শনিবার, ১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিদেশিদের মনের ঘা শুকায়নি

জুলকার নাইন

বিদেশিদের মনের ঘা শুকায়নি

হলি আর্টিজানে ভয়াবহ হামলার এক বছর পরও বিদেশিদের শঙ্কা কাটেনি। সেই হামলার কারণে তাদের মনে তৈরি হওয়া দগদগে ঘা এখনো শুকায়নি। এখনো বাংলাদেশ ভ্রমণে নিরাপত্তা সংক্রান্ত সতর্কবার্তা প্রত্যাহার করেনি জাপানসহ কয়েকটি দেশ। আজ হলি আর্টিজান ঘটনার বর্ষপূর্তিতে আলোচিত সেই বাড়িটিতে নিহতদের প্রতি শ্রদ্ধা নিবেদন করতে যাবেন ঢাকার বিদেশি কূটনীতিক ও অন্যরা। এ উপলক্ষে ইতিমধ্যেই ঢাকায় এসেছেন ইতালি ও জাপানের দুটি প্রতিনিধি দল। তারাও  যাবেন হলি আর্টিজান বেকারির সেই আগের বাড়িটিতে। আলাদা আলাদাভাবে কয়েকটি স্মৃতিচারণ সভার আয়োজন করেছে ঢাকার বিদেশি কূটনৈতিক কোর, ইতালি, জাপান ও ভারতীয় মিশন। গত এক বছর ধরেই বাড়তি নিরাপত্তায় থাকায় কূটনৈতিক পাড়াকে গতকাল থেকে পুরোপুরি নিরাপত্তার চাদরে ঢেকে ফেলা হয়েছে।

জানা যায়, গত বছরের ১ জুলাই শুক্রবার রাতে বাংলাদেশকে স্তম্ভিত করে দেওয়া সন্ত্রাসী হামলা ঘটে হলি আর্টিজানে । রাত পৌনে ৯টার দিকে ৮ থেকে ১০ জন সন্ত্রাসী রেস্তোরাঁয় অতর্কিত হামলা চালিয়ে ২০ জন বিদেশি নাগরিকসহ ৩০-৩৫ জন লোককে জিম্মি করে রাখে। পরে বিদেশি নাগরিকসহ মোট ১৩ জনকে জীবিত এবং মোট ২০ জনের মরদেহ উদ্ধার করা হয়। নিহত ২০ জনের মধ্যে দুজন বাংলাদেশি, একজন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান, নয়জন ইতালীয়, সাতজন জাপানি ও একজন ভারতীয়। নিহত ইতালির নয় নাগরিক হলেন— আদেলে পুগলিসি, মারকো তোন্দা, ক্লদিয়া মারিয়া ডিআন্তোনা, নাদিয়া বেনেদেত্তি, ভিনসেঞ্জো ডিআলেস্ত্রো, মারিয়া রিভোলি, ক্রিস্তিয়ান রসি, ক্লদিয়া কাপেলি এবং সিমোনা মন্তি। দুই বাংলাদেশি হলেন— ট্রান্সকম গ্রুপের চেয়ারম্যান লতিফুর রহমানের নাতি ফারাজ হোসেন, ডেএক্সওয়াই ইন্টারন্যাশনালের মানবসম্পদ বিভাগের পরিচালক ইশরাত আখন্দ। নিহতদের মধ্যে রয়েছেন ভারতীয় তরুণী তারুশি জেইন। এ ছাড়া নিহত হন বাংলাদেশি বংশোদ্ভূত আমেরিকান অবিন্তা কবির। তিনি এলিগ্যান্ট কোম্পানির চেয়ারম্যান রুবা আহম্মেদের একমাত্র মেয়ে। অবিন্তা কবির ২০১৬ সালের ২৭ জুন বাংলাদেশে আসেন। এ ছাড়া সন্ত্রাসীদের সঙ্গে গোলাগুলিতে ডিবির সহকারী কমিশনার (এসি) রবিউল ইসলাম ও বনানী থানার অফিসার ইনচার্জ (ওসি) সালাউদ্দিন খান নিহত হন। হলি আর্টিজান হামলার ঘটনার দায় স্বীকার করেছে মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক আন্তর্জাতিক জঙ্গি সংগঠন ইসলামিক স্টেট (আইএস)। এই ধরনের অতর্কিত হামলা চালিয়ে মানুষজনকে জিম্মি করার ঘটনা বাংলাদেশে সেটিই ছিল প্রথম। তবে সরকারের পক্ষ থেকে বলা হয়েছে, এই হামলা দেশীয় জঙ্গিদেরই কাজ।

