বুধবার, ৫ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

চ্যালেঞ্জের মুখে ইউরোপীয় ভিসা

বাংলাদেশি ইস্যুতে কড়াকড়ির নীতিগত সিদ্ধান্ত

জুলকার নাইন

ইউরোপের ২৮ দেশের ভিসা পাওয়ার ক্ষেত্রে চ্যালেঞ্জের মুখে পড়তে যাচ্ছেন বাংলাদেশিরা। ইউরোপের সেনজেন ভিসা বা দেশগুলোর ভিসা ইস্যু করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশিদের জন্য কড়াকড়ি নীতিগত সিদ্ধান্ত নিয়েছে ইউরোপীয় ইউনিয়ন (ইইউ)। গত সপ্তাহে বেলজিয়ামে ইইউ নেতাদের আনুষ্ঠানিক বৈঠকের এ সিদ্ধান্ত উদ্বেগ তৈরি করেছে বাংলাদেশের ব্যবসায়ী মহল ও প্রবাসীদের মধ্যে। তারা বলছেন, এত দিন এ ধরনের ইঙ্গিত পাওয়া গেলেও আনুষ্ঠানিক কোনো সিদ্ধান্তের কথা শোনা যায়নি। এখন সত্যিকার অর্থেই বাংলাদেশিদের জন্য এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়া হলে এর নেতিবাচক প্রভাব পড়বে বিভিন্ন ক্ষেত্রে। এমনিতেই টানা চার বছর ধরে ইতালির মৌসুমি শ্রমবাজারে বাংলাদেশকে রাখা হয়েছে কালো তালিকায়।

কূটনৈতিক সূত্রের খবর, অভিবাসন ইস্যুতে এমনিতেই কঠোর অবস্থানে থাকা ইইউ বাংলাদেশিদের ক্ষেত্রে শৃঙ্খলা ফিরিয়ে আনা নিয়ে চিন্তিত। এ পরিস্থিতির উত্তরণেই ভিসা ইস্যুকে ব্যবহার করতে চাইছে ইউরোপ। সাম্প্রতিক সময়ে সমুদ্রপথে ইউরোপে গিয়ে বাংলাদেশিদের রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার ঢল, কয়েক বছর ধরে ভিসার নিয়ম লঙ্ঘনের আধিক্য ও বিশালসংখ্যক অবৈধ অবস্থানকারীকে ফিরিয়ে নেওয়ার বিষয়ে বাংলাদেশের আগ্রহ না দেখানোয় বাংলাদেশের বিষয়ে এ ধরনের সিদ্ধান্ত নেওয়ার কথা বলছে ইউরোপ। ইইউর দাবি, ইউরোপের বিভিন্ন দেশে প্রায় ৮০ হাজার বাংলাদেশি প্রয়োজনীয় কাগজপত্র বা ভিসা ছাড়া অবৈধভাবে অবস্থান করছেন। এ নিয়ে ঢাকার কর্মকর্তাদের সঙ্গে কয়েক দফায় আলোচনাও করেছেন ইইউ কর্মকর্তারা। বার্তা সংস্থা রয়টার্স এক প্রতিবেদনে জানিয়েছে, ব্রাসেলসের বৈঠকে বাংলাদেশ ও নাইজেরিয়াসহ বেশ কয়েকটি দেশ তাদের নাগরিকদের ফিরিয়ে নিতে অনীহা দেখাচ্ছে বলে উল্লেখ করেছেন ইইউ নেতারা। এ জন্য এই দেশগুলোর অবৈধ অভিবাসীদের ফেরত পাঠাতে ইইউ তার চেষ্টাকে আগের তুলনায় দ্বিগুণ করার সিদ্ধান্ত নিয়েছে। এরই অংশ হিসেবে শরণার্থীর আড়ালে সাগরপথে অনুপ্রবেশ ঠেকাতে ‘তৃতীয় দেশগুলোর জন্য ভিসা নীতি’ পর্যালোচনা এবং ভিসা ইস্যুর ক্ষেত্রে কড়াকড়ি আরোপসহ সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেওয়ার সিদ্ধান্ত নেন ইইউ নেতারা। জানা যায়, ২০১৪ সাল থেকে ভূমধ্যসাগর পাড়ি দিয়ে আসা অভিবাসীদের ঢলের বিরুদ্ধে সাঁড়াশি অভিযান চালাচ্ছে ইইউ।। ইউরোপের কঠোর অবস্থানের ফলে সর্বশেষ চলতি বছর এসে সাগরপথে ইউরোপে প্রবেশের মোট সংখ্যা কমেছে। কিন্তু বাংলাদেশিদের প্রবেশের সংখ্যা বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। লিবিয়া থেকে দালালদের মাধ্যমে নৌকায় চড়ে ইউরোপে প্রবেশের জন্য ইতালির বন্দরে যাওয়ার তালিকায় শীর্ষে পৌঁছে গেছে বাংলাদেশ। এ ছাড়া পোল্যান্ড ও সাইপ্রাসে শিক্ষা-ভিসায় গিয়ে ইউরোপে স্থায়ীভাবে বসবাসের জন্য চলে যাওয়ার সংখ্যাও বেড়েছে আশঙ্কাজনকভাবে। পাশাপাশি বাংলাদেশে তেমন কোনো গুরুতর পরিস্থিতি বিরাজ না করলেও বাংলাদেশিরা রাজনৈতিক আশ্রয় প্রার্থনার ক্ষেত্রে যুদ্ধবিধ্বস্ত দেশগুলোকেও ছাড়িয়ে যাচ্ছে। তবে যোগাযোগ করা হলে ঢাকার পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের শীর্ষ এক কর্মকর্তা বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ইউরোপে অবৈধভাবে অবস্থানকারীদের ফিরিয়ে নেওয়ার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ অনীহা দেখিয়েছে এমন অভিযোগ সত্য নয়। ইইউর কর্মকর্তা এ বিষয়ে বাংলাদেশের সঙ্গে আলোচনা করতে এলে বরং সম্পূর্ণ সহযোগিতার কথা বলা হয়েছে। সর্বশেষ মে মাসে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক ব্রাসেলস সফরে ইউরোপের অভিবাসনবিষয়ক কমিশনার দিমিত্রিজ আভ্রামোপোলাসকে সম্ভাব্য সব পদক্ষেপ নেওয়ার আশ্বাস দিয়ে এসেছেন। এর আগে ঢাকায় ইইউ কর্মকর্তাদের সঙ্গে বৈঠকে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে অবৈধদের বিষয়ে সুনির্দিষ্ট করে তালিকা ও তথ্য চাওয়া হয়েছে।

 আন্তর্জাতিক অভিবাসনের রীতি অনুসরণ করে যে কোনো পরিস্থিতিতে নাগরিকদের নিজ দেশে ফিরিয়ে আনতে বাংলাদেশ পারঙ্গম ও বদ্ধপরিকর বলেও জানানো হয়েছে ইইউ কর্মকর্তাদের। বৈধ অভিবাসনের স্বার্থে বাংলাদেশ সব পরিস্থিতির জন্য তৈরি বলেই জানানো হয়েছে। কিন্তু এরপর আর বিস্তারিত কোনো তালিকা বা তথ্য দেননি ইইউ কর্মকর্তারা। ইতিমধ্যে ইইউতে বাংলাদেশের প্রতিনিধি ও বেলজিয়াম মিশনকে এ ইস্যুতে খোঁজখবর নেওয়ার দায়িত্ব দেওয়া হয়েছে উল্লেখ করে ঢাকার আরেক কূটনীতিক বলেন, তবে ইউরোপে অবৈধ অনুপ্রবেশ বা এক ধরনের ভিসা নিয়ে অন্যায়ভাবে অন্য ধরনের কর্মকাণ্ড সম্পর্কে বাংলাদেশও উদ্বিগ্ন। সাগরপথে ইউরোপ যাত্রা ঠেকাতে বাংলাদেশ থেকে লিবিয়ায় যাওয়ার জন্য কোনো অনুমোদনও দেওয়া হয় না বেশ কিছুদিন ধরেই। কিন্তু অসাধু জনশক্তি ব্যবসায়ী ও পাচারকারীদের যোগসাজশে অনেকেই দুবাই, তুরস্ক হয়ে লিবিয়া গিয়ে পৌঁছাচ্ছে। আবার শিক্ষা-ভিসার অপব্যবহার না করার জন্য বারবার সতর্কও করছে সরকার। ঢাকার পররাষ্ট্র দফতরের কর্মকর্তারা বলছেন, ভিসা ইস্যুতে এখনই তেমন উদ্বেগজনক পরিস্থিতি হয়তো তৈরি হবে না। কিন্তু অবৈধ প্রবেশ ও অবস্থানের সংখ্যা দিন দিন যে হারে বাড়ছে তাতে ভবিষ্যতে কী হবে তা বলা যাচ্ছে না। অভিবাসন বিশেষজ্ঞ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের রিফিউজি অ্যান্ড মাইগ্রেটরি মুভমেন্টস রিসার্চ ইউনিটের (রামরু) প্রতিষ্ঠাতা চেয়ারপারসন ড. তাসনিম সিদ্দিকীর বলেন, ‘ভিসা কড়াকড়ি করার ব্যাপারে ইউরোপীয় ইউনিয়নের এ সিদ্ধান্ত গ্রহণযোগ্য নয়। এটাকে আমি অন্যায় ও বিশ্বায়নবিরোধী মনে করি। আর এটা করে অবৈধ অভিবাসন ঠোকানো যাবে না। বরং যাদের পড়াশোনাসহ নানা কাজে ইউরোপের দেশে যেতে হয়, তারা হয়রানির মুখে পড়বেন।’ তিনি বলেন, এ সিদ্ধান্তে বাংলাদেশের অনেক ক্ষতি হবে। শিক্ষা, গবেষণা, ব্যবসা ও উন্নয়নবিষয়ক কাজে এ সিদ্ধান্ত বাধার সৃষ্টি করবে। বাংলাদেশের জ্ঞান-বিজ্ঞান ক্ষতির মুখে পড়বে। বাংলাদেশের উচিত জোরের সঙ্গে এ সিদ্ধান্তের বিরোধিতা করা।

সর্বশেষ খবর