রবিবার, ৯ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

জঙ্গি অর্থায়নে কঠোর নজরদারি

অস্বাভাবিক লেনদেনে ১৭ এনজিও, সন্দেহে কয়েকটি স্কুল-কলেজ, কুরিয়ার সার্ভিস আছে হাসপাতাল-ক্লিনিকও, কড়া নিয়ম মেনে মোবাইল ব্যাংকিং হিসাব খুলতে হবে

মানিক মুনতাসির

দেশে জঙ্গি অর্থায়ন ঠেকাতে সব ধরনের আর্থিক লেনদেনকে কঠোর নজরদারির আওতায় এনেছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা এবং বাংলাদেশ ফিন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট (বিএফআইইউ)। পাশাপাশি অস্বাভাবিক লেনদেনের অভিযোগের ভিত্তিতে দেশি-বিদেশি ১৭টি বেসরকারি উন্নয়ন সংস্থার (এনজিও) সার্বিক কার্যকলাপ গোয়েন্দাদের কঠোর নজরদারিতে আনা হয়েছে। এসব এনজিওর বিরুদ্ধে জঙ্গি অর্থায়নের তথ্য-প্রমাণ হাতে পেয়েছে বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থা। শুধু তাই নয় ব্যাংকিং খাতের প্রতিটি লেনদেনকে অধিক যাচাই-বাছাইয়ের পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। বিশেষ করে অনলাইনভিত্তিক যেসব লেনদেন হয়ে থাকে সেগুলোর ওপর পৃথকভাবে মনিটরিং জোরদার করতে দেশের সফল তফসিলি ব্যাংককে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।

এখন থেকে ব্যাংক হিসাব খুলতে গ্রাহকের যেসব তথ্যের প্রয়োজন পড়ে সেসব তথ্য মোবাইল ব্যাংকিংয়ের হিসাব খোলার ক্ষেত্রেও আবশ্যকীয় করার কথা ভাবছে সরকার। মোবাইল ব্যাংকিংয়ের এজেন্টদের নির্ধারিত অফিসিয়াল ঠিকানা ব্যবহার করা বাধ্যতামূলক করা হচ্ছে। পাশাপাশি তাদের মাধ্যমে হওয়া লেনদেনের যাবতীয় তথ্য নির্ধারিত রেজিস্টারে সংরক্ষণ করতে হবে। এবং সময় সময় তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকে জমা দিতে হবে। প্রয়োজনে বাংলাদেশ বা বিএফআইইউ তা সংশ্লিষ্ট ব্যাংকের কাছ থেকে তদন্তের কাজে ব্যবহার করতে পারবে।

এদিকে কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে টাকা আদান-প্রদানেও কড়াকড়ি আরোপ করা হচ্ছে। প্রেরকের পূর্ণ ঠিকানা সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক। এমন কি বেঁধে দেওয়া হবে একক লেনদেনের সীমা। এ ছাড়া জঙ্গি অর্থায়নের সন্দেহের তালিকায় রয়েছে বেসরকারি স্কুল-কলেজ, কোচিং সেন্টার, হাসপাতাল, মাদ্রাসা, ক্লিনিক, সামাজিক সংগঠনও। এসব প্রতিষ্ঠানেও বিভিন্ন গোয়েন্দা সংস্থার নজরদারি বাড়ানোর পরামর্শ দিয়েছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়। গত ২১ জুন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে অনুষ্ঠিত দেশে জঙ্গি অর্থায়নের উৎস অনুসন্ধান কার্যক্রম আরও জোরদারকরণ এবং কার্যক্রম অধিকতর সমন্বয়ের লক্ষ্যে গঠিত টাস্কফোর্সের তৃতীয় সভায় এসব সিদ্ধান্ত হয়েছে। বৈঠকে সভাপতিত্ব করেন শিল্পমন্ত্রী ও এই টাস্কফোর্সের প্রধান আমির হোসেন আমু। এতে উপস্থিত ছিলেন স্বরাষ্ট্রমন্ত্রী আসাদুজ্জামান খান, পররাষ্ট্রমন্ত্রী, পুলিশের আইজি, র‌্যাবের মহাপরিচালক, বিএফআইইউর মহাব্যবস্থাপক, বাংলাদেশ ব্যাংকের গভর্নর, এনজিওবিষয়ক ব্যুরোর মহাপরিচালক, পুলিশের স্পেশাল ব্র্যাঞ্চের ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি, ডিজিএফআইএর ঊর্ধ্বতন প্রতিনিধি, ডিএমপি কমিশনার এবং ইসলামিক ফাউন্ডেশনের মহাপরিচালকসহ বিভিন্ন মন্ত্রণালয় ও বিভাগের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা। বৈঠকের কার্যপত্রে উল্লেখ করা হয়েছে, মোবাইল ব্যাংকিং এবং কুরিয়ার সার্ভিসের মাধ্যমে এখনো সবচেয়ে বেশি জঙ্গি অর্থায়নের ঘটনা ঘটছে। এজন্য এ ধরনের প্রতিটি লেনদেনকে কঠোর দজরদারির আওতায় আনার পরামর্শ দেওয়া হয়েছে। এমন কি মোবাইল ব্যাংকিং এবং কুরিয়ার সার্ভিসের প্রতিটি লেনদেনের তথ্যাদি সংরক্ষণ বাধ্যতামূলক করার নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে। এদিকে ২০১২ সালে যেসব এনজিওর বিরুদ্ধে জঙ্গি সংশ্লিষ্টতার অভিযোগ উঠেছিল সেগুলোতে দীর্ঘ সময় নজরদারির পর আরও সঠিক তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে। এসব এনজিওর বেশিরভাগই জামায়াত শিবির নিয়ন্ত্রণাধীন। এরা কুয়েত, কাতার, সৌদি আরব, বাহারাইনসহ মধ্যপ্রাচ্যভিত্তিক সাহায্যপুষ্ট বিদেশি এনজিও। এ ছাড়া কয়েকটি দেশীয় এনজিও রয়েছে এই তালিকায়। এরমধ্যে ‘বাংলাদেশ চাষি কল্যাণ সমিতি’ মুসলিম এইড বাংলাদেশ, রাবেতা আল-আলম আল-ইসলামি, কাতার চ্যারিটিবল সোসাইটি, ইসলামিক রিলিফ এজেন্সি, আল ফুরকান ফাউন্ডেশন, কুয়েত জয়েন্ট রিলিফ কমিটি, ইন্টারন্যাশনাল ইসলামিক রিলিফ অর্গানাইজেশন (আইআইআরও), হায়াতুল ইগাছা, রিভাইবাল অব ইসলামিক হেরিটেজ সোসাইটি (আরআইএইসএস), তাওহিদী নূর এবং আল মুনতাদা আল ইসলামি অন্যতম। এসব এনজিওর সামগ্রিক কার্যকলাপের ওপর চলছে কড়া নজরদারি। এ প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিএফআইইউর মহাব্যবস্থাপক দেবপ্রসাদ দেবনাথ বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সেখানে অনেক বিষয়ে আলোচনা হয়েছে। কিছু বিষয়ে গুরুত্বপূর্ণ সিদ্ধান্ত হয়েছে। এর মধ্যে জঙ্গি অর্থায়ন প্রতিরোধের বিষয়টি অত্যন্ত স্পর্শকাতর এবং গুরুত্বপূর্ণ। যেসব প্রতিষ্ঠানের বিরুদ্ধে এমন তথ্য-প্রমাণ পাওয়া গেছে সেগুলোর বিরুদ্ধে নজরদারি বাড়ানো হয়েছে বলে জানান তিনি।  এদিকে নিরাপত্তা বিশ্লেষক মেজর জেনারেল (অব.) আবদুর রশীদ বলেন, ধর্মীয় বিষয়কে কাজে লাগিয়ে অনেক সংস্থাই জঙ্গি অর্থায়নের ঘটনা ঘটাচ্ছে। আবার তাদেরকে ধরাও যাচ্ছে না। অনেক সময় আইনের ফাঁকফোকর দিয়ে দায়ী ব্যক্তি বা প্রতিষ্ঠান পার পেয়ে যাচ্ছে। এ ব্যাপারে সরকারের আরো নজরদারি বাড়ানো প্রয়োজন বলে তিনি মনে করেন। বাংলাদেশ ব্যাংকের বাংলাদেশ ফাইন্যান্সিয়াল ইন্টেলিজেন্স ইউনিট-বিএফআইইউর সর্বশেষ প্রকাশিত ‘বার্ষিক প্রতিবেদন ২০১৪’ অনুযায়ী, বাংলাদেশের ব্যাংক, বীমাসহ বিভিন্ন আর্থিক প্রতিষ্ঠানে সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা আশঙ্কাজনকহারে বাড়ছে। এসব লেনদেনে স্বাভাবিক প্রক্রিয়া অনুসরণ করা হচ্ছে না। ২০১৩-১৪ অর্থবছরে বাংলাদেশে এ ধরনের সন্দেহজনক লেনদেন হয়েছে ৬১৯টি। আগের বছর এর পরিমাণ ছিল ৪২০টি। আর ২০১১-১২ অর্থবছরে সন্দেহজনক লেনদেনের সংখ্যা ছিল ১৭৫টি।

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর