শুক্রবার, ২৬ মে, ২০১৭ ০০:০০ টা

রাজনীতিকীকরণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে না

নিজস্ব প্রতিবেদক

রাজনীতিকীকরণে স্থানীয় সরকার ব্যবস্থা শক্তিশালী হবে না

রেহমান সোবহান

দেশবরেণ্য অর্থনীতিবিদ সেন্টার ফর পলিসি ডায়ালগের (সিপিডি) চেয়ারম্যান অধ্যাপক রেহমান সোবহান বলেছেন, রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করা যাবে না। তিনি আরও বলেন, স্থানীয়   সরকারব্যবস্থাকে রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে জনগণের আস্থা অর্জন করাটা যৌক্তিক কিনা ভেবে দেখতে হবে। স্থানীয় সরকারব্যবস্থা নিয়ে আরও প্রশ্ন রেখে তিনি বলেন, স্থানীয় পর্যায়ে মানুষের জীবনযাত্রার মান উন্নয়ন। বাল্যবিয়ে প্রতিরোধসহ অন্যসব উন্নয়নমূলক কাজ কেন তৃতীয় পক্ষের মাধ্যমে করতে হয়? এটা কেন সরকার নিজ থেকে করতে পারে না? স্থানীয় সরকার সব সময়ই ছিল, ব্রিটিশ ও পাকিস্তান আমলে এটা ইউনিয়ন বোর্ড নামে ছিল। এখন শুধু নামটা পাল্টেছে, এটা কোনো নতুন বিষয় নয়। স্থানীয় সরকারব্যবস্থার মূল সমস্যাটা বুঝতে হবে এবং সমস্যা সমাধানে সে অনুযায়ী সরকারের সংস্থাগুলোকে এগিয়ে আসতে হবে। সম্প্রতি বাংলাদেশে সব ধরনের স্থানীয় নির্বাচন দলীয়ভাবে সম্পন্ন করায় তিনি এমন প্রশ্ন তুলেছেন। গতকাল রাজধানীর ব্র্যাক সেন্টার ইনে আয়োজিত সামাজিক আস্থা, স্থানীয় সরকার এবং এসডিজি অর্জন শীর্ষক এক গোলটেবিল আলোচনায় এমন প্রশ্ন তোলেন তিনি। বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থা ব্র্যাক ও দি হাঙ্গার প্রজেক্ট যৌথভাবে এ অনুষ্ঠানের আয়োজন করে। তিনি বলেন, ভারতের পশ্চিমবঙ্গে পঞ্চায়েতি ক্যাডারব্যবস্থা প্রতিষ্ঠিত করে ৪৫ বছর রাজ্য শাসন করেছিল কংগ্রেস। কিন্তু কেন্দ্রীয় সরকার গঠনে তারা ব্যর্থ হয়। ফলে রাজনীতিকীকরণের মাধ্যমে স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে কতটা শক্তিশালী করা যাবে, জনপ্রতিনিধিরা জনগণের আস্থা কতটা অর্জন করতে পারবেন তা নিয়ে প্রশ্ন থেকেই যায়। রেহমান সোবহানের সভাপতিত্বে আলোচনায় অন্যদের মধ্যে বক্তব্য দেন ইউএনডিপির কান্ট্রি ডিরেক্টর সুদীপ্ত মুখার্জি, সাবেক স্থানীয় সরকার সচিব ড. তোফায়েল আহমেদ, দি হাঙ্গার প্রজেক্টের কান্ট্রি ডিরেক্টর ড. বদিউল আলম মজুমদার, ব্র্যাকের কমিউনিটি এমপাওয়ারমেন্ট প্রোগ্রামের পরিচালক আন্না মিনজ্। এ ছাড়া স্থানীয় সরকার বিশেষজ্ঞসহ ইউনিয়ন পরিষদের শতাধিক চেয়ারম্যান ও সদস্য উন্মুক্ত আলোচনায় অংশ নিয়ে তাদের মতামত ও কাজের অভিজ্ঞতা শেয়ার করেন।

স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে রাজনীতিকীকরণ না করা, সততা নিয়ে কাজ করাসহ তারা বেশকিছু সুপারিশও দেন। তারা বলেন, রাজনৈতিক শক্তির কাছে সামাজিক আস্থা প্রায়ই পরাজিত হয়। ফলে টেকসই উন্নয়ন লক্ষ্যমাত্রা অর্জনে সংশয় প্রকাশ করেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা।