বর্ষপূর্তিতে বিভিন্ন আয়োজন : কূটনৈতিক সূত্রের খবর, হলি আর্টিজান রেস্তোরাঁয় সেই সন্ত্রাসী হামলার এক বছর পূর্তি উপলক্ষে ঢাকা এসেছেন ইতালির চার সদস্যের প্রতিনিধি দল। এর নেতৃত্বে রয়েছেন ইতালির পার্লামেন্টের পরিকল্পনা সংক্রান্ত স্থায়ী কমিটির ভাইস প্রেসিডেন্ট ও লোমবার্দি রাজ্য সরকারের কাউন্সিলর মার্কো তোসসিনি। তারা আজ বেলা ১১টায় যাবেন গুলশানের ৭৯ নম্বর রোডের সেই বাড়িটিতে। নিহতদের স্মরণে পুষ্পস্তবক অর্পণের পাশাপাশি মোম জ্বালিয়ে নীরবতা পালন করবেন তারা। শুধু ঢাকায় নয় দিনটি উপলক্ষে ইতালিতেও বিশেষ অনুষ্ঠানের আয়োজন করা হয়েছে। হামলায় নিহতদের নিবাস লোমাবার্দি রাজ্য সরকার বিশেষ প্রার্থনা ও শোক সভার আয়োজন করেছে সেখানে। অন্যদিকে, জাপানের পক্ষ থেকে নিহতের স্মরণে আনুষ্ঠানিকতা নিয়ে তেমন কোনো প্রচারণা পছন্দ করা হচ্ছে না। যদিও তাদের একটি প্রতিনিধি দল ইতিমধ্যেই ঢাকায় এসেছে। তবে এখন পর্যন্ত প্রাপ্ত খবর অনুসারে, জাপানের প্রতিনিধিরা আজ সকাল ৭টায় হলি আর্টিজানের সেই ভবনে যাবেন শ্রদ্ধা জানাতে। পুষ্পস্তবক অর্পণের পাশাপাশি জাপানি রীতি অনুসারে শ্রদ্ধা জানাবেন তারা।

জড়িত ৫ জঙ্গি এখনো অধরা : তদন্ত সংশ্লিষ্টরা বলছেন, এরই মধ্যে হামলা পরিকল্পনার পুরো ছক উদঘাটন হয়েছে। চলতি বছরই দেওয়া হবে গুলশানের হলি আর্টিজান মামলার তদন্ত প্রতিবেদন। তবে অধরা এখনো জড়িত পাঁচ জঙ্গি। ঢাকা মহানগর পুলিশের অতিরিক্ত কমিশনার মনিরুল ইসলাম বলেন, আমরা এখনো পাঁচজনকে খুঁজছি, তাদের নাম তদন্তে এসেছে। এই পাঁচজনের দুয়েকজনকে গ্রেফতার করতে পারলেও এই মামলার তদন্ত আমরা শেষ করব। এই পাঁচ জঙ্গির মধ্যে সোহেল মাহফুজ, রাশেদুল ইসলাম ওরফে র‌্যাশ ও বাশারুজ্জামান ওরফে চকলেট সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জানিয়ে তিনি বলেন, তাদের পেলে হয়তো আমরা একটি পূর্ণাঙ্গ চিত্র পাব। এর আগে গত বুধবার স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান কামাল জানিয়েছিলেন, খুব শিগগির গুলশানের অভিজাত হলি আর্টিজান বেকারিতে জঙ্গি হামলার নির্ভুল অভিযোগপত্র দেওয়া হবে। কোনো ত্রুটি ছাড়া অভিযোগপত্র দেওয়ার ব্যবস্থা নিচ্ছি এবং খুব শিগগির সেটা দিতে পারব। মামলার তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, পুরো ঘটনাটি ঘটায় নব্য জেএমবির জঙ্গিরা। গত বছরের এপ্রিলে হামলার জন্য বাছাই করা হয় ঢাকার তিন জঙ্গিকে। পরে আরও দুই জঙ্গিকে নিয়ে পাঁচজনের দল চূড়ান্ত করা হয়। মিরপুরের রূপনগরে নিহত জঙ্গি অবসরপ্রাপ্ত মেজর জাহিদের তত্ত্বাবধানে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয় গাইবান্ধার একটি চরে। হামলার টার্গেট ঠিক করা হয় হলি আর্টিজান বেকারি। তদন্তে জানা গেছে, অস্ত্র ও বিস্ফোরক কেনাসহ হলি আর্টিজান হামলায় ব্যয় হয়েছে ৮ থেকে ৯ লাখ টাকা। বেশিরভাগ টাকাই দিয়েছেন আজিমপুরে অভিযানে নিহত জঙ্গি তানভীর কাদরী। হামলায় ব্যবহূত অস্ত্র ও বিস্ফোরক চাঁপাইনবাবগঞ্জ ও যশোর সীমান্ত দিয়ে এনেছিল জঙ্গিরা। তদন্তের তথ্য ঘটনাস্থলে নিহত পাঁচ জঙ্গি ছাড়াও পরিকল্পনা ও বাস্তবায়নে জড়িত আট জঙ্গি আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর অভিযানে নিহত হয়েছে। গ্রেফতার  চারজনের মধ্যে তিনজন আদালতে স্বীকারোক্তিমূলক জবানবন্দি দিয়েছে। এখনো পলাতক পাঁচ জঙ্গি। এর মধ্যে সোহেল মাহফুজ ও বাসারুজ্জামান হামলার পরিকল্পনাকারী।

প্রত্যাহার হয়নি সতর্কবার্তা : হামলার এক বছর পরও কূটনীতিক পাড়ায় আতঙ্কে থেকে যাওয়ায় গত এক বছরে ধাপে ধাপে নিজস্ব নিরাপত্তা কর্মীর সংখ্যা বাড়িয়েছেন বিদেশিরা। ইউরোপের একটি দেশের কূটনীতিক গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সংস্থার হয়ে ঢাকায় কর্মরত বিদেশিদের একটা বড় অংশ যে গুলশানে থাকেন, সেখানে হামলার পর আতঙ্কে তাদের অনেকেই চলে গেছেন। অনেক বিদেশি চলে যাওয়ায় বাংলাদেশে উন্নয়ন প্রকল্পগুলো পিছিয়ে যায়।’ সূত্র জানায়, সেই ঘটনার এক বছর পেরিয়ে গেলেও জাপানের নিরাপত্তা সতর্কতা তুলে নেওয়া হয়নি। উন্নয়ন সংস্থা জাইকার স্বেচ্ছাসেবী কর্মীরাও আর ফিরে আসেনি বাংলাদেশে। গত মাসে জাপান সফরে গিয়ে বাংলাদেশের পররাষ্ট্র প্রতিমন্ত্রী শাহরিয়ার আলম সেদেশের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে নিরাপত্তা সতর্কতা তুলে নেওয়ার অনুরোধ জানিয়েছেন। কিন্তু সেই অনুরোধের কোনো ইতিবাচক সাড়া দেয়নি জাপান।

আরও কড়াকড়ি : হলি আর্টিজানের বর্ষপূর্তিকে ঘিরে কূটনৈতিক পাড়ার নিরাপত্তায় আরও কড়াকড়ি আরোপ করা হয়েছে। গতকাল গুলশান-বারিধারা এলাকায় আগের নিরাপত্তা চৌকিগুলোর পাশাপাশি নতুন আরও আধাডজন নিরাপত্তা চৌকি দেখা গেছে। দিনভর টহল দিতে দেখা গেছে বিডিআরের টহল দলকে। পুলিশ-র‌্যাবের টহল দলও ছিল নিয়মিত। এ ছাড়া অত্যাধুনিক অস্ত্রে সজ্জিত পুলিশ দাঁড়ানো দেখা গেছে গুলশান-বারিধারার প্রত্যেক মোড়ে। মিশনগুলোর সামনেও ছিল বাড়তি নিরাপত্তা। তবে আলোচিত সেই বাড়িটি বা সেই ৭৯ নম্বর সড়কে সব কিছুই ছিল স্বাভাবিক। নিরাপত্তা ব্যবস্থাও ছিল আগের মতো।

সর্বশেষ খবর