শনিবার, ১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

আবার পুরনো চেহারায় ফিরছে ঢাকা

নিজস্ব প্রতিবেদক

আবার পুরনো চেহারায় ফিরছে ঢাকা

ঈদের ছুটি শেষে ঢাকায় ফিরতে শুরু করেছেন মানুষ। ছবিটি গতকাল কমলাপুর রেলস্টেশন থেকে তোলা —বাংলাদেশ প্রতিদিন

ফাঁকা ঢাকা ফের পুরনো চেহারায় ফিরতে শুরু করেছে। ঈদ ছুটি শেষে গ্রাম থেকে ফিরছে মানুষ। ঈদের একদিন আগে ফাঁকা হয়ে যায় ঢাকা। প্রিয়জনের সঙ্গে ঈদ করতে নাড়ির টানে গ্রামের বাড়ি ছুটে গিয়েছিল লাখো মানুষ। ঘরে ফেরা মানুষরা ঈদ শেষে রাজধানীতে আসার ঢল নামে গতকাল থেকে। বাড়ি থেকে যাওয়া সিংহভাগ মানুষ ফিরবে আজ শনিবার। আগামীকাল রবিবার থেকে আগের রূপে ফিরে যাবে কর্মব্যস্ত যানজটের এই নগরী। 

সকাল থেকেই দূর-দূরান্তের মানুষ বাস, ট্রেন, লঞ্চসহ বিভিন্ন যানবাহনে ঢাকায় ফিরতে শুরু করেন। রাজধানীর সদরঘাট, ঢাকা রেলওয়ে স্টেশন, গাবতলী, মহাখালী, সায়েদাবাদে বাস টার্মিনালসহ বিভিন্ন এলাকায় মানুষের রাজধানীতে ফেরার দৃশ্য দেখা যায়। ফাঁকা হয়ে যাওয়া ঢাকা আবার কর্মব্যস্ত হতে চলেছে। তবে ঈদের আগের ভিড় আর টিকিট পাওয়ার ঝামেলা এড়াতে আগে যারা পরিবার নিয়ে বাইরে যাননি, তারা ঈদ পরবর্তী ছুটি কাটাতে ঢাকা ছাড়বেন। এই আসা-যাওয়ার মাঝে রাজধানীতে ফেরা মানুষের ভিড়ই এখন স্টেশন ও টার্মিনালগুলোতে বেশি লক্ষ্য করা যাচ্ছে।

রাজধানীর কর্মব্যস্ত মানুষের অনেকের বাড়ি ফেরাটা যেন এমন হয়— গেলাম, ঈদ কাটালাম, চলে এলাম। ছুটির মাঝের দুদিন পরই শুক্রবার, শনিবার সরকারি ছুটি বাড়তি দুটি দিন যোগ হওয়ায় অনেকেই বাড়ি গিয়ে এবার হয়তো স্বস্তির নিশ্বাস ফেলার ফুরসত পেয়েছেন। ছুটির পর বুধবার প্রথম কর্মদিবস অন্যান্য ব্যস্ত দিনের মতো তেমন জমে ওঠেনি। পরদিন বৃহস্পতিবারও বিভিন্ন অফিসে উপস্থিতি তুলনামূলকভাবে কম ছিল। গতকাল পর্যন্ত ঢাকার চিত্র অনেকটা ঈদের আমেজ বিরাজ করতে থাকে।

দক্ষিণাঞ্চলের বিভিন্ন স্থান থেকে যাত্রী নিয়ে সদরঘাট টার্মিনালে ভিড়ছে লঞ্চ। ঢাকার বাইরের বিভিন্ন জেলা থেকে যাত্রী নিয়ে দূরপাল্লার বাস ফিরছে। ঢাকায় ফেরা যাত্রীদের সংখ্যা বেশি হওয়ার ফলে মহাসড়কে একটু বেশি চাপ লক্ষ্য করা যায়। ঢাকার কমলাপুর রেলস্টেশনও ফের সরগরম। গত দুদিনের তুলনায় তুলনামূলকভাবে একটু বেশি ঝক্কি পোহাতে হয়েছে নগরে ফেরা মানুষকে। আর রাজধানীতে এখনো যানজট না লাগায় যাত্রীরা সহজেই নিজ নিজ গন্তব্যে পৌঁছাতে পেরেছেন।

তবে আজ (শুক্রবার) যাত্রীর চাপ বেশি মনে হচ্ছে বলে জানান হানিফ এন্টারপ্রাইজের সুপার ভাইজার মুরাদ। তিনি জানান, আজ ও আগামীকাল শনিবার যাত্রীর চাপ বেশি থাকবে। কারণ অনেকে পরদিন রবিবার থেকে নিজ নিজ কাজে যোগ দেবেন।  

নাটোরের বাসিন্দা আবদুল মন্নাফ গতকাল জানান, তিনি একটি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানে চাকরি করেন। দুদিন আগে ছুটি শেষ হওয়ায় আগেই তিনি ঢাকায় ফিরে এসেছেন। তবে তার পরিবার সাপ্তাহিক ছুটির দিনে ফিরছেন বলে তিনি তাদের নিতে গাবতলীতে অপেক্ষা করছেন। তবে স্কুল, কলেজ, বিশ্ববিদ্যালয়সহ অনেক প্রতিষ্ঠান এখনো বন্ধ থাকায় শিক্ষার্থীরা হয়তো আরও কিছুদিন আরাম-আয়েশেই থাকবেন নিজ গ্রামে।

বরিশাল প্রতিনিধি রাহাত খান জানান, গত ২৭ জুন ঈদের ছুটি শেষ হলেও বরিশালসহ দক্ষিণাঞ্চলের কর্মস্থলমুখী মানুষের চাপ বেড়েছে গতকাল থেকে। বেসরকারি অফিস-প্রতিষ্ঠান আজ থেকে খোলা। অপরদিকে আগামীকাল খুলছে সরকারি অফিস-আদালত, ব্যাংক-বীমা। এ কারণে গতকাল দুপুরের পর থেকে কর্মস্থলমুখী মানুষের ঢল নামে বরিশাল নদীবন্দরে। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, ঈদের ছুটি ২৭ জুন শেষ হলেও চাকরিজীবীরা ২৮ ও ২৯ জুন দুই দিন অতিরিক্ত ছুটি নিয়ে পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ সময় কাটিয়ে এখন কর্মস্থলে ফিরছেন।

গতকাল বিকালে বরিশাল নদীবন্দরে গিয়ে দেখা গেছে, ঢাকার উদ্দেশে বরিশাল নদীবন্দরে নোঙ্গর করা রয়েছে বিভিন্ন নেভিগেশন কোম্পানির ১৭টি বিশালাকৃতির লঞ্চ। এ ছাড়া সরকারি দুটি জাহাজও যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। নদীবন্দরে নোঙ্গর করা ঢাকাগামী এমভি কীর্তনখোলা-১ ও ২, এমভি পারাবত-৮, ১০, ১১ ও ১২, এমভি সুন্দরবন-৮ ও ১০, এমভি সুরভী-৭ ও ৯, এমভি টিপু-৭ ও এমভি ফারহান-৮, এমভি দ্বিপরাজ, এমভি তাসরিফ-৩ ও ৪, এমভি রাজহংস-৮ এবং এমভি কালাম খান-১ লঞ্চগুলোর ডেক (ফ্লোর) বিকালের মধ্যে যাত্রীতে পরিপূর্ণ হয়ে যায়। এরপরও গাদাগাদি করে যাত্রী উঠানো হচ্ছিল প্রতিটি লঞ্চে।

বরিশাল-ঢাকা রুটের এমভি পারাবত-১০ লঞ্চের সুপারভাইজার নজরুল ইসলাম খান জানান, তাদের কোম্পানিসহ সব লঞ্চের কেবিন টিকিট আগেভাগেই বিক্রি হয়ে গেছে। এমভি সুন্দরবন-১০ লঞ্চের সুপারভাইজার হারুন-অর রশিদ জানান, তাদের কোম্পানির সব টিকিট বিক্রি হয়েছে অফিস থেকে। মালিক কর্তৃপক্ষ দেখে-শুনে প্রকৃত যাত্রীদের কাছে কেবিন টিকিট বিক্রি করেছেন। এখানে তাদের কোম্পানির কেবিন কালোবাজারি করার কোনো সুযোগ নেই। বরিশাল নদীবন্দরের ট্রাফিক পরিদর্শক রিয়াদ হোসেন জানান, ঈদের পর গতকালই সবচেয়ে বেশি ঢাকাগামী মানুষের ঢল দেখা গেছে। বিপুল সংখ্যক যাত্রীর সুবিধার্থে নিয়মিত এবং বিশেষ সার্ভিস মিলিয়ে ১৭টি ঢাকাগামী  লঞ্চ প্রস্তুত রাখা হয়েছে। নদীবন্দরের শৃঙ্খলা রক্ষায় স্কাউট, রোভার স্কাউট, মেরিন একাডেমির প্রশিক্ষণার্থী এবং আনসার নিয়োজিত রয়েছে। তারা বয়স্ক এবং অসুস্থ যাত্রীদের লঞ্চে উঠতে সহায়তা করছে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই ঠেকাতে নদীবন্দরে জেলা প্রশাসনের নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নিয়োগ করা হয়েছে। অতিরিক্ত যাত্রী বোঝাই করলে নির্বাহী ম্যাজিস্ট্রেট নির্ধারিত সময়ের আগে লঞ্চগুলোকে নদীবন্দর ত্যাগ করতে বাধ্য করছেন। এ ছাড়াও বিআইডব্লিউটিএর কর্মকর্তারা সার্বক্ষণিক তদারকি করছেন।

আমতলী প্রতিনিধি জানান, ঈদে নাড়ির টানে পরিবার পরিজনের কাছে আসা মানুষ ঈদ শেষে ঢাকায় যেতে শুরু করেছেন। গতকাল আমতলী লঞ্চঘাট থেকে প্রিন্স অব হাসান-হোসেন-১ এবং এমভি আচল লঞ্চ ধারণক্ষমতার চেয়ে পাঁচগুণ যাত্রী নিয়ে ঢাকার উদ্দেশে ছেড়ে গেছে। এ রুটে যাত্রীদের কাছ থেকে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করারও অভিযোগ পাওয়া গেছে। এ ছাড়া লঞ্চে যাত্রীদের অতিরিক্ত টাকা দিয়ে সিট কিনতে হয়েছে। বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ আমতলী লঞ্চঘাটে দ্বিগুণ টোল আদায় করছে।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, আমতলী-ঢাকা রুটে এমভি হাসান হোসেন, এমভি ইয়াদ ও এমভি সুন্দর বন-৫ নামের তিনটি লঞ্চ সার্ভিস রয়েছে। ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের সুবিধার জন্য অতিরিক্ত এমভি আঁচল, জলতরঙ্গ ও মানিক-৫ নামে তিনটি লঞ্চ দিয়েছে। এ লঞ্চ মালিকরা বিআইডব্লিউটিএসহ প্রশাসনকে ম্যানেজ করে যাত্রী ধারণ ক্ষমতার চেয়ে পাঁচ থেকে সাতগুণ বেশি যাত্রী পরিবহন করছে। এমভি ইয়াদ লঞ্চে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৩৯৬ জন, নেওয়া হয়েছে এক হাজার ২০০ থেকে এক হাজার ৫০০ জনকে। প্রিন্স অব হাসান-হোসেন-১ লঞ্চে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৩৪২ জন, নেওয়া হয়েছে এক হাজার থেকে দুই হাজার জনকে। এমভি সুন্দরবন-৫ লঞ্চে যাত্রী ধারণ ক্ষমতা ৪০০ জন, নেওয়া হয়েছে এক হাজার ৫০০ থেকে ১ হাজার ৮০০ জনকে। এ ছাড়া সরকার নির্ধারিত ভাড়ার চেয়ে অতিরিক্ত ভাড়া আদায় করা হয়েছে। আগে আমতলী-ঢাকা প্রথম শ্রেণির ভাড়া ছিল এক হাজার টাকা এবং ডেকের যাত্রীদের ভাড়া ছিল ৩০০ টাকা। ঈদের আটদিন আগে কোনো কারণ ছাড়াই এ ভাড়া বৃদ্ধি করে সিঙ্গেল কেবিন এক হাজার ২০০ টাকা, ডাবল কেবিন দুই হাজার ৪০০ টাকা এবং ডেকের ভাড়া ৩৫০ টাকা আদায় করা হয়।

গতকাল আমতলী লঞ্চঘাট ঘুরে দেখা গেছে, প্রিন্স অর হাসান-হোসেন-১ ও এমভি আঁচল লঞ্চ ধারণ ক্ষমতার চেয়ে পাঁচগুণ যাত্রী বহন করে ঢাকার উদ্দেশে ঘাট ছেড়েছে। এ লঞ্চ দুটিতে তিল পরিমাণ জায়গা ছিল না। মানুষ ডেকে জায়গা না পেয়ে লঞ্চের ছাদে অবস্থান নেন। অনেক যাত্রীকে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখা গেছে। এ ছাড়া এ ঘাটে বিআইডব্লিউটিএ কর্তৃপক্ষ দ্বিগুণ টোল আদায় করেছে। তবে প্রিন্স অব হাসান-হোসেন-১ লঞ্চের সুপারভাইজার আকরব হোসেন অতিরিক্ত যাত্রী নেওয়া ও ভাড়া আদায়ের কথা অস্বীকার করে বলেন, ঈদ উপলক্ষে যাত্রীদের চাপ বেশি, তাই সময়ের তিন ঘণ্টা আগেই আমতলী ঘাট থেকে লঞ্চ ছেড়ে এসেছি।

সর্বশেষ খবর