বৃহস্পতিবার, ১৩ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

চল্লিশ খুনেও শান্তি ফেরেনি যে গ্রামে

সাঈদুর রহমান রিমন

চল্লিশ খুনেও শান্তি ফেরেনি যে গ্রামে

৪৬ বছরে ৪০ খুনের পরও শান্তি ফেরেনি ভিটিকালমিনা গ্রামে। কুমিল্লার হোমনা উপজেলার ছায়াঘেরা সবুজ ছোঁয়ায় গড়ে ওঠা এ গ্রামে তুচ্ছ ঘটনা নিয়ে ১৯৭১ সাল থেকেই বিরোধে জড়িয়ে পড়েন এখানকার বাসিন্দারা। দুই ভাগে বিভক্ত হয়ে দ্বন্দ্ব-সংঘাতে জড়িয়ে পড়েন তারা। সেই থেকে আজ অবধি লড়াই চলছেই। এর মধ্যে অর্ধশতাধিক দফা মারামারি, হামলা-পাল্টা হামলার ঘটনা ঘটেছে। বন্ধ হয়নি রক্তপাত। মামলা-পাল্টা মামলার সংখ্যা শতাধিক ছাড়িয়েছে। বার বার সমঝোতা বৈঠকে বসেও সমাধান হয়নি বিরোধের। বরং বছরের পর বছর ধরে বংশপরম্পরায় চলছে সংঘাত। সেই অশান্ত বিবাদময় ভিটিকালমিনা গ্রামজুড়ে আবার টানটান উত্তেজনা চলছে। স্থানীয় সাত্তার মাস্টারকে হত্যার চেষ্টা নিয়ে উত্তেজিত এলাকাবাসী যে কোনো মুহূর্তে রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষে জড়িয়ে পড়ার আশঙ্কায় তটস্থ হয়ে উঠেছেন।

একই পাড়ায় বসবাস, ওঠাবসাও পাশাপাশি— অনেকে পুরনো আত্মীয়তার বন্ধনেও আবদ্ধ। শুধু গ্রাম্য বিরোধকে ঘিরে তাদের মধ্যেও মুখ-দেখাদেখি বন্ধ রয়েছে। মোট কথা, একদা শান্তি-সুখের ভিটিকালমিনা গ্রাম থেকে চার দশকেরও বেশি সময় ধরে শান্তি উবে গেছে। সেখানে কেবলই ঝগড়াঝাঁটি, মারামারি আর রাশ রাশ আতঙ্ক নিয়ে প্রতিটি মুহূর্ত কাটছে গ্রামবাসীর। ১৯৮৪, ’৮৫ ও ’৮৬ সালে উভয় গ্রুপের মধ্যে সৃষ্ট হামলা-পাল্টা হামলা ও রক্তক্ষয়ী সংঘর্ষ চলেছে সাত-আট দিন ধরে। এমনকি বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে দেশীয় অস্ত্রশস্ত্র নিয়ে এক পক্ষ আরেক পক্ষের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ে উল্লাসে মেতে ওঠার ঘটনাও ভোলেননি এলাকাবাসী। রীতিমতো তিন পুরুষের মধ্যে বিস্তৃতি লাভ করা এ সংঘাতময় পরিবেশ স্বাভাবিক করার জন্য নানা সময় বিভিন্ন উদ্যোগ নেওয়া হলেও তা স্থায়িত্ব পায়নি মোটেও। বরং দিন দিন ভিটিকালমিনার সংঘাতময় পরিস্থিতি দুলালপুর, কাশীপুর, সাপলেজি, চণ্ডীপুরসহ আশপাশের গ্রামবাসীরও শান্তি কেড়ে নিয়েছে। তারাও রয়েছেন সীমাহীন আতঙ্কে। পাশের দুলালপুর বাজারে সর্বশেষ ৭ জুলাই সন্ধ্যায় গ্রামের সর্বজনশ্রদ্ধেয় সাত্তার মাস্টারের ওপর নারকীয় হামলা চালানোার মধ্য দিয়ে আবারও সংঘাত উসকে দেওয়া হয়েছে। হোমনা উপজেলা সদর থেকে প্রায় ৭ কিলোমিটার উত্তর-পূর্বে ভিটিকালমিনা গ্রামের অবস্থান। দুলালপুর ইউনিয়নের অন্তর্গত এ গ্রামে দুই সহস্রাধিক লোকের বসবাস। বেশির ভাগ মানুষই কৃষির ওপর নির্ভরশীল। খুব অল্পসংখ্যক বাসিন্দাই নিজেদের জীবনযাত্রাকে আধুনিকতার ছোঁয়ায় পাল্টে নিতে পেরেছেন। কিন্তু গ্রামটির ঐতিহ্যবাহী (!) ঝগড়া-বিবাদের ক্ষেত্রে কি শিক্ষিত, কি অশিক্ষিত সবারই দৃষ্টিভঙ্গি প্রায় অভিন্ন। ঝগড়াঝাঁটি হলেই রামদা, তরবারি শান দিতে হবে, লাঠির আগায় ফলা সেট করতে হবে, এটাই সেখানকার বিধি হয়ে দাঁড়িয়েছে। সাত্তার মাস্টারের মতো হাতে গোনা কিছু পরিবার দীর্ঘদিনের বিরোধকে মিটিয়ে ফেলার ব্যাপারে নানা উদ্যোগ নিলেও তা খুব বেশি আমলে নেননি বাসিন্দারা।

খোঁজ নিয়ে জানা যায়, পাকিস্তান আমল থেকেই ভিটিকালমিনাসহ আশপাশ এলাকার বেশির ভাগ সহায়-সম্পদের একক মালিক ছিলেন হিন্দু জমিদার অখিল বাবু। ১৯৭১ সালে পাকিস্তানি সেনাবাহিনীর আক্রোশের মুখে অখিল বাবু শুধু পরিবার-পরিজন নিয়ে দেশ ছেড়ে ভারতে পাড়ি দিতে সমর্থ হন। তার জায়গাজমি, পুকুর-দিঘিসহ সমুদয় বিষয়-সম্পত্তি পড়ে থাকে অবজ্ঞা-অবহেলায়, খবরদারি ছাড়াই। স্বাধীনতার পরপরই অখিল বাবুর বিশাল সম্পত্তি লুটপাট, দখলবাজি নিয়ে প্রথমেই আবু মুছা গ্রুপ ও ছলিম সওদাগর গ্রুপের মধ্যে চরম বিরোধের সূত্রপাত ঘটে। বিরোধের প্রাথমিক পর্যায়েই অতর্কিত আক্রমণে অলেক আলী ও মালেক আলী নির্মম হত্যার শিকার হন। এর জেরে পরবর্তী ১৫-২০ দিন প্রতিপক্ষের বাড়িঘরে ধারাবাহিক হামলা, লুটপাট, মারধরের ঘটনা ঘটতে থাকে। হামলা চালানো হয় দুলালপুর বাজারেও। সেখানে প্রতিপক্ষ মুছা গ্রুপের সমর্থকদের দোকানপাটে হামলা, ভাঙচুর ও লুটপাট-হিংস্রতায় উন্মত্ত হয়ে ওঠে মানুষজন। ছলিম গ্রুপের লাঠিয়াল খ্যাত অলেক-মালেক হত্যাকাণ্ডের প্রতিশোধ হিসেবে মুছা গ্রুপের প্রধান মুছাকে নৃশংসভাবে হত্যা করে তার লাশ পর্যন্ত গায়েব করে ফেলার ঘটনা ঘটে। একইভাবে প্রতিপক্ষের হামলায় হার্ট অ্যাটাকে মারা যান ছলিম নিজেও। এর পর থেকেই ধারাবাহিক খুনোখুনির ঘটনা চলতেই থাকে। নিজের পক্ষের লোকজনকে হত্যা করে প্রতিপক্ষকে আসামি করার এন্তার নজির রয়েছে। নব্বইয়ের দশকে সর্বশেষ আবু তাহের হত্যাকাণ্ড নিয়ে পুলিশের ব্যাপক তত্পরতায় পুরো গ্রামবাসী সীমহীন হয়রানির কবলে পড়েন। তারপর আর হত্যার মতো চরম পর্যায়ে না গেলেও রক্তপাত থেমে থাকেনি। সমঝোতাপ্রত্যাশী গ্রামবাসীর আবেদনের পরিপ্রেক্ষিতে আন্তর্জাতিক মানবাধিকার সংস্থা ‘আসক, ঢাকা’র সাধারণ সম্পাদক গোলাম মোস্তফার নেতৃত্বে এক প্রতিনিধি দল সম্প্রতি ওই এলাকা সরেজমিন অনুসন্ধানে যায়। সেখান থেকে ফিরে তিনি বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, সেখানে বংশপরম্পরায় ঝগড়ার অংশীদার হওয়া গর্বের বিষয় হয়ে দাঁড়িয়েছে। পেশিশক্তি দিয়েই সেখানে টিকে থাকার পথ খোঁজেন বাসিন্দারা। সভ্যতার এ যুগে এমন বর্বরতার কথা চিন্তাও করা যায় না। ইতিমধ্যে আসকের পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদন স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়সহ সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের সর্বত্র পাঠানো হয়েছে। মানবাধিকার সংস্থার পর্যবেক্ষণ প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, বিরোধপূর্ণ একটি পক্ষের জসিমউদ্দিন সওদাগর নামে এক ব্যক্তি দুলালপুর ইউনিয়নের চেয়ারম্যান নির্বাচিত হওয়ায় এবং জাকির হোসেন নামের একজন প্রবাসী হিসেবে অর্থ জোগানদাতা হওয়ায় সংঘাতময় পরিস্থিতি স্থায়িত্ব পাচ্ছে। প্রতিবেদনে সমঝোতার উদ্যোগ নিয়ে জানমাল সুরক্ষাসহ পরবর্তী প্রজন্মের জন্য এ এলাকাকে বাসযোগ্য হিসেবে নিশ্চিত করার সুপারিশ করা হয়েছে। সরেজমিন ঘুরে দেখা যায়, ওই গ্রামের বহু বাড়িতে এখনো টিনের বেড়ায় রামদার কোপ রয়েছে। ভাঙাচোরা, থেঁতলানো অবস্থায় রয়েছে আসবাবপত্র। গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ইতিপূর্বে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান, উপজেলা চেয়ারম্যান, এমপিসহ ক্ষমতাসীন দলের নেতৃবৃন্দের উদ্যোগে বিভিন্ন সময় সমঝোতা বৈঠক হলেও তা স্থায়ী শান্তি এনে দিতে পারেনি। শিক্ষাদীক্ষায় এগিয়ে যাওয়া কিছু পরিবার পরবর্তী প্রজন্মের জন্য শান্তি-শৃঙ্খলাপূর্ণ সুখী গ্রাম হিসেবে দেখতে চান ভিটিকালমিনাকে। তারাই প্রশাসনসহ বিভিন্ন মহলে সমঝোতার আবেদন নিয়ে ধরনা দিচ্ছেন।

সর্বশেষ খবর