বুধবার, ৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

সরকারের ঘরে বাইরে চ্যালেঞ্জ

প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়সহ পুরো প্রশাসন ঢেলে সাজানো। অভ্যন্তরীণ স্যাবোটাজ মোকাবিলা। দল ঢেলে সাজানো। বিতর্কিত মন্ত্রী-এমপি ও সহযোগী সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ি বন্ধ রাখা উন্নয়ন ধারাবাহিকতা অব্যাহত রাখা। সকল প্রকল্পের কাজ দ্রুত বাস্তবায়ন করা

নিজামুল হক বিপুল ও রফিকুল ইসলাম রনি

সরকারের ঘরে বাইরে চ্যালেঞ্জ

আগামী এক বছরে সরকারকে ঘরে-বাইরে ব্যাপক চ্যালেঞ্জ মোকাবিলা করতে হবে। একদিকে দল ও সরকারের প্রতি আস্থাভাজন কর্মকর্তাদের দিয়ে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন ঢেলে সাজাতে হবে। পাশাপাশি সরকারের বিভিন্ন সংস্থাকেও নির্বাচনমুখী অবস্থানে নিয়ে যেতে হবে। একই সঙ্গে নিজদলে কিংবা প্রশাসনে অন্তর্ঘাতমূলক (স্যাবোটাজ) কর্মকাণ্ড হয় কিনা— সেদিকেও রাখতে হবে সতর্ক দৃষ্টি। বিতর্কিত মন্ত্রী-এমপি ও সহযোগী সংগঠনগুলোর নেতা-কর্মীদের বাড়াবাড়ি বন্ধ না করলে জনমনে বিরূপ প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হতে পারে।

একই সঙ্গে দেশব্যাপী নির্বাচনী ঢেউ তুলতে মাঠ পর্যায় থেকে শুরু করে সর্বত্র সংগঠন ঢেলে সাজাতে হবে। আগামী নির্বাচনে বিতর্কিতদের বাদ দিয়ে মনোনয়ন দিতে হবে মাঠ পর্যায়ে গণসম্পৃক্ত নেতাদের। এর পাশাপাশি সরকারের যেসব চলমান ও গুরুত্বপূর্ণ উন্নয়ন প্রকল্প রয়েছে সেগুলোও নির্ধারিত সময়ে বাস্তবায়ন না করা গেলে সমস্যা বাড়বে। সরকারের অনেক উন্নয়ন প্রকল্পে ধীরগতি কাটিয়ে গতি আনতে হবে। বর্তমান সরকারের একজন মন্ত্রী বলেন, গত কুমিল্লা সিটি করপোরেশন নির্বাচন থেকে আওয়ামী লীগের জন্য অনেক কিছু শিক্ষণীয় আছে। সেখানে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসন মন্ত্রী-এমপিদের কথা শোনেনি। আগামী দুই বছর বাকিটা বোঝা যাবে। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকারের দ্বিতীয় মেয়াদের শেষ সময়ে এসে অনেক ক্ষেত্রে একটা হ-য-ব-র-ল অবস্থা দেখা যাচ্ছে। ভিতরে-বাইরে সরকার নানামুখী চ্যালেঞ্জের মধ্যে সময় পার করছে। বিশেষ করে সিভিল ও পুলিশ প্রশাসনে এক ধরনের গা ছাড়া ভাব দেখা যাচ্ছে। অথচ বর্তমান সরকারই সবচেয়ে বেশি সুযোগ-সুবিধা দিয়েছে প্রশাসনযন্ত্রকে। পদোন্নতি, পদায়ন থেকে শুরু করে বেতন-ভাতাসহ আর্থিক সুবিধা আগের যে কোনো সরকারের চেয়ে বর্তমান সরকার বেশি দিয়েছে। এত সুযোগ-সুবিধার পরও প্রশাসনে সরকারের অবস্থা আগের যে কোনো সময়ের চেয়ে খারাপই বলা যায়।

স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের একজন অতিরিক্ত সচিব নাম প্রকাশ না করার শর্তে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, প্রশাসনের সবাই এখন আওয়ামী লীগার। কিন্তু সময়মতো এদের কাউকেই পাশে পাবে না আওয়ামী লীগ। ওই কর্মকর্তা বলেন, প্রশাসনের গুরুত্বপূর্ণ অনেক পদেই বসে আছেন বিএনপি-জামায়াতের সমর্থক কর্মকর্তারা। তারা ঘাপটি মেরে আছেন। সুযোগ পেলেই সুর পাল্টাবেন। অথচ যারা আওয়ামী লীগের জন্য নিবেদিত, তারা পদোন্নতি ও ভালো এবং গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন থেকে বঞ্চিত। তথ্য মন্ত্রণালয়ের একজন কর্মকর্তা বলেন, বিগত দু-তিন বছরে যাদের নানা গুরুত্বপূর্ণ পদে পদায়ন করা হয়েছে তাদের বেশির ভাগই সুবিধাবাদী এবং সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন কর্মকর্তা। অথচ ভুল তথ্য দিয়ে প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তাদের গুরুত্বপূর্ণ জায়গায় পদায়ন করতে সহযোগিতা করেছেন। এমন অসংখ্য নজির আছে। প্রশাসনের সংশ্লিষ্ট সূত্রগুলো বলছে, প্রধানমন্ত্রীর দফতর থেকে শুরু করে সব গুরুত্বপূর্ণ দফতরেই সরকারবিরোধী মনোভাবাপন্ন কর্মকর্তারা বসে আছেন নানা দায়িত্বে। সরকারের হাতে সময় এখন একেবারেই কম। এই স্বল্প সময়ের মধ্যে মাঠ প্রশাসন থেকে শুরু করে প্রশাসনের উচ্চ পর্যায় পর্যন্ত সকল স্তরে সরকার এবং আওয়ামী লীগের প্রতি আনুগত্য আছে এমন দক্ষ, সৎ, যোগ্য এবং বিশ্বস্ত কর্মকর্তাদের পদায়ন দিয়ে প্রশাসন ঢেলে না সাজালে আগামী নির্বাচনে আওয়ামী লীগকে খেসারত দিতে হতে পারে। একইভাবে পুলিশ প্রশাসনকেও ঢেলে সাজাতে হবে। কারণ নির্বাচনে মাঠ পর্যায়ে পুলিশ প্রশাসনের ভূমিকা খুবই গুরুত্বপূর্ণ। শেখ হাসিনার নেতৃত্বে দ্বিতীয় মেয়াদে সরকার গঠিত হয়েছিল ২০১৪ সালে। প্রথম মেয়াদের অসমাপ্ত কাজের পাশাপাশি সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে এসেও আরও বেশকিছু বড় বড় উন্নয়ন প্রকল্প গ্রহণ করে। কিছু কিছু প্রকল্পের কাজ শেষ হলেও বেশির ভাগই এখন পর্যন্ত অসমাপ্ত বা চলমান। কিন্তু সরকারের হাতে সময় আছে প্রায় দুই বছর। এই সময়ের মধ্যে উন্নয়ন প্রকল্পগুলোর কাজ শেষ করতে হবে। রাজধানী ঢাকাকে যানজটমুক্ত করতে সরকার মেট্রোরেল বা এমআরটি লাইন-৬, বাস র‌্যাপিড ট্রানজিট (বিআরটি) নির্মাণের উদ্যোগ নিয়েছে। বর্তমান মেয়াদে এ দুই প্রকল্পের প্রাথমিক অনেক কাজ শেষও হয়েছে। ২০১৯ সালের মধ্যে এমআরটি লাইন-৬-এর একটি অংশের কাজ শেষ করার কথা থাকলেও এ প্রকল্পে এখন পর্যন্ত দৃশ্যমান কাজই শুরু হয়নি। উত্তরা তৃতীয় প্রকল্প থেকে মতিঝিল বাংলাদেশ ব্যাংক পর্যন্ত মেট্রোরেল প্রকল্পের একাংশ উত্তরা থেকে আগারগাঁও পর্যন্ত চালু হওয়ার কথা ২০১৯-এর মধ্যেই। একইভাবে বিআরটি প্রকল্পের কাজও আগামী নির্বাচনের আগে শেষ করার কথা। কিন্তু দৃশ্যমান কাজ এখনো দেখা যাচ্ছে না। যদিও এ প্রকল্পের একাধিক চুক্তি ইতিমধ্যে শেষ হয়েছে। রাজধানীকেন্দ্রিক এ দুই মেগা প্রকল্প ছাড়াও বিমানবন্দর থেকে কুতুবখালী পর্যন্ত উড়ালসড়ক নির্মাণের কাজেও খুব একটা গতি নেই। এগুলোয় গতি বাড়ানোর পাশাপাশি সব উন্নয়ন কর্মকাণ্ড অব্যাহত রাখতে হবে। প্রশাসনের মতোই দেশজুড়ে আওয়ামী লীগের ভিতরে নানামুখী সমস্যা, সংকট ও বিশৃঙখলা বিরাজমান। তাই সবার আগে দলের তৃণমূলে শৃঙ্খলা ফেরাতে হবে। জেলায় জেলায় নেতায় নেতায় দ্বন্দ্ব। এমপি-মন্ত্রীর সঙ্গে নেতা-কর্মীদের দূরত্ব— সেগুলো কমিয়ে আনতে হবে। আগামী একটি বছর ছাত্রলীগ, যুবলীগসহ দলের অপকর্মকারী কতিপয় নেতা-কর্মীর লাগাম টেনে রাখতে হবে। কিছু বিতর্কিত এমপি-মন্ত্রী ও নেতার অতিকথন বন্ধ করতে হবে। দেশে রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা ধরে রাখতে হবে। আগামী নির্বাচনে বিজয়ী হতে হলে সব জঞ্জাল দূর করে দলকে আরও সুসংগঠিত করতে হবে। না হলে আওয়ামী লীগকে বড় খেসারত দিতে হবে— এমনটাই মনে করছেন দলসংশ্লিষ্টরা। উন্নয়নশীল দেশের অগ্রগতি ও উন্নতির ক্ষেত্রে সবচেয়ে সমস্যা হচ্ছে দুর্নীতি। দুর্নীতি বন্ধে সরকারকে আরও কঠোর হতে হবে। গত রবিবার সচিবদের সঙ্গে বৈঠকে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা দুর্নীতি বন্ধে কঠোর হুঁশিয়ারি উচ্চারণ করেছেন। সরকারের উন্নয়ন প্রকল্পগুলো দ্রুততম সময়ে শেষ করার নির্দেশ দিয়েছেন।

সরকারসংশ্লিষ্টরাও বলছেন, দুর্নীতি রোধ ও স্বচ্ছতা নিশ্চিত করা সরকারের সামনে অন্যতম চ্যালেঞ্জ। সরকারের বিগত মেয়াদের পাঁচ বছরে অঢেল সম্পদের মালিক হওয়া মন্ত্রী-এমপির কেউ কেউ বর্তমান মন্ত্রিসভায় স্থান পাননি। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, বর্তমান মন্ত্রিসভায় যারা নানাভাবে সমালোচিত তাদের আগামীতে দলীয় মনোনয়ন দেওয়া থেকে বিরত রাখতে হবে। সেখানে সর্বজনগ্রহণযোগ্য ক্লিন ইমেজের প্রার্থী বেছে নিতে হবে— এমনটাই মনে করেন রাজনৈতিক বিশ্লেষকরা। দল ও সরকারসংশ্লিষ্টরা বলছেন, বাংলাদেশের প্রেক্ষাপটে পরপর তিনবার রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় আসা খুবই কঠিন। তবে আওয়ামী লীগ সরকার বিগত নির্বাচনে যেসব প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল, সেগুলো কতটুকু বাস্তবায়ন করেছে এবং কতগুলো বাস্তবায়নে সক্ষম সে বিষয়ে জনগণকে জানাতে হবে। আস্থা তৈরি করতে হবে। আওয়ামী লীগকে এই সংক্ষিপ্ত সময়ে তা করতে হবে। সরকারের বর্তমান উন্নয়ন ও আগামীর ভিশন সম্পর্কে মানুষের মধ্যে গণজাগরণ সৃষ্টি করতে পারলে কোনো কিছুই কঠিন নয়।

সর্বশেষ খবর