বৃহস্পতিবার, ৮ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

সবার চোখ বাঙালি প্রার্থীদের দিকে, আজ ব্রিটেনে নির্বাচন

আ স ম মাসুম, যুক্তরাজ্য

সবার চোখ বাঙালি প্রার্থীদের দিকে, আজ ব্রিটেনে নির্বাচন

টিউলিপ সিদ্দিকী, রুশনারা আলী, রুপা হক

সন্ত্রাসী হামলার পর শোকের মধ্যেই জাতীয় নির্বাচনের শেষ দিনের প্রচারে ব্যস্ত সময় কাটিয়েছেন যুক্তরাজ্যের প্রধানমন্ত্রী তেরেজা মে ও বিরোধীদলীয় লেবার দলের প্রধান জেরমি করবিন। আজ ব্রিটেনের জাতীয় নির্বাচন। এবারের নির্বাচনে বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী, রূপা হক, টিউলিপ সিদ্দিকসহ মোট ১৪জন বাংলাদেশি প্রার্থী হয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে। সবার দৃষ্টি এই প্রার্থীদের দিকে। তবে নির্বাচনের আগের দিন সর্বশেষ জনমত জরিপে দেখা গেছে দুই প্রধান দলই কাছাকাছি অবস্থান করছে।

মধ্যবর্তী নির্বাচন ঘোষণার সময় লেবার পার্টির সঙ্গে লেবারের জনপ্রিয়তার ব্যবধান ছিল ২৪ শতাংশ। গত এক মাসে নানা ঘটনা, প্রতিশ্রুতির মারপ্যাঁচে এই ব্যবধান কমে দাঁড়িয়েছে ১ শতাংশে! ঈর্ষণীয় জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পেয়েছে লেবার নেতা জেরেমি করবিনের। আর এই দল থেকেই বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলী, রূপা হক, টিউলিপ সিদ্দিক প্রতিদ্বন্দ্বিতা করছেন। দেশটির তরুণ ভোটারদের একটি বড় অংশ জেরেমি করবিনের প্রতি তাদের সমর্থন জানিয়েছেন। তাই নির্বাচন বিশ্লেষকদের ধারণা, মূলধারার জরিপ সব জায়গাই ঝুলন্ত সরকারের কথা বলা হচ্ছে। ৬৫০ আসনের ব্রিটিশ পার্লামেন্টে সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেতে কমপক্ষে ৩২৬টি আসন পেতে হবে। ফলে ঝুলন্ত সরকার হলে লেবারকে সামনে রেখেই করা হবে বলেও বলছেন অনেকে। কার্যত মাসখানেক আগে তেরেজা মে যে আশা নিয়ে নির্বাচনের ঘোষণা দিয়েছিলেন তা সময়ের ফেরে জেরেমি করবিনের দিকে চলে গেছে। তবে সব জল্পনা-কল্পনার অবসান ঘটবে আজ ব্যালটের বাক্সে। আগামীকাল সকালই আসলে বলা যাবে ব্রিটেনের আগামী দিনের কাণ্ডারি কে হবেন। লন্ডন ব্রিজের হামলার ধাক্কা সামলিয়ে শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় ব্যস্ত ব্রিটেনের রাজনৈতিক দলগুলো। শেষ মুহূর্তের প্রচারণায় টোরি পার্টির প্রধান তেরেজা মে বলছেন, ব্রেক্সিট ব্রিটেনের জন্য প্রচুর চাকরি, বাড়ি ও ভালো পরিবহন সুবিধা তৈরি করে  দেবে। এজন্য বৃহস্পতিবার কনজারভেটিবকে আবারও ভোট দিয়ে নির্বাচিত করা প্রয়োজন। অপরদিকে লেবার লিডার করবিন বলছেন, ন্যাশনাল হেলথ সার্ভিসকে বাঁচাতে আর মাত্র ২৪ ঘণ্টা সময় আছে। তিনি বৃহস্পতিবার লেবারকে ভোট দিয়ে সরকারে নিয়ে আসার জন্য সবাইকে অনুরোধ জানাচ্ছেন। তিনি বলছেন, জাতীয় স্বাস্থ্য খাত আরও পাঁচ বছর অর্থসংকট, কর্মচারী সংকট ও বেসরকারিকরণের মধ্য দিয়ে যেতে পারে না। মঙ্গলবার সন্ধ্যায় বার্মিংহামে গানের অনুষ্ঠানের মতো করে আয়োজিত এক নির্বাচনী র‌্যালিতে তিনি বলেন, কনজারভেটিভরা বলছে নির্বাচনের পর তারা শক্তিশালী ও স্থায়ী সরকার উপহার দেবেন। ‘তারা কি বলছে, এখন তা হলে তাদের কি অবস্থা? কি বলছে তারা? তারা ভাবছে ৮ তারিখের নির্বাচনের পর সব ঠিক হয়ে যাবে। আমি আপনাদের বলছি, তারা আমাদের অবমূল্যায়ন করছে, তাই নয় কি?’ অন্য প্রধান দল লিবারেল ডেমোক্রেট তাদের পুরনো আসন ধরে রাখার প্রতি মনোযোগ দিচ্ছে আর ইউকিপ বলছে ব্রেক্সিটের পক্ষে না এলে লিবডেমের কোনো আশা নেই। স্কটল্যান্ড ন্যাশনাল পার্টি প্রধান নিকোলা সার্জেন নিজের অতীত বিভিন্ন কর্মকাণ্ডের আত্মসমর্থনের পাশাপাশি স্কটল্যান্ড আলাদা হওয়ার দ্বিতীয় রেফারেন্ডামের প্রতি জোর দিচ্ছেন। শেষ দিনে কনজারভেটিভ শীর্ষ নেতা মে প্রচার শুরু করেন লন্ডন থেকে; এরপর যান সাউথ কোস্ট, নরফোক, নটিংহ্যামশায়ার এবং ওয়েস্ট মিডল্যান্ডে। প্রচারজুড়েই মে বলেছেন ব্রেক্সিটের কথা, যা নিশ্চিত করতেই ৫০ দিন আগে হঠাৎ করেই আগাম নির্বাচনের ডাক দেন তিনি। মে’র দাবি, ইউরোপীয় ইউনিয়নের পেছনে আগে যুক্তরাজ্যের যে ব্যয় হতো, তা বেঁচে যাওয়ায় ‘বিশাল উপকার’ হবে। এবারের নির্বাচনে মোট ১৪জন বাংলাদেশি প্রার্থী হয়েছেন বিভিন্ন রাজনৈতিক দল থেকে। সবার দৃষ্টি এই প্রার্থীদের দিকে। প্রধান তিনজন সম্পর্কে এক নজরে কিছু জেনে নেওয়া যাক।

আত্মপ্রত্যায়ী টিউলিপ : ব্রিটেনের সদ্য ভেঙে দেওয়া পার্লামেন্টে যে তিনজন ব্রিটিশ-বাংলাদেশি এমপি ছিলেন, তাদের একজন হচ্ছেন লেবার পার্টির টিউলিপ সিদ্দিক। তার আরেকটি পরিচয়, তিনি বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ভাগ্নি। ২০১৫ সালে খুবই প্রতিদ্বন্দ্ব্বিতাপূর্ণ এক নির্বাচনে তিনি লন্ডনের হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে জয়ী হন। মাত্র দুই বছর আগের নির্বাচনে হ্যাম্পস্টেড অ্যান্ড কিলবার্ন আসন থেকে প্রথম এমপি নির্বাচিত হন তিনি। এই দুই বছরেই পার্লামেন্টে নানা ইস্যুতে সরব থেকে গণমাধ্যমের নজর কেড়েছেন তিনি। গত বছর ব্রিটেনে যখন ব্রেক্সিট গণভোট হয়েছিল, তখন এই এলাকার প্রায় ৭৫ শতাংশ মানুষ এর বিপক্ষে ভোট দিয়েছিলেন। টিউলিপ সিদ্দিক নিজেও এই ছিলেন ব্রেক্সিটের বিপক্ষে। টিউলিপ স্বীকার করলেন তার নির্বাচনী প্রচারণায় এই ব্রেক্সিটের ইস্যু বেশ গুরুত্বপূর্ণ। তিনি কি আশা করছেন যে ব্রেক্সিটের বিপক্ষে নেওয়া জোরালো অবস্থান তাকে ভোটে জিততে সাহায্য করবে?

ড. রূপা হক কি নিজের চ্যালেঞ্জ জিততে পারবেন? ২০১০ সালে সাদা অধ্যুষিত ইলিং কাউন্সিলের কাউন্সিলর নির্বাচিত হন বাংলাদেশের পাবনার মেয়ে ড. রূপা হক। প্রথম জয়ের পরই তাকে ডেপুটি মেয়র হিসেবে দায়িত্ব দেওয়া হয়। ২০১৫ সালের নির্বাচনে ইলিং সেন্ট্রাল ও এক্টন আসনের নির্বাচিত এমপি হয়ে ব্রিটিশ পার্লামেন্টের দ্বিতীয় বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত প্রার্থী হিসেবে পা রাখেন তিনি। ব্যক্তিগত জীবনে একজন অধ্যাপিকা, লেখিকা, এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনকে তিনি নিজের জন্য চ্যালেঞ্জ হিসেবে ভাবছেন। তিনি বলেন, আমার জন্য আবারও নির্বাচনে অংশ নেওয়া এবং আগের আসন ধরে রেখে পার্লামেন্টে যাওয়া একটা চ্যালেঞ্জ। আমি সবার ইতিবাচক সাড়া পেয়ে বেশ আশাবাদী। নিজের আসনে তেমন বেশি বাংলাদেশি ভোটার না থাকলেও তিনি সারা দেশে বাংলাদেশিদের বাসস্থান, শিক্ষা, চিকিৎসা সুবিধা উন্নয়নে কাজ করার সুযোগ গ্রহণ করতে চান বলে জানান। ১৯৭২ সালে জন্ম নেওয়া রূপা হকের বাবা মোহাম্মদ হক এবং মা রওশন আরা হক। ১৯৬০ সালে রূপার বাবা-মা ব্রিটেনে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য পাড়ি জমান। তিন বোনের মধ্যে সবার বড় বোন নূরা হক একজন স্থপতি, রূপা হক বিখ্যাত কিংসটন কলেজের সোসিওলজি ও ক্রিমিনোলোজির শিক্ষকতার পাশাপাশি মূলধারায় লেখালেখি করেন, ছোটবোন কনি হক বিবিসির বিখ্যাত ব্লু পিটার অনুষ্ঠানের উপস্থাপিকা ছিলেন।

হ্যাটট্রিক জয়ের প্রত্যাশা রুশনারা আলীর : ব্রিটিশ বাংলাদেশিদের গৌরবোজ্জ্বল ইতিহাস লিখতে গেলে সবার উপরে নাম থাকবে ব্রিটিশ এমপি রুশনারা আলীর। ২০১০ সালে প্রথম বাংলাদেশি এমপি হিসেবে ১১ হাজার ৫৭৪ ভোট বেশি পেয়ে টাওয়ার হ্যামলেটসের বেথনালগ্রিন-বো আসন থেকে ব্রিটিশ পার্লামেন্টে পা রেখে ইতিহাসের পাতায় ঢুকে যান তিনি। এরপর ২০১৫ সালের নির্বাচনেও নিজেকে ছাড়িয়ে আবারও ঢুকে যান ব্রিটিশ পার্লামেন্টে। এবারের মধ্যবর্তী নির্বাচনে বাংলাদেশি কমিউনিটিতে সবচেয়ে বেশি আলোচিত হচ্ছে বেথনালগ্রিন-বো আসন। একটি প্রশ্নই ঘুরপাক খাচ্ছে সবার মাঝে রুশনারার হ্যাটট্রিক জয় নাকি মাশরুরের চমক? রুশনারা আলী বিগত ৭ বছর বিভিন্নভাবে আলোচনায় ছিলেন ব্রিটিশ পার্লামেন্ট থেকে শুরু করে মূলধারার সংবাদপত্র ও কমিউনিটিতে। শ্যাডো মিনিস্টার হিসেবে তিনি দায়িত্ব পালন করেছেন, দলের সিদ্ধান্তের বাইরে গিয়ে ইরাক যুদ্ধের বিরুদ্ধে অবস্থান নিয়ে পদত্যাগ করে সারা বিশ্বে আলোড়ন তুলেন, রোহিঙ্গা ও লেবাননে সিরিয়া রিফিউজি ক্যাম্প পরিদর্শন করে তিনি এর দুর্দশা লাঘবে মূলধারার দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এ ছাড়া ব্রিটিশ মূলধারা সংবাদপত্র তাকে ভবিষ্যৎ প্রধানমন্ত্রী হওয়ার যোগ্যতা রাখেন বলেও আখ্যায়িত করে। গত ৭ বছর তিনি কমিউনিটির বিভিন্ন সামাজিক ইস্যুতে সরব ছিলেন। এসবকে পুঁজি করেই তিনি হ্যাটট্রিক বিজয়ের ইতিহাস গড়তে চান ৮ জুন।

সর্বশেষ খবর