বৃহস্পতিবার, ৬ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বৃষ্টি হলে ঢাকাও ডুবে যায় দিনভর ভোগান্তি

নিজস্ব প্রতিবেদক

বৃষ্টি হলে ঢাকাও ডুবে যায় দিনভর ভোগান্তি

টানা বর্ষণে ডুবে গেছে রাজধানীর ব্যস্ততম মতিঝিল এলাকা —রোহেত রাজীব

বৃষ্টি হলেই ঢাকার সড়কে হাঁটু পানি। বর্ষায় অনেক সড়ক খাল-বিলে পরিণত হয়। এই কর্মব্যস্ত ঢাকা মহানগরীর সড়কগুলোয় জলজট আর জনজটে জনদুর্ভোগের যেন কোনো সীমা-পরিসীমা নেই।

এক-দুই দিন নয়, প্রতিবছরই বর্ষাকালে একটু ভারি বৃষ্টিপাতে ঢাকায় স্কুল শিক্ষার্থী, শ্রমজীবী, চাকরিজীবীসহ সর্বস্তরের মানুষকে এই চরম ভোগান্তিতে পড়তে হয়। সরকারের সংশ্লিষ্ট বিভাগগুলোর এই সমস্যা সমাধানে স্থায়ী কোনো উদ্যোগ নেই। ফলে মানুষেরও দুর্ভোগ থেকে মুক্তি নেই।

গত দুই দিনের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর মানুষ বিশেষ করে নিম্নাঞ্চলের মানুষ এক প্রকার পানিবন্দী হয়ে পড়েছেন। বৃষ্টিতে তলিয়ে গেছে মতিঝিল, বঙ্গবাজার, পল্টন, নাজিমউদ্দিন রোড ও পুরান ঢাকাসহ বিভিন্ন এলাকা। মিরপুর, শ্যামলী, কালশী, খিলক্ষেত, রায়ের বাজার, মোহাম্মদপুর, রামপুরা, বাড্ডা, খিলগাঁও, জুরাইন, পূর্ব-জুরাইনসহ বিভিন্ন এলাকায় সড়ক ও নিম্নাঞ্চলের বাসাবাড়িতে পানি জমে থাকার খবর পাওয়া গেছে। আবহাওয়া অধিদফতর জানিয়েছে, এই জলজটে আরও দুই দিন কষ্ট করতে হবে নগরবাসীকে। আকাশে মৌসুমি বায়ু থাকায় আজ ও আগামীকাল সারা দেশে থেমে থেমে বৃষ্টি হবে। আবহাওয়াবিদ হাফিজুর রহমান গতকাল রাতে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে জানান, আগামী ৭২ ঘণ্টার পর আবহাওয়ার উন্নতি হতে পারে। আর আগামী দুই দিন (আজ ও আগামীকাল) সারা দেশে থেমে থেমে বৃষ্টি হবে। পরের পাঁচ দিন বৃষ্টিপাত আবার বাড়তে পারে। ভারি বর্ষণে পাহাড়ি অঞ্চলে ভূমিধসের আশঙ্কাও আছে।

নগরীর বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে, মতিঝিল আইডিয়াল স্কুল অ্যান্ড কলেজের সামনের সড়কে হাঁটু পানিতে এক শিক্ষার্থীকে নিয়ে রাস্তা পার হচ্ছেন এক অভিভাবক। এই সড়কে কোনো যানবাহন চলাচলের অবস্থা নেই। বাধ্য হয়েই হাঁটু পানি ভেঙে চলাচল করতে হচ্ছে শিক্ষার্থী-অভিভাবক ও সাধারণ পথচারীদের। নটর ডেম কলেজের সামনের সড়কেও পানি। মতিঝিল এলাকার ব্যস্ততম এই সড়কে পানিতে আটকে গেছে অনেক গাড়ি। সৃষ্টি হয়েছে ব্যাপক যানজট। মতিঝিলের বিভিন্ন ব্যাংক ও আর্থিক প্রতিষ্ঠান এবং বাণিজ্যিক প্রতিষ্ঠানের ভিতরেও ঢুকে পড়েছে পানি। বঙ্গভবনের প্রাচীর ঘেঁষে মেয়র মোহাম্মদ হানিফ ফ্লাইওভারের নিচে ফজলে রাব্বি রোডেও সৃষ্টি হয়েছে জলাবদ্ধতা। সেখানে কোমর পানিতে বিপাকে পড়েছেন নগরবাসী। পুরান ঢাকার আদালত পাড়ায় জলাবদ্ধতায় দুর্ভোগে পড়েন বিচারক, আইনজীবী ও বিচারপ্রার্থী হাজার হাজার মানুষ।

নগরজুড়ে দেখা গেছে, মঙ্গলবার রাতের টানা বৃষ্টিতে রাজধানীর বিভিন্ন এলাকা তলিয়ে গেছে। গতকাল সকাল থেকে কর্মমুখী মানুষদের ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়েছে। বিভিন্ন সড়কে জলাবদ্ধতার কারণে যানজটের পাশাপাশি পরিবহন সংকটও দেখা গেছে। বৃষ্টির কারণে খানাখন্দে ভরা সড়কগুলোতে দুর্বিষহ পরিস্থিতি হয়েছে। পরিবহন সংকটে পড়েন কর্মজীবীরা। অফিসগামীদের পড়তে হয় চরম দুর্ভোগে।

গতকাল সকালে রাজধানীর কদমতলীর আয়েশা মোশাররফ মার্কেটের পূর্ব গেটে বৃষ্টির জমা পানিতে বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হয়ে একজন নিহত হয়েছেন। ওই মার্কেটের ব্যবসায়ীরা জানিয়েছেন, বৃষ্টির জমা পানির ওপর বিদ্যুতের তার ছিঁড়ে পড়েছিল। এ সময় সকাল সাড়ে ১১টায় ওই মার্কেটের আল মদিনা কাপড়ের দোকান মালিক মো. ইউনূস (৪৫), তার ভাগ্নে সাঈদুল ইসলাম (৩৪) ও দোকান কর্মচারী মো. লিটন (৩০) ওই পথ দিয়ে দোকানে যাচ্ছিলেন। এসব পানিতে পা পড়া মাত্র তিনজনই বিদ্যুত্স্পৃষ্ট হন। পরে তাদের উদ্ধার করে দুপুর পৌনে ১টায় ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতাল জরুরি বিভাগে নেওয়া হয়। কর্তব্যরত চিকিৎসক লিটনকে মৃত ঘোষণা করেন। তার বাসা দনিয়ায়।

ডিএনডিতে তলিয়ে গেছে ৯৫ ভাগ এলাকা : নারায়ণগঞ্জ প্রতিনিধি জানান, ভয়াবহ বিপর্যয়ে রয়েছেন ডিএনডি এলাকার লাখ লাখ মানুষ। টানা বৃষ্টিপাতে সৃষ্ট কৃত্রিম জলাবদ্ধতায় ডিএনডির প্রায় ৯৫ ভাগ এলাকা তলিয়ে গেছে। কোনো বাড়ির ছাদে দাঁড়িয়ে দেখলে মনে হচ্ছে ডিএনডি একটি দ্বীপ। উঁচু এলাকায় হাঁটু পানি। নিচু এলাকায় কোমর পানি। প্রত্যেকটি এলাকার বহুতল ভবনের নিচতলা তলিয়ে গেছে। টিনশেড ঘরে কোমর পানি। মসজিদ, মন্দির, স্কুল সব স্থাপনা তলিয়ে গেছে।

এ অবস্থায় কয়েকটি এলাকায় মাছের খামারে থাকা নৌকা বিনাশ্রমে পরোপকারে যাত্রী পারাপার করছে। বেশিরভাগ এলাকায় মানুষের যানবাহন এখন ভ্যান। শিশু বাচ্চাদের কাঁধে চড়িয়ে হাঁটুর ওপর কাপড় তুলে চলছেন মানুষ। নিরুপায় বাসিন্দাদের অনেকেই বাড়িঘর ছেড়ে নিকটতম স্বজনের বাড়িঘরে আশ্রয় নিয়েছেন।

গতকাল দুপুরে সরেজমিন ডিএনডির ভিতর ফতুল্লার রামার বাগ, সস্তাপুর, গাবতলী, কায়েমপুর, চাঁদমারী, ইসলাম বাগ, শহীদ নগর, মাসদাইর, ইসদাইর, গাবতলী, এনায়েত নগর, তল্লা, সবুজবাগ, কুতুবপুর, পাগলা, দেলপাড়া, আলীগঞ্জ, দাপা, পিলকুনি, ভুইগড়, রঘুনাথ পুর, কুতুবপুর লামাপাড়া, তুষারধারা, শান্তিধারা, সিদ্ধিরগঞ্জের আইলপাড়া, পাঠান টুলি, নয়ামাটি, হাজীগঞ্জ, গোপটা, গোদনাইল, ধনকুণ্ডা, জালকুড়ির, পাইনাদী নতুন মহল্লা, সিআইখোলা, মিজমিজি পাগলা বাড়ি, মুজিববাগ, আল আমিন নগর, ডেমরার বাহির টেংরা, বক্সনগর, পশ্চিম সানারপাড়, সৈয়দপাড়াসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে দেখা গেছে এমন চিত্র। ভোগান্তি নিয়ে কথা হয় ডিএনডির সাধারণ মানুষের সঙ্গে। প্রচণ্ড ক্ষোভ আর হতাশা তাদের মাঝে। ডিএনডি সমস্যা সমাধানে সরকারের অবহেলায় ক্ষুব্ধ সাধারণ মানুষ।

ক্ষোভের কথা বলতে গিয়ে কেঁদে ফেলেন ফতুল্লার ডিএনডির কাপুড়াপট্টি এলাকার বাসিন্দা হালিমা বিবি (৬০)। তিনি বলেন, ‘দেখেন আমার ঘরের অবস্থা। ঘরের ভিতর কোমর পানি। রান্নাঘর তলিয়ে গেছে। ডুবে গেছে সব আসবাবপত্র। আর কতদিন এ কষ্ট? পাশের বাড়ির দোতলায় গিয়ে অনুরোধ করে রান্না করেছি। প্রতিবছর শুনি ডিএনডি নিয়ে সরকারের উন্নয়নের কথা। আর কত মিথ্যা কথা শুনব?’

রাস্তায় গিয়ে দেখা যায়, বড়দের কাঁধে কাঁধে ছোট ছোট শিশুরা। এক হাতে কাঁধে থাকা শিশুকে সামাল দিয়ে অন্য হাতে লুঙ্গি নিয়ন্ত্রণ করা হচ্ছে যাতে ভিজে না যায়। রিকশাসহ অন্যান্য যানবাহন চলাচল না করায় মাথায় চালের বস্তা নিয়ে জলমগ্ন রাস্তা পার হচ্ছেন এক ভুক্তভোগী। ছবি তুলতেই বিরক্ত হয়ে বলেন, ‘রাখেন আপনেগো ছবি, বহুত তুলছেন। আপনেরা ছবি তুললেই পানি বাইড়া যায়। কোন আশার কথা থাকলে বলেন।’

করুণ চিত্র দেখা যায় মধ্য ইসদাইর সর্দার বাড়ির সুফিয়া বেগমের ঘরে। পানির মধ্যে দাঁড়িয়ে সুফিয়া বলেন, ‘দেখেন ঘরের অবস্থা। তোশক, খাট, চেয়ার সব ডুবে গেছে। বিছানার ওপর বসার মতোও গতি নাই। ঘরের প্লাস্টিকের সেন্ডেল ভাসছে।’ গাবতলী এলাকায় গিয়ে দেখা গেছে, গাবতলী জামে মসজিদের একতলা পুরো তলিয়ে গেছে।

প্রসঙ্গত, ডিএনডিবাসীর সমস্যা লাঘবে নারায়ণগঞ্জ-৪ আসনের সংসদ সদস্য শামীম ওসমান গত বছর এক ঝটিকা সফরে নিয়ে এসেছিলেন পানিসম্পদমন্ত্রী আ হ ম মুস্তফা কামালকে। শামীম ওসমান মন্ত্রীকে তখনকার ডিএনডির জলাবদ্ধ কবলিত এলাকা ঘুরিয়ে দেখান। তার এ প্রচেষ্টায় ডিএনডির উন্নয়নে মাস্টারপ্ল্যান হাতে নিয়ে ৫৭০ কোটি টাকার এক বাজেট পাস করা হয়। সেনাবাহিনীর তত্ত্বাবধানে শিগগিরই কাজ শুরু হবে বলেও জানান সংসদ সদস্য। সরকার ওই অর্থ ছাড় করলেই সংস্কার কাজ শুরু হবে ডিএনডির— সে প্রত্যাশাই এখন এ এলাকার মানুষের। তবে জানা গেছে, পানি সম্পদ মন্ত্রণালয়ের নকশা সংক্রান্ত কোনো সমস্যার কারণে আটকে গেছে সেই উন্নয়ন কর্ম।

ডিএনডির এলাকার শিক্ষক আনিছুর রহমান জানান, এ পরিস্থিতির জন্য ডিএনডিবাসী অনেকটা দায়ী। পানি প্রবাহের পর্যাপ্ত জায়গা না রেখে অপরিকল্পিতভাবে বাড়ি-ঘর, কলকারখানা নির্মাণ, পানি নিষ্কাশন খালে সরাসারি শিল্প ও আবাসিক বর্জ্য ফেলায় কোথাও কোথাও পানি নিষ্কাশন খাল অবৈধ দখলে চলে গেছে। অভিযোগ রয়েছে, উপজেলা প্রশাসনের অসাধু কর্তারা এসব অবৈধ দখল উচ্ছেদ করছে না রহস্যজনক কারণে।

জানা গেছে, ৫০ বছরের পুরনো পাম্প দিয়ে দ্রুত পানি নিষ্কাশন না হওয়ায় জলাবদ্ধতার কবলে পড়ছে ডিএনডিবাসী। এতে প্রতি বছরই বর্ষা মৌসুমে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়ে চরম দুর্ভোগ পোহাতে হয় ডিএনডিবাসীর। ডিএনডি পাম্প হাউস কর্তৃপক্ষ বলছে, যদি আরও বৃষ্টি হয় দুর্ভোগ ভয়াবহ রূপ ধারণ করবে। প্রতি সেকেন্ডে ৩ হাজার কিউসেক পানি নিষ্কাশন করা প্রয়োজন। কিন্তু তিনটি পাম্প দিয়ে প্রতি সেকেন্ডে ১২৮ কিউসেক পানি নিষ্কাশন করা হচ্ছে। তাও ৫০ বছরের পুরনো পাম্প হওয়ায় এগুলো অনেকটা অকেজো হয়ে পড়েছে। প্রতি বছর মেরামত করে জোরাতালি দিয়ে পাম্প চালানো হচ্ছে। এ জলাবদ্ধতা থেকে দ্রুত মুক্তি পেতে হলে এলাকাভিত্তিক পাম্প স্থাপন করে পানি নিষ্কাশন করা ছাড়া কিছুই করার নেই।

সূত্র মতে, ১৯৬৫-৬৮ সালে প্রায় সাড়ে ৮ হাজার হেক্টর জমি নিয়ে ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ-ডেমরা (ডিএনডি) ইরিগেশন প্রজেক্ট চালু হয়। ৩২ দশমিক ৮ কিলোমিটার দৈর্ঘ্য বাঁধের (ডিএনডির) ভিতর শুষ্ক মৌসুমে সেচ প্রদান এবং বর্ষা মৌসুমে জমে থাকা পানি নিষ্কাশনের জন্য সেচ খাল ৯টি, ডিটিও খাল ৯টি, আউট লেক খাল এবং ১০টি নিষ্কাশন খালসহ এক কিলোমিটার দীর্ঘ ইনটেক খাল ও ১৩ কিলোমিটার দীর্ঘ মেইন ক্যানেল টার্ন আউট খাল রয়েছে। এসব খাল দিয়ে জমিতে সেচ দেওয়া ও পানি নিষ্কাশনের জন্য শিমরাইল পাম্প হাউসে প্রতিটি ১২৮ কিউসেক ক্ষমতাসম্পন্ন চারটি পাম্প থাকলেও একটি অকেজো। এ ছাড়াও ছোট ৫ কিউসেক ২২টি পাম্প থাকলেও মাত্র পাঁচটি পাম্প সচল রয়েছে বলে জানা গেছে।

জলাবদ্ধতার বিষয়ে শিমরাইলের পাম্প হাউসের উপ-সহকারী রাম প্রসাদ বাছার জানান, হাউসে পাম্পের লেভেল ৩.৩৫ মিটার। গত মঙ্গলবার রাতে ও গতকাল সকালে ছিল ৩ এর নিচে। এখন লেভেল ভালো। সমস্যা হচ্ছে মূল ক্যানেলে পানি সহজে এসে ভরাট হয়ে থাকলে এলাকায় জমে থাকা পানি কমে যেত। কিন্তু পানি মূল ক্যানেলে আসতে অনেক বাধা পেরুতে হচ্ছে। সেজন্য মানুষের ভোগান্তি বাড়ছে। পাম্পে থাকা তিনটি পাম্পই চালানো হচ্ছে। তিনি ধারণা করে বলেন, কিছুদিন আগে টানা ১৫ দিন থেমে থেমে হওয়া বৃষ্টির পানি নিষ্কাশন করতে ১২ দিন লেগে গেছে।

আরেক কর্মকর্তা নাম প্রকাশ না করার শর্তে বলেন, ‘খাল দখল, বিভিন্ন স্থানে পানি আটকে মাছ চাষ, খালগুলো ২০১৫ সালে পরিষ্কার করা হলেও গত দুই বছরে কোনো খাল পরিষ্কারের ব্যবস্থা নেই। উপজেলা প্রশাসনে কিছু অথর্ব লোক বসে আছে। তারা কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না। মূল ক্যানেলে পানি আনতে প্রত্যেকটি এলাকায় যদি একটি করে অস্থায়ী সেচ পাম্প লাগিয়ে দিত— তাহলে এত ভোগান্তি হতো না। মূলত যারা এসব কাজ করবে— তারা চেয়ারে বসে মজা দেখছে।’

সর্বশেষ খবর