মঙ্গলবার, ৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

পার্থক্য শুধু লেজ নাড়ানো

গোলাম মাওলা রনি

পার্থক্য শুধু লেজ নাড়ানো

আমাদের পাড়ার একটি বেওয়ারিশ সারমেয়কে নিয়ে মহল্লাবাসীর আগ্রহ এবং উৎসাহ-উদ্দীপনা দিনকে দিন বেড়েই চলেছে। সব বয়সের মানুষই সারমেয়টিকে দেখামাত্র এক গাল হাসি দিয়ে ক্ষণিকের তরে পথিমধ্যে দাঁড়িয়ে যান। তারপর আতু! আতু! আয় আয়! চুক চুক ইত্যাদি শব্দ করে নিজেদের মধ্যে তুমুল প্রতিযোগিতার মাধ্যমে তাকে কাছে ডেকে নেওয়ার প্রয়াস চালান। সারমেয়টি গত কয়েক মাসের মধ্যে মানুষ চেনার ব্যাপারে বেশ দক্ষ হয়ে উঠেছে। কোন লোকটি ডেকে নিয়ে তাকে খাদ্য দেবে এবং কে তার সঙ্গে ফাঁকিবাজি করবে তা সে অনায়াসে বুঝতে পারে। আর সে কারণেই বহু লোকের আতু আতু ডাকের মধ্যে প্রাণীটি নির্ভুলভাবে এমন একজনের সামনে গিয়ে লেজ নাড়িয়ে আনুগত্য প্রকাশ আরম্ভ করে দেয় যিনি সারমেয়র লেজ নাড়ানো, মাথা ঝোঁকানো এবং পা চাটার ইতিউতি চেষ্টার মজা লোটার জন্য অনেক আগে থেকেই বিস্কুট অথবা চিপ কিনে রেখে দেন। এই সারমেয় ছাড়াও আমাদের পাড়ায় আরও ১০-১২টি হৃষ্টপুষ্ট রূপবান বা রূপবতী সারমেয় ঘোরাফেরা করে। কিন্তু ওগুলোর দিকে কারও নজর নেই। মানুষ শুধু লেজ নাড়ানো এবং আনুগত্য প্রদর্শনকারী সারমেয়টির ব্যাপারেই আগ্রহী। মানুষের এই অদ্ভুত আদিখ্যেতা দেখতে গিয়ে আমার প্রায়ই ভারতবর্ষের প্রাচীনকালের বিখ্যাত কবি বানভট্ট এবং তার জমানার মহামতি শাসক সম্রাট হর্ষবর্ধনের কথা মনে পড়ে যায়। বানভট্টের কাব্য প্রতিভা এবং অতি উঁচুমাত্রার জ্ঞান-গরিমা সর্বজন স্বীকৃত ছিল। কিন্তু তার চাটুকারিতা এবং স্বার্থসিদ্ধির জন্য বাহারি পদ্ধতির পদলেহনের কলাকৌশল নিয়ে লোকজনের ঠাট্টা-মশকরা, তুচ্ছতাচ্ছিল্য এবং ঘৃণা প্রকাশেরও কোনো কমতি ছিল না। বানভট্ট হলেন সর্বকালের অন্যতম সেরা বুদ্ধিজীবী এবং সম্রাট হর্ষবর্ধনের সভাকবি। তাঁর চাটুকারিতা সম্পর্কে বলতে গিয়ে সম্রাট বলেছিলেন, শাসকের সবচেয়ে বিপদ ও বিপত্তি হলো বুদ্ধিমান চাটুকার এবং সবচেয়ে আশ্চর্যজনক হলো এই শ্রেণির লেজ নাড়ানো চাটুকার ছাড়া আবার কোনো শাসক চলতেও পারেন না। বানভট্ট প্রকৃতির কবি, সাহিত্যিক, বুদ্ধিজীবী ইত্যাদি শ্রেণির আনুগত্য, চাটুকারিতা, মাথা নোয়ানো, হাত কচলানো এবং কোমর দোলানোর সঙ্গে সামঞ্জস্য রেখে জিহ্বা নাড়ানোর বাহারি কসরৎ তাদের আরাধ্য মুনিবের মনোরঞ্জনে কতটা ফল বয়ে আনতে পারে তা নিয়ে যদি কেউ নির্ভুল গবেষণা করতে চান তবে লেজ নাড়ানো সারমেয়দের গতি-প্রকৃতির পর্যবেক্ষণ আপনাকে যথেষ্ট সাহায্য করবে। সারমেয়দের সঙ্গে চাটুকারদের কতগুলো মৌলিক অমিল রয়েছে। পশুগুলো লেজ নাড়ায় সামান্য কিছু ভালো খাবারের আশায়। পথের ধারের ময়লা আবর্জনা, মনুষ্য বর্জ্য ইত্যাদির পরিবর্তে কিছু সারমেয় উন্নত মনুষ্য খাদ্যের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে সেগুলো পাওয়ার জন্য মানুষের তাঁবেদারি শুরু করে। কোনো লোভ-লালসা কিংবা হীনতর স্বার্থের কবলে পড়ে কোনো সারমেয় কোনোকালে লেজ নাড়ায়নি। বিশ্বাসঘাতকতা, প্রতারণা, চুরি, ডাকাতি বা রাহাজানির উদ্দেশ্য নিয়ে কোনো সারমেয় কোনোকালে মানুষের তাঁবেদারি করে মানুষকে বিভ্রান্তির জালে ফেলে স্বার্থসিদ্ধি করেছে এমন একটি উদাহরণ এযাবৎকালে পৃথিবীতে ঘটেনি। সামান্য একটু বিস্কুট অথবা এক টুকরা মাংসের জন্য লেজ নাড়ানোর আগে সব সারমেয় নিজেদের মনমানসিকতাকে পরিপূর্ণভাবে দাতার প্রতি কৃতজ্ঞ করে তোলে। পশুগুলো তাদের চোখ, মুখ এবং শরীরে তাদের কৃতজ্ঞতা, আনুগত্য এবং বিশ্বাসযোগ্যতার চিহ্নসমূহ নিখুঁতভাবে ফুটিয়ে তোলে। তারা অন্তরের অন্তস্থলে দাতার জন্য একটি স্থান তৈরি করে ফেলে। তারা একবার যদি কারও কাছ থেকে কোনো দান গ্রহণ করে তবে সারাটি জীবন দাতার প্রতি কৃতজ্ঞ থাকে। তারা সর্বাত্মক চেষ্টা-তদ্বির করে দাতার বিপদে সাহায্য করে এবং ক্ষেত্রবিশেষে প্রাণটিও উৎসর্গ করে দেয়। পশুরা বিনা প্রয়োজনে যেমন মানুষের তাঁবেদারি করে না তেমনি লোভের বশবর্তী হয়ে দল পরিবর্তন করে না। লেজ নাড়ানো সারমেয়দের প্রসঙ্গ বাদ দিয়ে চাটুকার ও তেলবাজ লোকজন নিয়ে কিছু বলার চেষ্টা করি। অনাদিকালের সব চাটুকার এবং তেলবাজের দুটি মৌলিক বৈশিষ্ট্য রয়েছে। তারা সবাই প্রচণ্ড কাপুরুষ এবং লোভী। তারা একদিকে যেমন মোনাফেক অন্যদিকে প্রচণ্ড স্বার্থপর। তাদের কৃপণতা এবং নীচতার সঙ্গে তুলনা করা যায় এমন কোনো পশুপাখি, কীটপতঙ্গ কিংবা বৃক্ষলতা এখনো ধরাধামে পয়দা হয়নি। তাদের চরিত্রহীনতা, নিষ্ঠুরতা এবং অত্যাচার করার ক্ষমতা অতুলনীয়। অলসতা এবং অপব্যয় তাদের অলঙ্কার। অশ্লীল কর্ম, অঙ্গভঙ্গির অশ্লীলতা, বাচালতা এবং অদ্ভুত পোশাক-আশাক হলো তাদের জাতীয় পরিচয়ের প্রধানতম লক্ষণ। সুসময়ে দম্ভ প্রদর্শন এবং বিপদে লেজ গুটিয়ে পালানো যেমন তাদের চিরায়ত অভ্যাস, তেমনি অকৃতজ্ঞ হওয়া এবং ক্ষেত্রবিশেষে উপকারীর ক্ষতিসাধনকে তারা রীতিমতো গর্বের বস্তু বলে ধ্যানজ্ঞান করে। বেহায়াপনা, অপমানিত ও লাঞ্ছিত হওয়াকে ভাত-মাছ মনে করা তাদের মজ্জাগত অভ্যাস। তাদের সবচেয়ে ক্ষতিকর বৈশিষ্ট্য হলো তারা মনে করে যে, তাদের মালিক নিতান্ত বোকা, অসহায় এবং দুর্বল। তারা আরও মনে করে যে, তাদের মালিক বাধ্য হয়ে এবং একান্ত নিজের প্রয়োজনের তাগিদে তাদের পোষেণ। উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের আলোকে আপনারা ইচ্ছে করলেই লেজ নাড়ানো সারমেয় এবং সমঅভিধায় অভিষিক্ত মনুষ্য শ্রেণির পার্থক্য নিজেরা নিরূপণ করতে পারবেন। এক্ষেত্রে আমি শুধু একটি কথা বলে আজকের প্রসঙ্গের ইতি টানব, আর তা হলো— লেজ নাড়ানো সারমেয়রা মরে গেলেও তার দাতা, প্রভু কিংবা খাদ্যদানকারীকে দংশন করে না। অন্যদিকে চাটুকার, তেলবাজ এবং তাঁবেদার প্রকৃতির লোকেরা সময় ও সুযোগ পেলে সবার আগে তার মালিকের এমন সব ক্ষতি করে বসে যা সাধারণত কোনো শত্রুরা কল্পনাও করে না।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর