শনিবার, ১০ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা
বিশেষজ্ঞ মত

সামাজিক অস্থিরতারই প্রকাশ, দায় রাষ্ট্রেরও

জিন্নাতুন নূর

পারিবারিক অশান্তির শিকার একজন মা যখন চূড়ান্ত মানসিক বিপর্যয়ে পড়েন, তখনই আত্মহত্যার পথ বেছে নেন। অনেক সময় সন্তানদের হত্যা করে শেষ করে দেন নিজের জীবন। সামাজিক অস্থিরতারই বহিঃপ্রকাশ এ ধরনের মর্মান্তিক ঘটনা। মনোবিজ্ঞানী ও বিশেষজ্ঞরা এমন মতপ্রকাশ করে বলছেন, অতিরিক্ত বিষণ্নতা থেকে মা এ ধরনের অপরাধ করছেন। তবে এ ক্ষেত্রে শুধু সেই মাকে দোষারোপ ঠিক নয়। সমাজ ও রাষ্ট্রকেও নির্মম এই হত্যাকাণ্ডের দায়ভার নিতে হবে। সেই সঙ্গে সন্তান হত্যায় মা জড়িত কিনা, তা তদন্ত ছাড়া ঢালাওভাবে বলাও ঠিক নয়। জাতীয় মহিলা আইনজীবী সমিতির নির্বাহী পরিচালক অ্যাডভোকেট সালমা আলী বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘সামাজিক অস্থিরতার কারণেই এ ধরনের ঘটনা। মানুষের এখন আগ্রহ বস্তুগত প্রাপ্তিতে। মা যখন সন্তানদের হত্যা করে আত্মহত্যা করছেন তখন বুঝতে হবে, তিনি কতটা কঠিন পরিস্থিতির মধ্যে পড়ে এই সিদ্ধান্ত নিতে বাধ্য হয়েছেন। পারিবারিক কলহ এর অন্যতম কারণ হতে পারে। তবে শুধু মাকে দোষারোপ ঠিক হবে না। সমাজ ও রাষ্ট্রকেও দায়ভার নিতে হবে।’ সালমা আলী বলেন, ‘এই মর্মান্তিক ঘটনাগুলো তদন্ত না করে হুটহাট আত্মহত্যা বলে প্রচারও ঠিক নয়। পুলিশ সদস্যদের খতিয়ে দেখতে হবে। সেই মা কোনো পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়েছিলেন কিনা তাও তদন্ত করা জরুরি। মূলত পারিবারিক মূল্যবোধ ও সুস্থ পরিবেশের অভাব থেকেই সমাজে একের পর এক এ ধরনের ঘটনা ঘটছে। এসব প্রতিরোধের জন্য কল্যাণমূলক রাষ্ট্র গঠনের বিকল্প নেই।’ সমাজ বিজ্ঞানীদের মতে, দেশে যৌথ পরিবার প্রথা ক্রমেই হারিয়ে যাচ্ছে। মানুষ ব্যক্তিকেন্দ্রিক হয়ে পড়ছে। প্রযুক্তি ও বিত্ত-বৈভবও মানুষের আবেগ-মূল্যবোধে ব্যাপক পরিবর্তন আনছে। মানুষ এখন যান্ত্রিক জীবনে অভ্যস্ত। তাই অপরাধ কমাতে সামাজিক স্বাস্থ্য সুরক্ষা বিষয়ক দিক-নির্দেশনা ও পরিকল্পনা এখনই গ্রহণ করতে হবে। বিশেষজ্ঞরা আরও বলছেন, অশান্তির শিকার একজন মা যখন পরিবারের সদস্যদের সহায়তা পান না, তখন হত্যা-আত্মহত্যার পথ বেছে নিতে পারেন। ঝুঁকিতে পড়ে সন্তানদের জীবনও। এ ক্ষেত্রে মায়েদের শুধু মানসিক কাউন্সিলিং যথেষ্ট নয়, পারিবারিক ও সামাজিক সহায়তাও প্রয়োজন। কোনো নারী স্বামী পরিত্যক্তা হলে এবং তার স্বাবলম্বী হওয়ার সামর্থ্য না থাকলে, তাকে রাষ্ট্রীয়ভাবে সহায়তার বিধান রাখতে হবে। মা ও সন্তানরা পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হলে সরকারিভাবে দ্রুত তার পাশে দাঁড়াতে হবে।

বাংলাদেশ হিউম্যান রাইটস ফাউন্ডেশনের নির্বাহী অ্যাডভোকেট এলিনা খান বলেন, ‘সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তাহীনতার কারণে একজন মা আতঙ্কিত হয়ে সন্তানদের হত্যা করছেন। নিজেও আত্মহত্যা করছেন। আমরা ধরে নিতেই পারি, মা চূড়ান্ত পারিবারিক নির্যাতনের শিকার হয়ে এমন অপরাধ করছেন।’ তিনি বলেন, ‘বর্তমান সমাজে সবাই যার যার মতো ব্যস্ত। খুব মারাত্মক কিছু না হলে কেউ কারও বিপদে এগিয়ে আসেন না।’ এলিনা খানের মতে, ‘সামাজিক ও পারিবারিক নিরাপত্তাহীন একজন মা যখন মানসিক অশান্তি থেকে আত্মহত্যার সিদ্ধান্ত নেন, তখন তিনি সন্তানদের ভবিষ্যৎ নিয়েও দুশ্চিন্তা করেন। তার মৃত্যুর পর সন্তানদের কে দেখবে, এই আতঙ্কে সন্তানদের হত্যা করতে পারেন। এ ধরনের ঘটনায় রাষ্ট্রও অসহায় মাকে সহায়তা করছে না। আর স্বামীর কাছ থেকে আর্থিক সহায়তা না পেলে একজন মায়ের পক্ষে সন্তানদের শিক্ষা-স্বাস্থ্যসহ ব্যয়ভার বহন করা কষ্টকর। বিগত সময়ে এরকম পরিস্থিতির শিকার বেশ কয়েকজন মা ভবিষ্যতের দুশ্চিন্তায় সন্তানদের হত্যা করেছেন।’ মনোচিকিৎসক ডা. মোহিত কামাল এ বিষয়টিকে বিপজ্জনক রোগের লক্ষণ হিসেবে দেখছেন। তিনি বলেন, ‘যে মা তার সন্তানকে হত্যার মতো অপরাধ করছেন, তিনি অতিরিক্ত বিষণ্নতা থেকেই এ কাজ করছেন। তারা কখনো তাত্ক্ষণিক তাড়না থেকে এই অপরাধ করছেন, আবার কখনো পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ডও ঘটাচ্ছেন।’

সর্বশেষ খবর