খালেদা জিয়া টানা লিখিত বক্তব্য পড়ে শোনান। রূপকল্পটি বই আকারে প্রকাশ করা হয়। ৪১ পৃষ্ঠার রূপকল্প বাংলা ও ইংরেজি এই দুই ভাষায় প্রকাশ করা হয়। পরে তা গণমাধ্যমকর্মী ও কূটনীতিকদের কাছে হস্তান্তর করা হয়।

খালেদা জিয়া তার রূপকল্পে ২৫৬টি দফা উল্লেখ করেন। রূপকল্পে তিনি বলেন, বিএনপি ক্ষমতায় গেলে গণভোট ব্যবস্থা ফিরিয়ে আনা হবে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ‘বিতর্কিত’ ৫৭ ধারা বাতিল করা হবে। দেশকে ২০৩০ সালের মধ্যে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করা হবে। মাথাপিছু আয় হবে ৫০০০ মার্কিন ডলার। ডাকসুসহ সব বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রসংসদ নির্বাচন দেওয়া হবে। বিএনপির শিক্ষানীতি হবে জীবনমুখী, ডিগ্রিমুখী নয়। সন্ত্রাসবাদ, উগ্রবাদ ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে।

বিএনপি-প্রধান বলেন, প্রশাসনিক স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে সংবিধান অনুযায়ী ন্যায়পাল সৃষ্টি করা হবে। শিক্ষিত বেকারদের ভাতা দেওয়া হবে। বাতিল করা হবে বিশেষ ক্ষমতা আইন, ১৯৭৪। বিচারব্যবস্থা সংস্কারে উচ্চপর্যায়ের জুডিশিয়াল কমিশন গঠন করা হবে। সরকারি-বেসরকারি ব্যাংকে রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হবে। শিক্ষার মান উন্নয়নে জাতীয় শিক্ষা টিভি চালু করা হবে। ছেলে-মেয়েদের স্নাতক বা সম্মান পর্যায়ে উপবৃত্তি দেওয়া হবে। সবার জন্য স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করতে পর্যায়ক্রমে স্বাস্থ্যবিমা চালু করা হবে। ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ উৎপাদনের উদ্যোগ নেওয়া হবে। ক্ষমতায় গেলে সাংবিধানিক সংস্কারের ঘোষণা দেন তিনি। অতিরিক্ত ডিউটি পালনে পুলিশসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর সদস্যদের জন্য ওভারটাইম ফি চালু করা হবে। সরকারি কর্মকর্তা-কর্মচারীদেরও বেতন বাড়ানো হবে। প্রতিবেশী রাষ্ট্র ভারতকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘সীমান্তের বাইরে আমাদের বন্ধু আছে, প্রভু নেই।’

নির্বাচনকালীন সহায়ক সরকারের মাধ্যমে ক্ষমতায় এসে এ রূপকল্প বাস্তবায়ন করবেন বলে প্রতিশ্রুতি দেন বেগম জিয়া। তিনি বলেন, ‘নির্বাচনের মাধ্যমে সরকার গঠন করে আমাদের এই ভিশন-২০৩০ বাস্তবায়ন করা হবে ইনশা আল্লাহ।’ গণতন্ত্রের চিত্র তুলে ধরে রূপকল্পে বিএনপি চেয়ারপারসন বলেন, ‘জনগণ মহান মুক্তিযুদ্ধের মাধ্যমে যে রাষ্ট্র গড়ে তুলেছিল, আজ সে রাষ্ট্রের  মালিকানা তাদের হাতে  নেই। তাই দেশের জনগণের হাতেই দেশের মালিকানা ফিরিয়ে দেওয়া হবে। সংবিধানে গণভোট ব্যবস্থা পুনঃপ্রবর্তন করে জনগণের গণতান্ত্রিক অধিকার পুনঃস্থাপন করা হবে। দুনীতির সঙ্গে বিএনপি কোনো আপস করবে না।’

রূপকল্প উপস্থাপনের শেষ পর্যায়ে এসে সাবেক এই প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমরা যে ভিশন উপস্থাপন করলাম, তা অর্জন কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আমরা লড়াই করে দেশ স্বাধীন করেছি। এ দেশকে উন্নত ও মর্যাদাবান দেশে পরিণত করা আমাদের সবার পবিত্র দায়িত্ব। আমরা আশা করি, এই রূপকল্প বাস্তবায়নে আমরা দেশবাসীর সক্রিয় সমর্থনের পাশাপাশি উন্নয়ন-সহযোগী রাষ্ট্র ও প্রতিষ্ঠানসমূহেরও সহযোগিতা পাব।’ দলমত-নির্বিশেষে সব নাগরিক ‘ভিশন ২০৩০’ বাস্তবায়নে সক্রিয় সমর্থন জানাবেন বলে প্রত্যাশা ব্যক্ত করেন বিএনপি চেয়ারপারসন।

২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশ করার প্রতিশ্রুতিও দেন বিএনপি চেয়ারপারসন। রাপকল্পে তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশে অর্থনৈতিক বৈষম্য তীব্র থেকে তীব্রতর হচ্ছে। বিএনপি দরিদ্রবান্ধব ও সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধিতে বিশ্বাসী। প্রবৃদ্ধির হারকে বৃদ্ধি করে সুফলের সুষম বণ্টনের মাধ্যমে বিএনপি ধনী-দরিদ্রের বৈষম্য দূর করা হবে। আমরা ২০৩০ সালের মধ্যে বাংলাদেশকে একটি আধুনিক, গণতান্ত্রিক উচ্চ-মধ্যম আয়ের দেশে পরিণত করতে চাই। এ সময়ের মধ্যে মাথাপিছু আয় ৫০০০ মার্কিন ডলারে উন্নীত করা হবে। এর জন্য বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ডবল ডিজিটে উন্নীত করা হবে।’

সংবাদ সম্মেলনে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর, স্থায়ী কমিটির সদস্য খন্দকার মোশাররফ হোসেন, ব্যারিস্টার মওদুদ আহমদ, তরিকুল ইসলাম, ব্যারিস্টার জমিরউদ্দিন সরকার, লেফটেন্যান্ট জেনারেল (অব.) মাহবুবুর রহমান, এম কে আনোয়ার, মির্জা আব্বাস, গয়েশ্বর চন্দ্র রায়, ব্যারিস্টার রফিকুল ইসলাম মিয়া, নজরুল ইসলাম খান, আমীর খসরু মাহমুদ চৌধুরী প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।  জামায়াত ছাড়া ২০-দলীয় জোটের নেতাদের দেখা গেছে। আমন্ত্রণ জানালেও অন্য কোনো রাজনৈতিক দলের নেতাদের দেখা যায়নি।

এ ছাড়া ফ্রান্সের রাষ্ট্রদূত, ভারত, যুক্তরাজ্য, ইন্দোনেশিয়া, সৌদি আরব, মালয়েশিয়া, স্পেন, দক্ষিণ কোরিয়া, চীন, ভ্যাটিকান সিটি, জার্মানি, ইরান প্রভৃতি দেশের কূটনীতিকরা উপস্থিত ছিলেন। সিনিয়র সাংবাদিকদের মধ্যে শওকত মাহমুদ, সোহরাব হাসান, তৌফিক ইমরোজ খালিদী, জ ই মামুন, আনিস আলমগীর প্রমুখ উপস্থিত ছিলেন।

রূপকল্পে খালেদা জিয়া বলেন, ‘বিএনপি ক্ষমতায় গেলে জাতীয় স্বার্থ সমুন্নত রেখে মত প্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকার সুরক্ষিত করে একটি উদার গণতান্ত্রিক সমাজ বিনির্মাণ করা হবে। বিএনপি ‘‘ওয়ানডে ডেমোক্রেসিতে’’ বিশ্বাসী দল নয়। সে জন্য নিত্যদিনের জন-আকাঙ্ক্ষাকে মর্যাদা দিয়ে নাগরিকদের সম্পৃক্ত করেই আগামী দিনে রাষ্ট্র পরিচালনা করা হবে। কোনো মত ও বিশ্বাস যত সংখ্যালঘিষ্ঠই হোক না কেন, তাকে অমর্যাদা না করার নীতিতে বিএনপি দৃঢ় অঙ্গীকারবদ্ধ।’

তিনি বলেন, ‘বাংলাদেশের স্বাধীনতা, সার্বভৌমত্ব ও রাষ্ট্রীয় মর্যাদা অক্ষুণ্ন রাখতে বিএনপি দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। বিএনপি অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ এবং অন্য কোনো রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করবে না। একইভাবে অন্য কোনো রাষ্ট্রও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং বাংলাদেশের রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় হুমকির সৃষ্টি করলে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। আমাদের সীমান্তের বাইরে বাংলাদেশের বন্ধু রয়েছে, কোনো প্রভু নেই। এ ছাড়া বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে বাংলাদেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রধান্য দেওয়া হবে।’

বেগম জিয়া বলেন, আওয়ামী লীগ ২০০৯ সালে ক্ষমতায় আসার পর সংবিধানের পঞ্চদশ ও ষষ্ঠদশ সংশোধনীর মাধ্যমে গণভোট ব্যবস্থা বাতিল, নির্বাচনকালীন তত্ত্বাবধায়ক সরকার ব্যবস্থা বাতিল, সংসদ বহাল রেখে জাতীয় সংসদ নির্বাচন অনুষ্ঠানের বিধান প্রবর্তন, সংবিধানের কিছু বিষয় সংযোজন, পরিবর্তন, প্রতিস্থাপন, রহিতকরণ এবং সংবিধানের কতিপয় ধারা-উপধারা সংশোধনের অযোগ্য করার বিধান প্রবর্তন, উচ্চ আদালতের বিচারকদের অভিশংসনের ক্ষমতা জাতীয় সংসদের ওপর ন্যস্তকরণের বিধানসহ কয়েকটি অগণতান্ত্রিক বিধান প্রণয়ন করেছে। বিএনপি এসব বিতর্কিত ও অগণতান্ত্রিক বিধানাবলি পর্যালোচনা ও পুনঃপরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সাংবিধানিক সংস্কার করবে।’ 

জাতীয় সংসদকে সব জাতীয় কর্মকাণ্ডের কেন্দ্রবিন্দুতে পরিণত করা হবে বলে জানিয়ে তিনি বলেন, ‘জাতীয় স্বার্থ সম্পর্কিত বিষয়ে বিরোধী দলসমূহের সঙ্গে আলোচনা করা হবে। পাবলিক অ্যাকাউন্টস কমিটি এবং পাবলিক আন্ডারটেইকিংস কমিটির সভাপতিত্ব বিরোধী দলের সদস্যদের ওপর অর্পণ করা হবে। সাম্য, মানবিক মর্যাদা ও সামাজিক ন্যায়বিচার প্রতিষ্ঠা করার কাঙ্ক্ষিত লক্ষ্যে জাতিকে পৌঁছাতে সুনীতি, সুশাসন ও সু-সরকারের সমন্বয় ঘটাবে বিএনপি।’

রূপকল্পে চট্টগ্রামে বঙ্গোপসাগরে একটি গভীর সমুদ্রবন্দর নির্মাণ করে একে একটি ‘রিজিওনাল হাব’ হিসেবে গড়ে  তোলা, সার্ক ও আসিয়ানভুক্ত দেশসমূহের সঙ্গে রেল ও সড়ক যোগাযোগের উদ্যোগ এবং চীনের ‘ওয়ান বেল্ট- ওয়ান রোড’ উদ্যোগে সংযুক্ত হওয়ার ব্যবস্থা নেওয়ার কথা উল্লেখ করেন বিএনপি-প্রধান। একই সঙ্গে দ্বিতীয় যমুনা সেতু, পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া প্রান্তে দ্বিতীয় পদ্মা সেতু, ব্রহ্মপুত্র সেতু, বুড়িগঙ্গা, মেঘনা, গোমতী ও কর্ণফুলী নদীর ওপর আরও সেতু নির্মাণ করা হবে। ‘একনিক ট্যুরিজম’ ও ‘ওয়াটার ট্যুরিজম’ চালু করা হবে।

তিনি বলেন, পুলিশের ওপর বিচার বিভাগের তদারকি নিশ্চিত করে জবাবদিহি ও কল্যাণমূলক জনপ্রশাসন গড়ে  তোলা হবে। আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর ওপর রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ করা হবে। তথ্যপ্রযুক্তি আইনের বিতর্কিত ৫৭ ধারা বাতিল করা হবে। বিএনপি সৎ সাংবাদিকতার পরিবেশ পুনরুদ্ধার করবে এবং চাঞ্চল্যকর সাগর-রুনি হত্যাসহ সব সাংবাদিক হত্যার বিচার নিশ্চিত করা হবে। একই সঙ্গে সাংবাদিকদের বিরুদ্ধে রাজনৈতিক সব মিথ্যা মামলা প্রত্যাহার করা হবে। প্রিন্ট, ইলেকট্রনিক ও অনলাইন মিডিয়ার জন্য মুক্তচিন্তা ও গণতান্ত্রিক চেতনার সঙ্গে সংগতিপূর্ণ একটি নীতিমালা প্রণয়নে সুপ্রিম কোর্টের একজন সাবেক বিচারপতির নেতৃত্বে এবং বিশিষ্ট শিক্ষাবিদ, বিশিষ্ট নাগরিক, আইটি বিশেষজ্ঞ ও অভিজ্ঞ সাংবাদিকদের সমন্বয়ে একটি কমিশন গঠন করা হবে।

বিএনপি-প্রধান বলেন, সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও উগ্রবাদের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা গ্রহণ করা হবে। বিএনপি বাংলাদেশের ভূখণ্ডের মধ্যে কোনো রকম সন্ত্রাসবাদী তত্পরতাকে বরদাশত করবে না এবং সন্ত্রাসবাদীকে আশ্রয়-প্রশ্রয় দেবে না। একই সঙ্গে সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জাতীয় ঐক্য গঠন এবং আন্তধর্মীয় সংলাপকে উৎসাহিত করবে।

প্রতিরক্ষা বাহিনীকে আধুনিক প্রশিক্ষণ, প্রযুক্তি ও সমর-সম্ভারে সুসজ্জিত, সুসংগঠিত, যুগোপযোগী ও সর্বোচ্চ  দেশপ্রেমের মন্ত্রে উজ্জীবিত করে গড়ে তোলা হবে বলে জানান সাবেক প্রধানমন্ত্রী। তিনি বলেন, প্রতিরক্ষা বাহিনীর প্রয়োজনীয় উন্নয়ন ও সমপ্রসারণ করা হবে। জাতীয় উন্নয়নমূলক কর্মকাণ্ড ও আন্তর্জাতিক শান্তি রক্ষায় প্রতিরক্ষা বাহিনীর অংশগ্রহণ উৎসাহিত করা হবে।

বৈদেশিক নীতি প্রসঙ্গে বেগম জিয়া বলেন, বিএনপি অন্য কোনো রাষ্ট্রের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে হস্তক্ষেপ ও অন্য কোনো রাষ্ট্রের জন্য নিরাপত্তা সমস্যা সৃষ্টি করবে না। একইভাবে তারা (বিএনপি) দৃঢ় অঙ্গীকার করছে যে, অন্য কোনো রাষ্ট্রও বাংলাদেশের অভ্যন্তরীণ ব্যাপারে হস্তক্ষেপ এবং রাষ্ট্রীয় নিরাপত্তায় হুমকি সৃষ্টি করলে শক্ত প্রতিরোধ গড়ে তোলা হবে। বৈদেশিক সম্পর্কের ক্ষেত্রে দেশের জাতীয় স্বার্থকে সর্বোচ্চ প্রাধান্য দেওয়া হবে। মুসলিম উম্মাহ ও প্রতিবেশী দেশসমূহের সঙ্গে বিশেষ সম্পর্ক গড়ে তুলবে বিএনপি। ?মুক্তিযোদ্ধাদের রাষ্ট্রীয় সম্মানিত নাগরিক হিসেবে ঘোষণা করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের তালিকা প্রণয়নের নামে দুর্নীতির অবসান ঘটিয়ে একটি স্বচ্ছ প্রক্রিয়ার মাধ্যমে প্রকৃত মুক্তিযোদ্ধাদের সঠিক তালিকা প্রস্তুত করা হবে। মুক্তিযোদ্ধাদের ভাতা বৃদ্ধি এবং এই ভাতা ব্যবস্থাপনাকে দুর্নীতি ও ত্রুটিমুক্ত করা হবে।

তিনি বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে বার্ষিক প্রবৃদ্ধির হার ডাবল ডিজিটে উন্নীত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে। আর্থিক প্রতিষ্ঠানসমূহে শৃঙ্খলা আনতে কেন্দ্রীয় ব্যাংকের স্বায়ত্তশাসন, ক্ষমতা ও তদারকি নিবিড় এবং শক্তিশালী করা হবে। ব্যাংক কার্যক্রম পরিচালনায় রাজনৈতিক হস্তক্ষেপ বন্ধ এবং অর্থ মন্ত্রণালয়ের ব্যাংকিং ডিভিশন বিলুপ্ত করে রাষ্ট্রায়ত্ত ব্যাংকসমূহ পরিচালনা ও তদারকির ভার কেন্দ্রীয় ব্যাংকের হাতে ন্যস্ত করা হবে।

এ ছাড়া এক দশকের মধ্যে নিরক্ষরতা দূর করা, শিক্ষা খাতে জিডিপির ৫ শতাংশ অর্থ ব্যয়, প্রতিটি জেলায় একটি করে স্মার্ট স্কুল প্রতিষ্ঠা, শিক্ষা সমপ্রসারণে জাতীয় টিভিতে পৃথক একটি চ্যানেল চালু, নেতৃত্ব তৈরি লক্ষ্যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়সহ সব বিশ্ববিদ্যালয় ও উচ্চশিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ছাত্রসংসদের নির্বাচন নিশ্চিত করা হবে। প্রবাসীদের  ভাটার তালিকায় অন্তর্ভুক্ত করা হবে। নির্বাচন কমিশন, দুর্নীতি দমন কমিশন, পাবলিক সার্ভিস কমিশন, মানবাধিকার কমিশন, আইন কমিশন ও বিশ্ববিদ্যালয় মঞ্জুরি কমিশনের মতো সাংবিধানিক ও আধাসাংবিধানিক প্রতিষ্ঠানগুলো দুর্নীতি, অনিয়ম, দলীয়করণ মুক্ত করা হবে। স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা নিশ্চিত করতে ‘ন্যায়পাল’ পদ ও কার্যালয় সক্রিয় করা হবে। দ্রুত সময়ে সর্বজনীন স্বাস্থ্যসেবা নিশ্চিত করা হবে।

বেগম জিয়া বলেন, বেকার যুবক-যুবতীর জন্য নতুন নতুন কর্মসংস্থানের সৃষ্টি করা হবে। এক বছরব্যাপী অথবা কর্মসংস্থান না হওয়া পর্যন্ত, যেটা আগে হবে, শিক্ষিত বেকারদের বেকার ভাতা প্রদান করা হবে। আন্তর্জাতিক নদীর পানির ন্যায্য হিস্যা আদায়ে বিএনপি আঞ্চলিক ও পারস্পরিক সহযোগিতার মনোভাব নিয়ে আলাপ-আলোচনার উদ্যোগ নেবে। প্রয়োজনে শক্তিশালী কুটনৈতিক উদ্যোগও গ্রহণ করা হবে।

খালেদা জিয়া বলেন, ২০৩০ সালের মধ্যে ৩৫ হাজার মেগাওয়াট বিদ্যুৎ চাহিদা বিবেচনায় নিয়ে প্রয়োজনে আঞ্চলিক সহযোগিতা কাঠামো গড়ে তোলা হবে। জ্বালানি ও বিদ্যুৎ সংকট নিরসনে একটি সমন্বিত জাতীয় জ্বালানি নীতি প্রণয়ন করা হবে। অস্বচ্ছ প্রক্রিয়ায় কুইক রেন্টাল বিদ্যুেকন্দ্র স্থাপনের মাধ্যমে যে সীমাহীন দুর্নীতি ও অনৈতিক দায়মুক্তি দেওয়া হয়েছে, এর জন্য ইলেকট্রিসিটি অ্যান্ড এনার্জিস র্যাপিড সাপ্লাই ইনক্রিজ অ্যাক্ট, ২০১০ পুনঃপরীক্ষা করে প্রয়োজনীয় সংশোধন করা হবে। বাংলাদেশে জ্বালানি নিরাপত্তা নিশ্চিত করার জন্য বাংলাদেশকে পারস্য উপসাগরীয় দেশসমূহ ইরান ও মধ্য এশিয়ার দেশসমূহ এবং পাকিস্তান ও ভারতের আন্তদেশীয় গ্যাস পাইপলাইনে সংযুক্ত করার উদ্যোগ নেওয়া হবে।

তিনি বলেন, দল-মত ও জাতি-ধর্ম-বর্ণ নির্বিশেষে ক্ষুদ্র-বৃহৎ সব জাতিগোষ্ঠীর সংবিধান প্রদত্ত সামাজিক, রাজনৈতিক, অর্থনৈতিক ও ধর্মকর্মের অধিকার এবং জীবন, সম্ভ্রম ও সম্পদের পূর্ণ নিরাপত্তা বিধান করা হবে। প্রত্যেক ধর্মাবলম্বীকে নিজ নিজ ধর্ম পালনের পূর্ণ অধিকার ভোগ করবেন। কাউকে কোনো নাগরিকের ধর্মবিশ্বাসে আঘাত করার সুযোগ দেওয়া হবে না। ধর্ম যার যার, রাষ্ট্র সবার। সামপ্রদায়িক সমপ্রীতি বিনষ্টের সব অপচেষ্টা কঠোরভাবে দমন করা হবে। পাহাড়ি ও সমতলের ক্ষুদ্র জাতিগোষ্ঠীর জীবন, সম্পদ, সম্ভ্রম ও মর্যাদা সুরক্ষা করা হবে। বস্তি, চরাঞ্চল, হাওর-বাঁওড় এবং মঙ্গাপীড়িত ও উপকূলীয় অঞ্চলের অনগ্রসর জনমানুষের জীবনমান উন্নয়নে বিশেষ কর্মসূচি গ্রহণ করা হবে।

সর্বশেষ খবর