রবিবার, ৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

বিমান কেন ডানা ভাঙা

শিডিউল মেনে না চলা, আর্থিক সংকট, দুর্নীতি, কেনাকাটা-টেন্ডারে অনিয়ম, দীর্ঘসূত্রতা, অপচয়সহ সমস্যার পাহাড়

নিজস্ব প্রতিবেদক

বিমান কেন ডানা ভাঙা

পরিচালনা পর্ষদের পরিবর্তন হয়। আসে নতুন পর্ষদ। কাজ শুরু হয় নতুন উদ্যমে। আশা জাগায় নতুন করে। কিন্তু সময় গড়ানোর সঙ্গে সঙ্গে সেই আশার আলো ফিকে হতে থাকে। আশা তখন চরম হতাশায় রূপ নেয়। আকাশ পরিবহনে বাংলাদেশের জাতীয় পতাকাবাহী একমাত্র সংস্থা বাংলাদেশ বিমান এয়ারলাইন্সে এখন চরম হতাশা। সংশ্লিষ্টরা বলছেন, পর্ষদে মানুষের পরিবর্তনই শুধু হয়েছে। কাজের পরিবর্তন নেই। বিমান চলছে সেই আগের মতোই। নতুন পর্ষদেও সেই যুগের পরিবর্তন আসছে না। শিডিউল মেনে না চলা, আর্থিক সংকট, দুর্নীতি, কেনাকাটা, টেন্ডার প্রদানে অনিয়ম, সিদ্ধান্ত গ্রহণে দীর্ঘসূত্রতা, অপচয়, গ্রাউন্ড হ্যান্ডেলিং কার্যক্রম সবকিছুই আগের মতোই চলছে। দুর্নীতি আর অনিয়ম বেড়েছে বিমানের বৈদেশিক অফিসগুলোতেও। ভাড়ায় নেওয়া উড়োজাহাজও এখন যেন বিমানের গলার কাঁটা।

সংশ্লিষ্টরা বলছে, বিগত পর্ষদ আমলে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স যেভাবে দুর্নীতিতে নিমজ্জিত ছিল, সেখান থেকে তুলে আনা এখন কঠিন কাজ হয়ে দাঁড়িয়েছে। যে কারণে বিমানের ডানা ভাঙাই থেকে যাচ্ছে।

লিজের উড়োজাহাজ গলার কাঁটা : বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স সাতটি অভ্যন্তরীণ রুটে প্রতিদিন ১৬টি ফ্লাইট পরিচালনা করছে মূলত ৭৪ আসন বিশিষ্ট দুটি ড্যাস-৮ এয়ারক্রাফট দিয়ে। মিসরের একটি এয়ারক্রাফট লিজিং কোম্পানি থেকে পাঁচ বছরের লিজে এয়ারক্রাফট দুটি ২০১৫ সালের শুরুতে আনা হয়। চুক্তির অর্ধেক সময় পার না হতেই উড়োজাহাজ দুটিতে দেখা দিয়েছে নানা সমস্যা। ফলে যে কোনো সময় বিকল হতে পারে বিমানের ড্যাস উড়োজাহাজ দুটি।

মিসরের স্মার্ট এভিয়েশন নামে এয়ারক্রাফট লিজিং কোম্পানি থেকে আনা দুটি ড্যাশ-৮ কিউ-৪০০ উড়োজাহাজ বিমান বহরে ২০১৫ সালে যুক্ত করে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্স। কম গতিসম্পন্ন পুরাতন এ ধরনের উড়োজাহাজ দিয়ে ওই বছর থেকে চালু করা হয় বন্ধ থাকা অভ্যন্তরীণ বেশ কয়েকটি রুট। এদিকে চুক্তির অর্ধেক সময় পার না হতেই উড়োজাহাজ দুটিতে দেখা দেয় নানা সমস্যা। গেল ঈদের চারদিন আগে স্পর্শকাতর সময়ে দুটি উড়োজাহাজ একসঙ্গে নষ্ট হলে অভ্যন্তরীণ রুটগুলোতে চরম শিডিউল বিপর্যয় দেখা দেয়।

খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, বিমানের তৎকালীন চেয়ারম্যান জামাল উদ্দিনের সময়ে পরিচালনা পর্ষদ এই এয়ারক্রাফট দুটি আনেন। এয়ারক্রাফট দুটি লিজের শর্ত অনুযায়ী, প্রয়োজনে তিন বছর পর ফেরত দেওয়া যাবে। নাম প্রকাশ না করার শর্তে বিমানের ড্যাস-৮ চালানো একজন পাইলট বলেন, বহরে থাকা লিজে আনা উড়োজাহাজ দুটির অবস্থা খুব ভালো না। অভ্যন্তরীণ রুটে ফ্লাইট পরিচালনা নির্বিঘ্ন করতে বিমান বহরে নিজস্ব এয়ারক্রাফট দরকার। পুরাতন দুটি ড্যাস-৮ উড়োজাহাজ এখন বিমানের গলার কাঁটা।

টিকিট নিয়ে তুঘলকি কাণ্ড : দেশে-বিদেশে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের যে কোনো অফিসে টিকিটের জন্য গেলে সবসময় শুনতে পাওয়া যায় টিকিট নেই। কিন্তু সেই ফ্লাইটে ভ্রমণে দেখা যায় অনেক সিট্ খালি। মাঝে মাঝেই বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইন্সের প্রায় যাত্রীশূন্য ফ্লাইট চলাচল করে।

জানা গেছে, দুই বছর আগেও বোয়িং ৭৭৭ উড়োজাহাজ ভরে রিয়াদ থেকে যাত্রী আসত। এখন সেই একই উড়োজাহাজ অর্ধেক ফাঁকা আসছে। রিয়াদ প্রবাসী বশির আহমেদ জানান, বিমানের স্টেশন ম্যানেজার হেলাল উদ্দিন সেখানে বসে নিজের ভাগ্য গড়তে মার্কেটিংয়ের সর্বনাশ করছেন। তার বিরুদ্ধে রয়েছে আদম ও ট্রাভেল ব্যবসা। তাকে বদলি করেও ঢাকা আনতে পারছে না বিমান। তার কমিশন বাণিজ্যে অতিষ্ঠ হয়ে রিয়াদ প্রবাসী যারা আগে বিমানের ফিক্সড যাত্রী ছিলেন, তারা এখন সৌদিয়াতে যাতায়াত করছেন। রিয়াদের মতো একই অবস্থা ব্যাংকক, দুবাই, মাস্কট, কুয়েত, দোহা, বাহরাইন, লন্ডন, সিঙ্গাপুর, মালয়েশিয়া ও রেঙ্গুন রুটে। বিমানে আয়ের চেয়ে ব্যয়ের বড় উৎস এসব স্টেশনের অব্যবস্থাপনা ও দুর্নীতির কারণে যাত্রী সংখ্যা আশঙ্কাজনক হারে কমে যাওয়া।

বৈদেশিক স্টেশনে দুর্নীতি : দুর্নীতি, অনিয়ম আর লুটপাটের আখড়ায় পরিণত হয়েছে বিমানের বৈদেশিক অফিসগুলো। টিকিট বিক্রি, জ্বালানি তেল বিক্রি, যাত্রীদের দেওয়া কর ও এক্সেস ব্যাগেজ বিক্রির অর্থ জমা না দিয়ে প্রতি বছর কোটি কোটি টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে এ অফিসগুলোর বিরুদ্ধে। যন্ত্রপাতি ক্রয়ের ক্ষেত্রে ঘটেছে দুর্নীতি। ভুয়া বিল ভাউচারের মাধ্যমে টাকা আত্মসাতের ঘটনাও ঘটেছে।

ব্যাংকক থেকে দেশের অন্য দুটো বেসরকারি এয়ারলাইন্স ইউএস বাংলা ও রিজেন্ট এয়ার ওয়েজ যেখানে উড়োজাহাজ ভরে যাত্রী আনছে—সেখানে বিমান যাত্রী পাচ্ছে না। গড়ে প্রতিটি ফ্লাইটে ৫০ জন যাত্রীও আসছে না বলে জানা গেছে। সেখানকার দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আবুল কালাম ও নজরুল ইসলাম নিজস্ব স্টাইলে নিজেদের ভাগ্য গড়ছেন। বিমানের গাড়ি বাড়ি ব্যবহার করছেন ইচ্ছে মতো। তাদের সন্তানদের লেখাপড়া করাচ্ছেন। একদিনও তারা ব্যাংকক প্রবাসী বাংলাদেশিদের কাছে বিমানে চড়ার জন্য মার্কেটিং করেননি। তাদেরকে বিমানবন্দরে কোনো যাত্রী প্রয়োজনেও পায় না। রিয়াদের অবস্থা আরও ভয়াবহ। সেখানে বিপুল সংখ্যক প্রবাসী বাংলাদেশি থাকলেও তাদের বিমানে চড়ার জন্য কোনো প্রমোশনাল কাজ করছেন না দায়িত্বপ্রাপ্ত কর্মকর্তা হেলাল। বরং তার স্বেচ্ছাচারিতা, কার্গো বাণিজ্য ও আদম ব্যবসার দরুন যাত্রীরা বিমান থেকে মুখ ফিরিয়ে নিয়েছে। এ অবস্থায় সম্প্রতি ঢাকা থেকে আমিন নামে একজনকে রিয়াদে বদলি করার পরও হেলাল রিয়াদ ছাড়তে গড়িমসি করছেন। যোগ্যদের পদোন্নতিবঞ্চিত বিমানের প্রকৌশল শাখা প্রতিটি উড়োজাহাজের ফিটনেস ও রক্ষণাবেক্ষণের কাজে নিয়োজিত। অথচ এমন একটি গুরুত্বপূর্ণ শাখার পরিচালক পদটি তিন মাস ধরে শূন্য ফেলে রাখা হয়েছে। এখানকার পরিচালক উইং কমান্ডার আসাদুজ্জামান গত মার্চে চলে যাওয়ার আগে যদি বিমান নিয়োগ প্রক্রিয়া শুরু করত তাহলে একদিনও পদটি শূন্য থাকত না।

যাত্রী হয়রানি : ইমিগ্রেশনের সব কাজ সঠিকভাবে সম্পন্ন হওয়ার পরও বিমানবন্দরের বোর্ডিং কাউন্টারে পাসপোর্ট ইউনিটে হয়রানি করা হচ্ছে যাত্রীদের। সম্প্রতি জান্নাত সুলতানা নামে সৌদি প্রবাসী এক তরুণীর পাসপোর্টে ভিসার মেয়াদ শেষ হয়ে যাওয়ার অভিযোগে আটকে রেখে তার কাছে মোটা অঙ্কের উেকাচ দাবি করে জাহিদ নামের এক বিমানকর্মী। এভাবে প্রতিদিন পিসিই শাখায় চলছে যাত্রী হয়রানি।

কোনো ব্যবস্থা নেই : বিমানের এক পাইলট ও কো-পাইলট চাকার সেফটি পিন না খুলে আকাশে ঝুঁকিপূর্ণভাবে উড্ডয়ন করেছিলেন। পরে ৫০ মিনিট পর ফের জরুরি অবতরণ করলেও ঘটনায় অভিযুক্ত পাইলটের বিরুদ্ধে কোনো ব্যবস্থা নেওয়া হয়নি। পাইলটের অদক্ষতার কারণে বিমানের একটি উড়োজাহাজ ল্যান্ডিং করতে গিয়ে ১০টি টায়ার ফেটে যায়। এতে মোটা অঙ্কের টাকা ক্ষতি গুনতে হয়েছে বিমানকে। বিমানবন্দরের গ্রাউন্ড সার্ভিস বিভাগের রি-ফুয়েলিং (জ্বালানি তেল ভরা) শেষ করে চাকার সেফটি পিন খোলা ও পুশকার্ড মেশিন চালু করে যখন ফ্লাইট উড্ডয়ন করবে তখন পর্যন্ত চলে বিমানের অনিয়ম-দুর্নীতি।

এ ছাড়া বাংলাদেশ বিমান ও বিমানবন্দর, বিমানের গন্তব্য শিডিউল সবকিছু বেশিরভাগ সময় হ-য-ব-র-ল হয়ে যায়। বিমানের শিডিউল ঠিক থাকে না। বিদেশের মাটিতে সেই কারণে বিমানকে অতিরিক্ত মোটা অঙ্কের টাকা  খেসারত দিতে হয়। রাজনৈতিক নগ্ন হস্তক্ষেপ, আমলাদের লুলোপ আক্রমণ, রাজনৈতিক দেউলিয়াপনা, আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরের আপগ্রেডেশন প্রকল্প নামে বিদেশ ভ্রমণ, টেন্ডারবাজি, প্রকল্পের পরামর্শক সেবা প্রকল্প, পর্যটন মোটেল নির্মাণ, সম্প্রসারণসহ বহু নাম দিয়ে চলছে অহরহ লুটপাট।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর