সোমবার, ১৫ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

এত জামায়াত শিবির গেল কোথায়

শফিকুল ইসলাম সোহাগ

এত জামায়াত শিবির গেল কোথায়

সরকারবিরোধী আন্দোলনে বিগত ৫ জানুয়ারি সংসদ নির্বাচনের আগে ও পরে জামায়াত-শিবির ছিল দৃশ্যমান। ঝটিকা মিছিল নিয়ে বিভিন্ন স্থানে তাদের নাশকতামূলক তৎপরতা লক্ষ্য করা যায়। বিএনপি জোটের হরতাল-অবরোধ কর্মসূচিতে তারা ছিল অগ্রভাগে। কিন্তু হঠাৎ ‘উধাও’ জামায়াত-শিবিরের নেতা-কর্মীরা। এখন আর তাদের কোথাও দেখা যায় না। প্রকাশ্যে নেই রাজপথের কোনো কর্মসূচি। কমে গেছে ঝটিকা মিছিল। মানবতাবিরোধী অপরাধে জড়িত থাকায় প্রথম দিকে দু-একজন নেতার ফাঁসি কার্যকর হলে হরতালে নেতা-কর্মীদের মাঠে নামতে দেখা যায়। তবে পরবর্তী সময়ে হরতালগুলোতেও নেতা-কর্মীরা ছিলেন নিষ্ক্রিয়। রাজনৈতিক পর্যবেক্ষক মহলের প্রশ্ন, ‘এত জামায়াত-শিবির নেতা-কর্মী গেল কোথায়!’

সংশ্লিষ্টরা জানান, হত্যা মামলাসহ বিভিন্ন নাশকতার মামলা থেকে নিজেদের বাঁচাতে এ সরকারের দুই মেয়াদে অন্তত ২০ হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। বড় নেতা থেকে শুরু করে স্থানীয় নেতাদের হাত ধরেই তারা আওয়ামী লীগে যোগ দেন। আবার নেতা-কর্মীদের একটি বড় অংশ হয় কারাগারে, না হয় পলাতক অবস্থায় রয়েছেন। জঙ্গিবাদ বা উগ্রপন্থায় জড়াচ্ছে একটি অংশ। একইভাবে বিএনপির বিভিন্ন পর্যায়ের কমিটিতেও জায়গা করে নিয়েছে ক্ষুদ্র একটি অংশ। ঝুঁকি এড়াতে একটি অংশ চলে গেছে দেশের বাইরে। আরেকটি অংশ আওয়ামী লীগ-বিএনপির সঙ্গে গোপনে আঁতাত করে ব্যবসা-বাণিজ্য চালিয়ে যাচ্ছে। সরকারি দলের নেতাদের ধরে শিবিরের একটি অংশ চাকরি নিয়ে এখন ব্যস্ত সময় কাটাচ্ছে।

বাংলাদেশের সংসদীয় রাজনীতিতে ১৯৭৯ সালে সংসদ নির্বাচনে ইসলামী ডেমোক্রেটিক লীগ নামে অংশ নিয়ে জামায়াত ২০টি আসনে বিজয়ী হয়। ১৯৯১ সালে জামায়াত নামে দলটি সংসদে ১৮টি আসন পায়। এরপর ১৯৯৬ সালে তিনটি, ২০০১ সালে ১৬টি এবং ২০০৮ সালে দুটি আসন পায়। সর্বশেষ স্থানীয় সরকার নির্বাচনে, বিশেষ করে পৌরসভা, উপজেলা ও ইউনিয়ন পরিষদেও জামায়াতের বেশ কিছু জনপ্রতিনিধি জয়লাভ করেন। বছরখানেক আগেও জামায়াত-শিবির কর্মীদের রাজপথে দেখা গেছে। এখন প্রকাশ্যে দেখা মেলে না তাদের। এমনকি দলটির আমির, সেক্রেটারি জেনারেলের মৃত্যুদণ্ডাদেশ কার্যকরের পরও সরব হয়নি সংগঠনটি। জামায়াত-সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এটা তাদের নতুন কৌশল। এ কারণেই আত্মগোপনে থেকে ‘সংবাদ বিজ্ঞপ্তি’র মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাকছে দলীয় কার্যক্রম। এর মধ্যে সন্ত্রাসী সংগঠন হিসেবে দলটির নিবন্ধন বাতিল করা হয়েছে। ফাঁসি হয়েছে দলের সাবেক আমির মতিউর রহমান নিজামী, সাবেক সেক্রেটারি জেনারেল আলী আহসান মোহাম্মাদ মুজাহিদ, দুই সহকারী সেক্রেটারি জেনারেল আবদুল কাদের মোল্লা ও মুহাম্মদ কামারুজ্জামান এবং কেন্দ্রীয় শূরা সদস্য মীর কাসেম আলীর। জামায়াতের সিনিয়র নায়েবে আমির দেলাওয়ার হোসাইন সাঈদীর রিভিউ আবেদনের শুনানি চলছে। এ ছাড়া সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগে বিচারাধীন রয়েছে জামায়াত নেতা আবদুস সুবহান এবং এ টি এম আজহারুল ইসলামের মামলা। এরা দুজনই ট্রাইব্যুনালে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত। ভেঙে পড়েছে দলটির চেইন অব কমান্ড। জেলের বাইরে থাকা নেতা-কর্মীরা লাপাত্তা। জানা যায়, ঢাকাসহ সারা দেশেই জামায়াত ও শিবিরের কার্যালয়গুলোতে তালা ঝুলছে। রাজধানীর বড় মগবাজারে জামায়াতে ইসলামীর কেন্দ্রীয় কার্যালয়ে এখন সুনসান নীরবতা। কয়েক বছর ধরে সংগঠনটির কোনো নেতা-কর্মীকে দেখা যায়নি কার্যালয়ে। কার্যালয়ের সামনে এক ঝালমুড়ি বিক্রেতা বলেন, ‘এখানে কী কাজে আসবেন নেতারা? সাদা পোশাকের পুলিশ ঘোরাফেরা করে। কাউকে পেলেই ধরে সোজা কারাগারে পাঠিয়ে দেবে। তাই ভয়ে কেউ আসেন না।’ এ ছাড়া জামায়াতের ‘শ্রমিক কল্যাণ ফেডারেশন’ ও ‘চাষী কল্যাণ সমিতি’ নামে দুটি অঙ্গসংগঠন রয়েছে। এ দুটির অবস্থাও নাজুক। এ ছাড়া জামায়াতের আদর্শে বিশ্বাসী ছাত্রশিবির ও ছাত্রী সংস্থার অবস্থাও করুণ। এ দুটি সংগঠনের কার্যালয়েও ঝুলছে ঢাউস তালা। এটি অবশ্য জামায়াতের অঙ্গ বা সহযোগী সংগঠন নয়। জামায়াতে ইসলামীর আমির মকবুল আহমাদ সম্প্রতি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এক সাক্ষাৎকারে সম্প্রতি বলেছেন, ‘আমাদের সব অফিস বেআইনিভাবে বন্ধ করে রাখা হয়েছে। সরকারকে অঘোষিত নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহার করে তালা খুলে দেওয়াসহ পুলিশি হয়রানি বন্ধ করতে হবে। আমরা নিয়মতান্ত্রিক কার্যক্রম আগের মতোই চালু করতে চাই। আমাদের নির্বাচনী প্রস্তুতিও রয়েছে। জামায়াতকে নির্বাচনের জন্য আলাদা প্রস্তুতি নিতে হয় না।’ এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, ‘জঙ্গিবাদের বিরুদ্ধে জামায়াতের জিরো টলারেন্স অবস্থানকে অত্যন্ত স্পষ্টভাবে জাতির সামনে তুলে ধরা হয়েছে। আর “জঙ্গিবাদ, জঙ্গিবাদ” বলে যারা অন্যের ওপর দোষ চাপায়, তারাই জঙ্গিবাদের পৃষ্ঠপোষক ও আশ্রয়দাতা।’ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সূত্র জানায়, সর্বশেষ জামায়াতের অর্থের জোগানদাতা মীর কাসেমের ফাঁসির রায় কার্যকর করার সময় থেকেই অদৃশ্য হয়ে যায় জামায়াত-শিবির ক্যাডাররা। ফাঁসির রায় কার্যকরের বিরুদ্ধে হরতাল আহ্বান করা হলেও মাঠে দেখা যায়নি তাদের কোনো তৎপরতা। অথচ এর আগে সরকারবিরোধী দেশব্যাপী সহিংস কর্মসূচিতে তারাই ছিলেন অগ্রভাগে। নাশকতার মামলায় আসামি হওয়ার কারণে শিবির ক্যাডারদের গ্রেফতারের জন্য খোঁজ করেও তাদের হদিশ পায়নি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী। তবে ক্যাডারদের খোঁজে এখনো তৎপর গোয়েন্দা সংস্থাগুলো। সূত্রমতে, দেশে থাকা জামায়াতের নেতা-কর্মীরা এখন সরকারি দলের নেতাদের সঙ্গে সমঝোতাসহ নানাভাবে কৌশল করে এগোচ্ছেন। এ পরিস্থিতির মধ্যেও বড় অংশের নেতা-কর্মীরা টিকে আছেন ছদ্মবেশে। নিজেদের রক্ষার তাগিদেই নেতা-কর্মীরা ভিন্ন ভিন্ন কৌশল নিয়েছেন। রংপুর, গাইবান্ধা, সাতক্ষীরা, ঝিনাইদহ, চাঁপাইনবাবগঞ্জ, কুমিল্লা, চট্টগ্রামের সীতাকুণ্ড, রাজশাহী, কক্সবাজারসহ প্রতিটি জেলা সদরে জামায়াত-শিবিরের নামিদামি ব্যবসাপ্রতিষ্ঠানের মালিক জামায়াত-সংশ্লিষ্টরা। যৌথ মূলধনের ভিত্তিতে গড়ে ওঠা এসব ব্যবসা টিকিয়ে রাখতে সরকারদলীয়দের আড়ালে আশ্রয় নিচ্ছেন তারা। সেসব প্রতিষ্ঠানে সরকারি দলের প্রভাবশালীদের নিয়োগ দেওয়া হচ্ছে। জানা যায়, বর্তমান সরকারের দুই মেয়াদে জামায়াতে ইসলামীর প্রায় ২০ হাজার নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দিয়েছেন। ১৯৭১ সালে মানবতাবিরোধী কর্মকাণ্ডের অভিযোগে আওয়ামী লীগ নেতৃত্বাধীন গত মেয়াদের মহাজোট সরকার জামায়াতে ইসলামীর রাজনীতি নিষিদ্ধের পক্ষে কথা বলেছে। আর এখন সেই দলটিরই নেতা-কর্মীদের ‘সাদরে গ্রহণ’ আওয়ামী লীগের নিবেদিতপ্রাণ বহু নেতা-কর্মীকে ভীষণ অস্বস্তিতে ফেলেছে। দশম জাতীয় সংসদ নির্বাচনের মাত্র চার দিন আগে কুষ্টিয়ায় জেলা জামায়াতের রোকন নওশের আলী দল বদল করেন। ২০১৩ সালের ৩১ ডিসেম্বর যুবলীগ আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে তিনি জামায়াত ছেড়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। এর পর থেকেই দেশে বিভিন্ন স্থানে জামায়াত-বিএনপি নেতাদের দল বদলের হিড়িক পড়ে যায়। একপর্যায়ে সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ভিন্ন দল থেকে আওয়ামী লীগে না ভেড়াতে নির্দেশ দিয়ে বলেন, ‘জামায়াত-বিএনপি থেকে আওয়ামী লীগে নয়। আওয়ামী লীগের কর্মী-সমর্থক যথেষ্ট আছে।’ এ নির্দেশনা অমান্য করে জেলা-উপজেলায় জামায়াত-শিবিরের নেতাদের দলে ভেড়ান কেন্দ্রীয় নেতা, এমপি ও মন্ত্রীরা। চট্টগ্রাম-১৫ (সাতকানিয়া-লোহাগাড়া) আসনের এমপি মাওলানা আবু রেজা মোহাম্মদ নেজামুদ্দিন নদভী জামায়াত নেতা নূর আহমেদকে সোনাকানিয়া ইউনিয়নে আওয়ামী লীগের প্রার্থী করেন। এর আগে পৌরসভা নির্বাচনের সময় জামায়াত নেতা ওসমান গনি চৌধুরী ও সাতকানিয়া পৌর বিএনপি নেতা মাহমুদুর রহমানকে আওয়ামী লীগে যোগদান করিয়েছেন এমপি নদভী। চাঁপাইনবাবগঞ্জ পৌরসভার ৯ নম্বর ওয়ার্ড কাউন্সিলর ও জামায়াত নেতা আফজাল হোসেন পিন্টু আওয়ামী লীগে আনুষ্ঠানিকভাবে যোগ দেন। তার বিরুদ্ধে ১২টি মামলায় অভিযোগপত্র দাখিল করা হয়েছে। নানা সময়ে চাঁপাইনবাবগঞ্জের বিভিন্ন এলাকায় জামায়াতেরই সহস্রাধিক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। সংবাদ সম্মেলন করে জয়পুরহাটের পাঁচবিবি উপজেলা জামায়াতের মজলিশে শূরার সদস্য আবদুস সালামের নেতৃত্বে পাঁচ শতাধিক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদানের ঘোষণা দেন। রাজশাহীর বাগমারায় আওয়ামী লীগ নেতাদের হাতে ফুল দিয়ে উপজেলা জামায়াতের সাবেক সেক্রেটারি, ভবানীগঞ্জ মাদ্রাসার সহকারী অধ্যাপক মাওলানা নুরুল ইসলাম শতাধিক সমর্থক নিয়ে আওয়ামী লীগে যোগ দেন। কুমিল্লার নাঙ্গলকোটে বাঙ্গগড্ডা ইউনিয়নের ৪ নম্বর ওয়ার্ড জামায়াতের সেক্রেটারি মাওলানা আবুল কাসেমের নেতৃত্বে বেশ কিছু নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। গাজীপুরের টঙ্গীতে স্থানীয় জামায়াত নেতা মাওলানা শরীফ হোসাইনের নেতৃত্বে দুই শতাধিক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগ দেন। মৌলভীবাজারের কমলগঞ্জ ইউনিয়ন জামায়াতের নেতা সাব্বিরুল হক তালুকদার শামীমের নেতৃত্বে অর্ধশতাধিক নেতা-কর্মী আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। এ ছাড়া গোপালগঞ্জ জেলা জামায়াতের সহকারী সেক্রেটারি ইসমাইল হোসাইন জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি এম এ নাসির আহমেদ ও সাধারণ সম্পাদক মেজবাউদ্দিনের হাত ধরে আওয়ামী লীগে যোগ দেন।

সর্বশেষ খবর