সুদীপ্ত মুখার্জি বলেন, স্থানীয় সরকারব্যবস্থাকে শক্তিশালী করতে হলে জনগণের মধ্যে সচেতনতা বাড়াতে হবে। উদাহরণ টেনে বলেন, ‘আমি দেখেছি সোমালিয়ায় ইবোলা দুর্যোগ মোকাবিলায় সবচেয়ে ভূমিকা রেখেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা। তারা সহযোগিতা না করলে এ দুর্যোগ মোকাবিলা করা অত্যন্ত কঠিন হতো।’

এ সময় হাঙ্গার প্রজেক্টের স্থানীয় সরকারকে দক্ষ করে তোলার প্রকল্পকে আরও দীর্ঘায়িত ও টেকসই করা যাবে কিনা, মূল প্রবন্ধের এমন প্রশ্নের বিষয়ে অনুষ্ঠানের সঞ্চালক ড. দেবপ্রিয় ভট্টাচার্য বলেন, স্থানীয় সরকার শক্তিশালী ও দক্ষ করে গড়ে তোলার দায়িত্ব তৃতীয় পক্ষের হতে পারে না। শুধু হাঙ্গার প্রজেক্টের মতো তৃতীয় পক্ষগুলোর সারা দেশের স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করার দায়িত্ব নয়। তারা অল্প পরিসরে কাজ করে কিছু মডেল তৈরি করতে পারে। সেই মডেল ফলপ্রসূ হলে সরকার তা গ্রহণ করতে পারে। সেই মডেল বাস্তবায়ন করে স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী করতে পারে। এজন্য দীর্ঘ মেয়াদে স্থানীয় সরকারকে দক্ষ ও শক্তিশালী করার জন্য সরকারকে এসব প্রকল্পে যুক্ত হতে হবে।

এ ছাড়া স্থানীয় সরকারকে শক্তিশালী ও দক্ষ করতে হলে স্থানীয় সব প্রকল্পে তাদের যুক্ত থাকতে হবে। এর জন্য দেশের বিদ্যমান আইনের হালনাগাদ দরকার। তিনি বলেন, বর্তমানে স্থানীয় শক্তি ও রাজনৈতিক শক্তির মধ্যে দ্বন্দ্বের বিষয়ে আলোচনা হচ্ছে। এর সঙ্গে আর্থিক দ্বন্দ্বের বিষয়টি নিয়ে আসতে হবে। স্থানীয় সরকার শক্তিশালীকরণে ত্রিপক্ষীয় সমন্বয় যেমন দরকার তেমন তিনটি শক্তির সমন্বয়েরও দরকার বলে মনে করেন তিনি। তবে স্থানীয় সরকারকেও সততা ও আস্থার বিষয়টি প্রমাণ করতে হবে। তাদের সততা ও দক্ষতা দিয়ে সাধারণ মানুষের মধ্যে আস্থা তৈরি করতে পারলে রাজনৈতিক চাপ উপেক্ষা করেও কিছু কাজ করা সম্ভব। সে ক্ষেত্রে স্থানীয় প্রতিনিধিকে তেমন ব্যক্তিত্বের অধিকারী হতে হবে বলে মনে করেন তিনি।

মূল প্রবন্ধে বদিউল আলম মজুমদার বলেন, ‘আমরা মনি করি এসডিজির ১৭টি অভীষ্টের মধ্যে ১৬ নম্বর অভীষ্ট অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। যাতে বলা হয়েছে, টেকসই উন্নয়নের জন্য শান্তিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক সমাজ প্রতিষ্ঠা করা, সবার জন্য ন্যায়বিচারপ্রাপ্তির পথ সুগম করা এবং সর্বস্তরে কার্যকর জবাবদিহিপূর্ণ ও অন্তর্ভুক্তিমূলক প্রতিষ্ঠান গড়ে তোলা। এসব অভীষ্ট বাস্তবায়ন করতে পারে স্থানীয় সরকার। কেননা আমাদের সংবিধান সামাজিক ও অর্থনৈতিক উন্নয়নের গুরুত্বপূর্ণ দায়িত্ব দিয়েছে স্থানীয় সরকারকে। বিশেষত জনগণের দোরগোড়ায় প্রতিষ্ঠান ইউনিয়ন পরিষদকে। শুধু অভীষ্ট ১৬ নয়; দারিদ্র্য, শিক্ষা সমস্যা, অপর্যাপ্ত স্বাস্থ্যসেবা ও পরিবেশ বিপর্যয়ের আন্তসম্পর্কিত চ্যালেঞ্জ মোকাবিলায় এসডিজির অন্তত ১২টি অভীষ্ট বাস্তবায়নে প্রয়োজন সার্বিক ও সমন্বিত উন্নয়ন কৌশল।’

সর্বশেষ খবর