বৃহস্পতিবার, ২২ জুন, ২০১৭ ০০:০০ টা

অর্থমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন তোফায়েল

নিজস্ব প্রতিবেদক

অর্থমন্ত্রীর পাশে দাঁড়ালেন তোফায়েল

বাজেট আলোচনা জমে উঠেছে। গত দুই দিন সরকারি ও বিরোধী দল সংসদে কঠোরভাবে অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করলেও গতকাল বিরোধী দলকে তুলাধোনা করেছে সরকারি দল। অর্থমন্ত্রীর বয়স নিয়ে কটাক্ষ ও তার পদত্যাগ দাবি করায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন স্বয়ং বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। তবে বাজেট আলোচনায় ব্যাংকের আবগারি শুল্ক ও ভ্যাট বাড়ানো বা সঞ্চয়পত্রের সুদ কমানোর দাবি থেকে সরে যাননি কেউ। তোফায়েল আহমেদও স্পষ্ট করেই বলেন, ‘এটা প্রস্তাবিত বাজেট, এটাই চূড়ান্ত নয়। যেমন আবগারি শুল্ক, ভ্যাট নিয়ে কথা উঠছে। এটি নিয়ে আমাদের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন।’ বাজেট নিয়ে নিজ দলের মন্ত্রীদের সমালোচনার প্রসঙ্গে বাণিজ্যমন্ত্রী বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী বাজেট দিয়েছেন। এই বাজেট ক্যাবিনেট অনুমোদিত। আমার যদি কোনো কথা থাকে আবগারি, ভ্যাট, সঞ্চয়পত্র নিয়ে...। আমি বিশ্বাস করি, মাননীয় প্রধানমন্ত্রী জানেন মানুষ কী চায়। ২৮ তারিখ প্রধানমন্ত্রী ভাষণ দেবেন। সেই দিনই তিনি অর্থমন্ত্রীকে বলবেন, এটা করেন, ওটা করেন। তখন এ বাজেট এমনভাবে অনুমোদিত হবে, বাংলাদেশের মানুষ শুধু প্রশংসা করবে না, বলবে এটা শ্রেষ্ঠ বাজেট।’ জাতীয় সংসদে বাজেটের ওপর সাধারণ আলোচনায় অংশ নিয়ে এভাবেই অর্থমন্ত্রীর পাশে দাঁড়িয়ে নিজ দলের মন্ত্রী ও বিরোধী দলের সদস্যদের বিঁধেছেন বাণিজ্যমন্ত্রী তোফায়েল আহমেদ। স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী ও ডেপুটি স্পিকার ফজলে রাব্বি মিয়ার সভাপতিত্বে বাজেট আলোচনায় আরও অংশ নেন বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটনমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, সরকারি দলের ড. মো. আবদুর রাজ্জাক, ধীরেন্দ্র দেবনাথ শম্ভু, মীর মোস্তাক আহমেদ রবি, ড. হাছান মাহমুদ, বজলুল হক হারুন, একাব্বর হোসেন, বেগম ওয়াসিকা আয়শা খান, মমতাজ বেগম, জাতীয় পার্টির ফখরুল ইমাম, স্বতন্ত্র সদস্য রুস্তম আলী ফরাজী ও উষাতন তালুকদার। তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে অনেক আলোচনা হয়েছে। জিয়াউদ্দিন বাবলু যে ভাষায় অর্থমন্ত্রীর সমালোচনা করেছেন, আমি এ ভাষা আশা করি নাই। সমালোচনা করার অধিকার সবার আছে। কিন্তু সমালোচনা হবে গঠনমূলক। যখন বয়স নিয়ে কথা বলেন, আপনাদের নেতা এরশাদের বয়সের কথা চিন্তা করেন না? যার নেতৃত্বে আপনি দল করেন। আপনারা অর্থমন্ত্রীর বয়স নিয়ে কথা বলেছেন। আপনার দলের চেয়ারম্যান হুসেইন মুহম্মদ এরশাদ তো অর্থমন্ত্রীর চাইতে পাঁচ বছরের বড়।’ তিনি বলেন, ‘একজন সম্মানিত মানুষকে সম্মান দিতে হয়। বাবলু বলেছেন, এখন বিদায় হোন। তিনি আপনাদের অর্থমন্ত্রীও ছিলেন। উনি (অর্থমন্ত্রী) ১২টা বাজেট দিয়েছেন। আওয়ামী লীগ ক্ষমতায় থাকলে আরও দেবেন। ওনার ওপর প্রধানমন্ত্রীর আস্থা আছে।’ জিয়াউদ্দিন বাবলুর উদ্দেশে তিনি বলেন, ‘যিনি আপনাকে একবার মহাসচিব বানান, আবার বাদ দেন, আবার রুহুল আমিন হাওলাদারকে বানান, আবার বাদ দেন, এই ক্ষমতাশালী লোকটি, তিনি তো আপনাদের নেতা, আপনার মামাশ্বশুর। তার কথা কেমনে ভুলে গেলেন? তার পদত্যাগের কথা বললেই ভালো শোনাত।’ তোফায়েল আহমেদ বলেন, ‘অর্থমন্ত্রী বাজেট দিয়েছেন। এই বাজেট ক্যাবিনেটে অনুমোদিত। বাজেট পেশের আগে আমরা ক্যাবিনেট মিটিং করি। সেখানে বাজেট অনুমোদিত হয়। আমার যদি কোনো কথা থাকে, “দ্যাট ইজ দি প্রোপার প্লেস হোয়্যার আই ক্যান সে”।’ তিনি বলেন, ‘এটা প্রস্তাবিত বাজেট। এটাই চূড়ান্ত নয়। যেমন আবগারি শুল্ক, ভ্যাট নিয়ে কথা উঠছে। এটি নিয়ে আমাদের অভিভাবক প্রধানমন্ত্রী কথা বলবেন। প্রধানমন্ত্রীর প্রস্তাবের পর যে বাজেট পাস হবে, সেটি হবে দেশের শ্রেষ্ঠ বাজেট।’ এ সময় জাতীয় পার্টির শাসনামলের কিছু চিত্র তুলে ধরে তোফায়েল বলেন, জাতীয় পার্টির সময় ১৯৮৯-৯০ অর্থবছরে রাজস্ব ৫ হাজার ২৯২ কোটি টাকা ছিল। বিএনপির শেষ সময় ২০০৬-০৭ অর্থবছরে হয়েছিল ৩৭ হাজার কোটি টাকা। আর সেটি বৃদ্ধি পেয়ে ২০১৬-১৭ অর্থবছরে হয়েছে ২ লাখ ৪৮ হাজার কোটি টাকা। তিনি বলেন, ‘আপনাদের অনেকে ব্যাংক ঋণ নিয়ে কথা বলেছেন। আপনাদের অনেকেই ব্যাংকের মালিক। বাবলুও একটা ব্যাংকের পরিচালক। শেয়ারবাজার নিয়ে কথা বলেন। কাজী ফিরোজ রশীদের দুটি ব্রোকার হাউস রয়েছে। ভালো। অভিজ্ঞতা নিয়েই তো কথা বলছেন। ব্যাংকে কিছু দুর্ঘটনা ঘটছে এটা সত্য। জিয়াউদ্দিন বাবলু বলেছেন, আগে লোডশেডিং ছিল না। আসলে তখন তো বিদ্যুৎই ছিল না, লোডশেডিং থাকবে কী করে!’

জাতীয় পার্টির প্রেসিডিয়াম সদস্য মো. ফখরুল ইমাম প্রস্তাবিত বাজেট নিয়ে খোদ সরকারি দলের মন্ত্রী-এমপিদের সমালোচনার প্রসঙ্গ তুলে ধরে বলেন, ‘দেখা যাচ্ছে সরকারি দলের নেতারাই বাজেটের সমালোচনা করছেন। এ নিয়ে আমি একটু দ্বিধাগ্রস্ত। সরকারি দল বিরোধী দলের ভূমিকায় নামতে চাইছে কিনা। সামনে আবার নির্বাচন আছে। বঙ্গোপসাগরের মাঝখান দিয়ে নৌকা চলছে। নৌকা ভেসে চলছে, তাতে আপনারা সবাই আছেন। আমার মনে হয়, যারা নৌকায় ছিলেন তারা আর সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদের বেড়াজালে আটকে থাকতে চাইছেন না। এটাকে স্বাগত জানাই।’ অর্থমন্ত্রীকে উদ্দেশ করে তিনি বলেন, ‘আপনার সহকর্মীরা হয়তো আপনাকে পরিত্যাগ করেছেন। ক্যাবিনেটে অনুমোদনের পর সংসদে যেসব বক্তৃতা হচ্ছে, শুনতে ভালো লাগে। এটা ঠিক না। সাধারণ আলোচনায় এ পর্যন্ত দুই শতাধিক এমপি বক্তব্য দিয়েছেন। তাদের বক্তব্যের স্পিড দেখলে মনে হয়, তাদের প্রস্তাবগুলো এড়িয়ে যেতে পারবেন না অর্থমন্ত্রী।’ ওয়ার্কার্স পার্টির সভাপতি ও বিমানমন্ত্রী রাশেদ খান মেনন বিএনপির ‘সহায়ক’ সরকারের দাবি নাকচ করে দিয়ে বলেন, ‘তারা তত্ত্বাবধায়ক সরকারের বদলে এখন সহায়ক সরকারের কথা বলছে, যার কোনো ধরনের সাংবিধানিক বৈধতা নেই। তাই নির্বাচন হবে এবং সাংবিধানিকভাবে শেখ হাসিনার অধীনেই হবে। এবার যদি বিএনপি নির্বাচন না করে, তবে তারা তাদের জীবনের সর্বশেষ ভুলটি করবে। আর নির্বাচন প্রতিরোধ, বেগম জিয়ার অবরোধের মতো কথার ফানুসই থেকে যাবে।’ তিনি দেশের অভ্যন্তরীণ বিষয়ে কূটনীতিকদের হস্তক্ষেপ বন্ধের দাবি জানান। বাজেট প্রস্তাব প্রসঙ্গে রাশেদ খান মেনন বলেন, ১৫ শতাংশ ভ্যাট কার্যকর হলে তার পরিণতি কী হবে, অর্থমন্ত্রী জানেন না। এতে নিম্নমধ্যবিত্তদের ওপর আঘাত আসবে। তিনি আশা করেন, অর্থমন্ত্রী এটি পুনর্বিবেচনা করবেন এবং প্রধানমন্ত্রী প্রয়োজনে এখানে হস্তক্ষেপ করবেন। ব্যাংক হিসাবে বাড়তি আবগারি শুল্ক প্রত্যাহারের দাবি জানিয়ে তিনি বলেন, এ শুল্কের নাম বদলালে তা যথেষ্ট হবে না। প্রত্যাহার করতে হবে। বাজেটের টাকা সংকুলানের জন্য ঢালাওভাবে ভ্যাট-ট্যাক্স আরোপ না করে পাচার হওয়া অর্থ ফেরত আনার পরামর্শ দিয়ে তিনি ব্যাংক আমানতের ওপর প্রস্তাবিত আবগারি শুল্ক প্রত্যাহার, মেডিটেশনকে ভ্যাট থেকে অব্যাহতি ও সঞ্চয়পত্রের সুদ না কমানোর আহ্বান জানান। প্রবৃদ্ধির পাশাপাশি গ্রাম-শহরের আয়বৈষম্য কমিয়ে সমতাভিত্তিক অর্থনৈতিক ব্যবস্থা গড়ে তোলার আহ্বান জানিয়ে রাশেদ খান মেনন বলেন, আয়বৈষম্য না কমানো গেলে ধনী-দরিদ্রের বিভাজন বৃদ্ধি পাবে। তিনি বলেন, রাজস্ব আয় বাড়াতে সাধারণ মানুষকে আঘাত না করে করের পরিধি বাড়িয়ে এনবিআরকে আরও দক্ষ ভূমিকা পালন করতে হবে। সাবেক খাদ্যমন্ত্রী ড. আবদুর রাজ্জাক বলেন, ‘দেশের বর্তমান উন্নয়নের ধারাকে অব্যাহত রাখতে হবে। জাতীয় নির্বাচন সামনে রেখে বিএনপি দেশকে অস্থিতিশীল করার চেষ্টা করছে। আমাদের এক কাপড়ে দেশ থেকে বের করে দেওয়ার হুমকি দিচ্ছে। অথচ কানাডার ফেডারেল কোর্ট রায় দিয়েছে, বিএনপি একটি সন্ত্রাসী দল ছিল, আছে ও থাকবে। বিএনপি-জামায়াত অতীতে নির্বাচন বানচাল করার অনেক চেষ্টা করেছে। আমার ভয় হয়, তাদের যদি মোকাবিলা করতে না পারি, জাতিকে ঐক্যবদ্ধ করতে না পারি, তাহলে হয়তো আমাদের আরও মূল্য দিতে হবে।’ ড. হাছান মাহমুদ বলেন, বিগত নির্বাচন না করায় বিএনপি আইসিইউতে চলে গেছে। আগামীতে নির্বাচনে না গেলে তাদের মৃত্যু ঘটবে। আমরা চাই না, খালেদা জিয়ার হাতে বিএনপির মৃত্যু ঘটুক। আমরা চাই, তারা নির্বাচনে আসুক। প্রতিদ্বন্দ্বিতাপূর্ণ নির্বাচন হোক। তিনি বলেন, আগামী নির্বাচনে তাদের আসতেই হবে। আর এই নির্বাচন সংবিধান অনুযায়ী শেখ হাসিনা সরকারের অধীনেই হবে। পাহাড়ধস এলাকা পরিদর্শনে যাওয়ার পথে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীরের গাড়িবহরে হামলার ঘটনাকে ‘অনভিপ্রেত, অপ্রীতিকর’ উল্লেখ করে তিনি বলেন, দেশ যখন অদম্য গতিতে এগিয়ে চলছে তখন বিএনপি দেশকে পিছিয়ে দিতে অপরাজনীতি আর মিথ্যাচারের রাজনীতি করা শুরু করেছে। সেদিন তাদের গাড়ির ধাক্কায় দুজন পথচারী আহত হন। এ নিয়ে বাগিবতণ্ডার একপর্যায়ে তারা উত্তেজিত জনতার ওপর দিয়ে গাড়ি চালিয়ে দিতে চায়, যে কারণে এই অপ্রীতিকর ঘটনাটি ঘটে। অথচ এ ঘটনা আওয়ামী লীগের ওপর চাপানোর চেষ্টা করে। তিনি বলেন, ‘আমরা সন্ত্রাসী রাজনীতি করি না। সন্ত্রাসী রাজনীতি করে বিএনপি। এই অপ্রীতিকর ঘটনা নিয়ে রাজনীতি না করার জন্য তিনি বিএনপির প্রতি আহ্বান জানান।’

সর্বশেষ খবর