শনিবার, ১০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

বার বার কেন একই নিষ্ঠুরতা

জয়শ্রী ভাদুড়ী

১২ জানুয়ারি ২০১৭। সকাল ৮টার দিকে মিরপুর এলাকার শামীম তার স্ত্রী আনিকার কাছে খাবার চান। স্ত্রী স্বামীকে বাসি ভাত খেতে দেন। এ নিয়ে স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে ঝগড়া হয়। অনেকক্ষণ ঝগড়াঝাটির পর শামীম না খেয়েই দোকানে চলে যান। এরপর বাকিটুকু রক্তাক্ত ইতিহাস। শামীম চলে যাওয়ার পর দুই সন্তান শামীমা ও আবদুল্লাহকে বঁটি দিয়ে জবাই করে মা আনিকা। এরপর নিজেও ফ্যানের সঙ্গে ওড়না পেঁচিয়ে আত্মহত্যা করে। ঘটনাস্থল থেকে উদ্ধার হয় একটি চিঠি। তাতে লেখা রয়েছে, শামীম তোমার ভুলের জন্য আমি চলে গেলাম। সঙ্গে নিয়ে গেলাম ছেলে-মেয়েকে। আমি যেখানে থাকব, ছেলেমেয়েও সেখানেই থাকবে। ১ জুন গাজীপুরে শ্রীপুর এলাকার চকপাড়া গ্রামের সামিয়া আক্তার বীথি তার আট মাসের সন্তানকে ফিডারে দুধের সঙ্গে বিষ মিশিয়ে খাইয়ে হত্যা করে। পরে পুলিশি জিজ্ঞাসাবাদে মা স্বীকার করেন সন্তানকে হত্যার কথা।

এভাবে পারিবারিক কলহ, পরকীয়া, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, ব্যক্তিগত লোভ-লালসা চরিতার্থ কিংবা স্বার্থ আদায় করার জন্য টার্গেট করা হচ্ছে শিশুদের। রাজধানীসহ সারা দেশে প্রতিদিনই ঘটছে শিশু হত্যাকাণ্ড। এর মধ্যে আশঙ্কাজনক হারে বাড়ছে বাবা-মায়ের হাতে শিশু হত্যাকাণ্ডের ঘটনা। ২৬৯টি সংগঠনের মোর্চা বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরাম ১০টি জাতীয় দৈনিকে প্রকাশিত সংবাদের ওপর ভিত্তি করে শিশু হত্যার পরিসংখ্যান তৈরি করেছে। তাদের হিসাব মতে, চলতি বছরের জানুয়ারি মাসে ২৭ শিশু এবং ফেব্রুয়ারি মাসে ১৮ ফেব্রুয়ারি পর্যন্ত ১৮ শিশু খুন হয়েছে। সে হিসাবে গড়ে প্রতিদিন একটি করে শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। গত বছরের ফেব্রুয়ারি মাসে ১৯ শিশু খুন হয়। এরপরই আছে বাবা-মায়ের হাতে শিশু খুনের ঘটনা। দেড় মাসে সংখ্যাটি ৭-এ পৌঁছে গেছে। গত বছরের এই দুই মাসে তা ছিল ১০টি। এরকম প্রতিদিনই ঘটছে শিশু হত্যাকাণ্ড। গত বছরের ৭ ফেব্রুয়ারির ঘটনা। পারিবারিক কলহের জেরে সিরাজগঞ্জের রতনকান্দি ইউনিয়নের শ্যামপুর গ্রামে মায়ের হাতে খুন হয় ফুটফুটে শিশু তানভিন হাসান। জন্মের মাত্র ১১ মাসের মাথায় মায়ের হাতে মৃত্যু হয় তানভিনের। হত্যার পর শিশুটির লাশ সুটকেসে ভরে ঘরের ভিতর লুকিয়ে রেখেছিলেন পাষাণ মা রুবিয়া খাতুন (৩০)। এ ঘটনার কিছুদিন পরই পিরোজপুরে তামিম নামে চার বছরের এক শিশুকে পানির সঙ্গে ইঁদুরের ওষুধ খাইয়ে হত্যা করেন তার মা জায়েদা বেগম। এ হত্যাকাণ্ডের নেপথ্যেও ছিল পারিবারিক কলহ। ২৬ ফেব্রুয়ারি বৃহস্পতিবার ঢাকার অদূরে নারায়ণগঞ্জের আড়াইহাজার উপজেলায় সৎ মায়ের হাতে খুন হয় চার বছরের মরিয়ম। আর এভাবেই কয়েক মাসে দেশের বিভিন্ন স্থানে বাবা-মায়ের হাতে নির্মম হত্যার শিকার হয়েছে শিশুরা। কেবল বাবা-মা নন, ঘরে-বাইরে কারও হাত থেকেই নিস্তার পাচ্ছে না নিষ্পাপ শিশুরা। বাংলাদেশ শিশু অধিকার ফোরামের (বিএসএফ) পরিসংখ্যান বলছে, গত চার বছরে ১ হাজার ৮৫ শিশু হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে। এর মধ্যে ২০১৫ সালে ২৯২, ২০১৪ সালে ৩৫০, ২০১৩ সালে ২১৮ ও ২০১২ সালে ২০৯ শিশু খুন হয়েছে। শিশু হত্যার এসব ঘটনা বিশ্লেষণ করে দেখা গেছে, সাম্প্রতিককালে বাবা-মায়ের হাতে বিশেষ করে মায়ের হাতে শিশু খুন হচ্ছে বেশি। আর এসব খুনের পেছনে পারিবারিক কলহ, বাবা-মায়ের অনৈতিক সম্পর্ক, সম্পত্তি নিয়ে বিরোধ, মাদকাসক্তি এবং অপহরণ বা মুক্তিপণ দাবিই বেশি দায়ী। ২০১৫ সালে ৪৩ শিশু তার মা, বাবা বা কোনো আত্মীয়ের হাতে প্রাণ হারিয়েছে। ২০১৪ সালেও এভাবে খুন হয়েছে ১৫ শিশু। এদিকে শিশুদের সহায়তা দিতে প্রতিটি থানায় ‘শিশু ডেস্ক’ চালু করার কথা থাকলেও এর বাস্তবায়ন হয়নি এখনো। গত বছর জানুয়ারি থেকে আগস্ট পর্যন্ত দেশে শুধু বাবা-মায়ের হাতেই হত্যাকাণ্ডের শিকার হয়েছে ২৭ নিষ্পাপ শিশু। এর মধ্যে মায়ের হাতে ১৩ ও বাবার হাতে ১৪ শিশু প্রাণ হারিয়েছে।

গত বছরের ২৯ ফেব্রুয়ারি রাজধানীর বনশ্রীতে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত মা নিজ হাতে খুন করলেন তার দুই সন্তানকে। তার শঙ্কা ছিল, পড়াশোনায় ভালো করতে না পারলে সন্তানদের ভবিষ্যৎ কী হবে। এই দুঃসহ হত্যাকাণ্ডের জের কাটতে না কাটতেই ১৮ এপ্রিল উত্তরার মাস্টারপাড়া সোসাইটির একটি বাসায় পারিবারিক কলহের জেরে মা তার সন্তানকে ধারালো অস্ত্রের আঘাতে খুন করেন। ১৩ আগস্ট রাজধানীর সবুজবাগে নিজঘরে দুই শিশুকে গলা কেটে হত্যা করে তাদেরই জন্মদাত্রি মা। এ ঘটনার একদিন পরই পিরোজপুরে দুই শিশু কন্যাকে হত্যা করে আত্মহত্যা করেন আর এক মা। এরকম প্রতিবছরই ঘটছে হতবিহ্বল করে দেওয়া ঘটনা। ২০১০ সালের রাজধানীর পূর্ব জুরাইনের আলমবাগ এলাকার একটি বাড়িতে মা ফারজানা কবির রিতা তার দুই সন্তানকে নিয়ে বিষপান করে আত্মহত্যা করেন। বছর পার হয়েছে কিন্তু থামেনি বীভৎসতা। এরই ধারাবাহিকতায় গতকাল রাজধানীর তুরাগ থানাধীন কামারপাড়ায় পাওয়া গেল মাসহ তিন সন্তানের লাশ। এটা হত্যা না আত্মহত্যা তা ঘিরে জমাট বাঁধা রহস্য।

সর্বশেষ খবর