মঙ্গলবার, ১১ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

দুর্যোগে তছনছ রাঙামাটি

হুমকির মুখে পুরো জেলা, স্বাভাবিক হতে লাগবে বেশ কিছুদিন

মাহমুদ আজহার ও ফাতেমা জান্নাত মুমু, রাঙামাটি থেকে

দুর্যোগে তছনছ রাঙামাটি

পার্বত্য জেলা রাঙামাটি এখন দুর্যোগে তছনছ। পাহাড়ধসে ১২০ জনের প্রাণহানির পর এখনো ঘুরে দাঁড়াতে পারেনি নয়নাভিরাম জেলাটি। দেখে মনে হয়, এটি একটি যুদ্ধবিধ্বস্ত শহর। অধিকাংশ এলাকায় যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন। ফলে চরম হুমকির মুখে পড়েছে স্থানীয় অর্থনীতি। কৃষকসহ মৌসুমি ফল ব্যবসায়ীদের অনেকটা মাথায় হাত। অভাব আছে সুপেয় পানির। লাগামহীনভাবেই বেড়ে চলেছে দ্রব্যমূল্য। সাধারণ নাগরিকের স্বাস্থ্যসেবাও নিশ্চিত করতে পারছে না কর্তৃপক্ষ। পাহাড়ধসের সময় দুর্গত এলাকা থেকে আশ্রয়শিবিরে নিয়ে আসা তিন  হাজারেরও বেশি নারী-পুরুষ ও শিশু ভালো নেই। অনেকেই নানা অসুখে আক্রান্ত। গত শনি ও রবিবার জেলার বিভিন্ন স্থানে সরেজমিন ঘুরে এ চিত্র দেখা গেছে।  স্থানীয়দের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, পাহাড়ধস আর পাহাড়ি ঢলে মানুষের টিকে থাকাই কঠিন হয়ে পড়েছে। নলকূপগুলোয় ঘোলা পানি আসছে। লেকের পানিও ঘোলা। যারা একটু স্বাবলম্বী তারা মিনারেল ওয়াটারের বোতল কিনে পানি পান করছেন। হতদরিদ্ররা সুপেয় পানি পান না করতে পেরে ডায়রিয়া, আমাশয়সহ নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছেন। সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক না হওয়ায় রাঙামাটির নানিয়ারচর উপজেলার কুতুকছড়ি ও খাগড়াছড়ির মানিকছড়ি এলাকায় মৌসুমি ফল ব্যবসায়ীরা চরম সংকটে পড়েছেন। সরেজমিনে দেখা গেছে, রাস্তায় রাস্তায় মাটির স্তূপ। মাটিতে ধসে পড়েছে ঘরবাড়ি। বাড়ির ওপর ভেঙে পড়েছে গাছপালা। শহরের অবস্থাও বেহাল। রাঙামাটি থেকে খাগড়াছড়ি সড়ক যোগাযোগ এখনো বিচ্ছিন্ন। চট্টগ্রাম থেকে রাঙামাটিতে হালকা যানবাহন চলাচল করছে। রাস্তা মেরামতের কাজ চলছে। রাঙামাটি থেকে কাপ্তাই লেক হয়ে বান্দরবানে শুধু অটোরিকশা ও মোটরসাইকেল চলাচল করছে। শহরে কলেজ গেট, বেতার কেন্দ্র, জাদুঘর সড়ক, শিল্পকলা একাডেমি সড়ক, তবলছড়ি উমদামিয়া হিল, শহীদ মিনার, ডিসি বাংলোসহ বেশ কয়েকটি সড়ক ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়কে এখনো সেই অর্থে কাজ শুরু হয়নি।  এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি জেলা পুলিশ সুপার সাঈদ তারিকুল হাসান বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘গত ১৩ জুন থেকে ভারি বর্ষণের কারণে রাঙামাটি জেলার বিভিন্ন স্থানে পাহাড়ধসের ঘটনা ঘটেছে। ১০টি উপজেলায় ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে পাহাড়ের পাদদেশে বসবাসরত অন্তত ১৮ হাজার ৫৮টি পরিবার। এর মধ্যে সম্পূর্ণভাবে বিধ্বস্ত ঘর-বাড়ির সংখ্যা হচ্ছে ১২৩১টি। আংশিক ক্ষতি হয়েছে ৯৫৩৭টি বাড়ি। দুর্গত এ জেলাকে স্বাভাবিক করতে সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাওয়া হচ্ছে।’ স্থানীয় পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, পাহাড় কেটে ঘরবাড়ি নির্মাণ, যত্রতত্র বড়বাড়ি নির্মাণ এবং অপরিকল্পিত জুম চাষের কারণেই রাঙামাটির এই পরিণতি। অবশ্য যেসব এলাকায় ঘরবাড়ি নির্মাণ হয়নি, জুম চাষ হয়নি—সেসব এলাকায়ও কমবেশি পাহাড়ধস হয়েছে। এগুলোর মধ্যে রয়েছে—সুবলং, বরফল, বিলাইছড়ি, কাপ্তাই, রাজস্থলি, বাঘাইছড়ি, বরুনাছড়ি, বালুখালি, কাওখালি, মগাছড়ি প্রভৃতি।  স্থানীয় পরিবেশবিদ মোহাম্মদ আলী জানান, ‘বাংলাদেশে রাঙামাটি ভূমিকম্পের অন্যতম ঝুঁকিপূর্ণ এলাকা। এখানে অনুমোদন না নিয়ে যত্রতত্র বাড়িঘর নির্মাণ ও পাহাড়ে গাছ কাটা হচ্ছে। এসব কারণে পরিবেশের ভারসাম্য নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে ভূমিকম্পের আশঙ্কা বাড়ছেই। আর গত ১১ জুন থেকে টানা তিন দিনের বৃষ্টিতে পাহাড়ের মাটি নড়বড় হয়ে গেছে। এতে ভয়াবহ ভূমিধস হয়েছে। পরিস্থিতি কাটিয়ে উঠতে জেলা প্রশাসন সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছে। তবে সড়কগুলো স্বাভাবিক করতে সরকারকে আরও বেশি তৎপর হতে হবে।’ সড়ক ও জনপথ বিভাগ সূত্র জানায়, রাঙামাটিতে পাহাড়ধসে প্রায় ১৪৫টি স্থানে সড়ক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। এসব সড়ক কোথাও আংশিক আবার কোথাও ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছে। রাঙামাটি চট্টগ্রাম সড়কের বেইলি ব্রিজের কাজ শুরু হয়েছে। এ ব্রিজটি সম্পূর্ণ নির্মিত হলে রাঙামাটি চট্টগ্রাম সড়ক যোগাযোগ ব্যবস্থা স্বাভাবিক হবে। এ ছাড়া রাঙামাটি, কাপ্তাই, বরইছড়ি ও আসাম বস্তির কিছু জায়গায় সড়কের মেরামত কাজ চলছে। এ প্রসঙ্গে রাঙামাটি সড়ক ও জনপথ বিভাগের উপসহকারী প্রকৌশলী মো. আবু মুসা জানান, সড়কগুলোকে স্বাভাবিক করতে আমরা সর্বাত্মক চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছি। জানা যায়, পাহাড়ধসের পর ১৯টি আশ্রয়কেন্দ্রে অবস্থাও দুর্বিষহ। সেখানে সুপেয় পানির অভাব রয়েছে। জেলা প্রশাসন এসব আশ্রয়শিবিরের দায়িত্ব নিয়েছে। কোনো অনুদান সরাসরি দিতে নিষেধ করা হয়েছে। জেলা প্রশাসনের মাধ্যমে এসব শরণার্থীকে প্রয়োজনীয় সহযোগিতা করা হচ্ছে। এলাকাবাসী জানায়, জেলা প্রশাসনের আন্তরিকতার অভাব নেই। তাত্ক্ষণিক ত্রাণ দেওয়া থেকে শুরু করে জেলাকে স্বাভাবিক রাখতে সব ধরনের তৎপরতা চালিয়ে যাচ্ছে আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীসহ জেলা প্রশাসন। তবে সড়ক মেরামতে সরকারকে আরও বেশি তৎপর হওয়া জরুরি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর