শুক্রবার, ১৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা
সংসদ সমাপনী অধিবেশনে প্রধানমন্ত্রী

তেলা মাথায় তেল দেওয়া সরকারের নীতি নয়

নিজস্ব প্রতিবেদক

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, ‘আমাদের সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতি উন্নত করা। আমরা চাই মানুষের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন। আমাদের উন্নয়নের সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ হচ্ছে আয়বৈষম্য ও দরিদ্রবৈষম্য হ্রাস করতে পারা। আমরা তা পেরেছি বলে তৃণমূল পর্যায়ে মানুষের অর্থনৈতিক উন্নয়ন হয়েছে।’ তিনি বলেন, ‘তেলা মাথায় তেল দেওয়া আমাদের সরকারের নীতি নয়। ধনীকে আরও ধনী করাও নয়। উন্নয়নটা যেন হতদরিদ্র মানুষের দোরগোড়ায় পৌঁছে। সেভাবেই আমরা কাজ করেছি।’

প্রধানমন্ত্রী গত রাতে স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরীর সভাপতিত্বে জাতীয় সংসদের বাজেট অধিবেশনে সমাপনী ভাষণ দিচ্ছিলেন। শেখ হাসিনা বলেন, ‘আমরা ১৪টি বাজেট দিয়েছি। যেভাবে আমরা বাজেট দিয়েছি তাতে জনগণের কল্যাণ হয়েছে। আয় বৃদ্ধি পেয়েছে, জনগণ অর্থনৈতিকভাবে স্বাবলম্বী হয়েছে। এটাই হলো বাস্তবতা। মাননীয় অর্থমন্ত্রীকে ধন্যবাদ জানাই। তিনি দিনরাত পরিশ্রম করেছেন। বাজেট দেওয়ার আগে বিভিন্ন শ্রেণি-পেশার মানুষের সঙ্গে আলোচনা করেছেন। বাজেট দেওয়ার আগে আলোচনা করে মানুষের প্রত্যাশা জেনেই সে অনুযায়ী বাজেট দিয়েছেন।’ প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘বিরোধী দলের দাবির পরিপ্রেক্ষিতিই কিন্তু এই ভ্যাট স্থগিত করা হয়েছে। মাননীয় বিরোধীদলীয় নেতা বলেছেন, এতে হয়তো ক্ষতি হবে। ক্ষতি কিন্তু হয়েছে। এই ভ্যাট ও মোবাইল ফোনের আয় ধরেই কিন্তু বাজেট করা হয়েছিল। ভ্যাট স্থগিত করায় ২০ হাজার কোটি টাকা কম রাজস্ব আদায় হবে। আমাদের যেভাবেই হোক একটা ব্যবস্থা করতে হবে। হয় ব্যাংক থেকে লোন নিতে হবে নয় তো উন্নয়ন বাজেট কাটছাঁট করতে হবে। তার পরও মাননীয় সংসদ সদস্যদের মতামতের প্রতি অর্থমন্ত্রী সম্মান দিয়েছেন এবং ভ্যাট স্থগিত করেছেন।’ তিনি বলেন, ‘আমরা যেভাবে বাজেট বৃদ্ধি করেছি, এত বড় বাজেট এর আগে কখনো দেওয়া হয়নি। আমি সংসদ সদস্যদের অনুরোধ করব নিজ নিজ এলাকায় উন্নয়ন প্রকল্পের ব্যয়টা যেন সঠিকভাবে হয় তা নিশ্চিত করার জন্য।’ শেখ হাসিনা বলেন, ‘এই পার্লামেন্টে সর্বপ্রথম সংসদ সদস্যরা যে নিজেদের মতামত প্রকাশ করতে পারেন, তা সরকারি দলের হোক আর বিরোধী দলের হোক, সেটা এই প্রথম এ সংসদে প্রমাণিত হয়েছে। সংবিধানের ৭০ অনুচ্ছেদে যা আছে, অনেকেই তার সমালোচনা করেন এবং ভুল ব্যাখ্যা দেন। আমার মনে হয় এই বাজেটের আলোচনায় আমাদের সংসদ সদস্যরা যেভাবে বক্তব্য দিয়েছেন, বিরোধী দল তো বিরোধিতা করবেই। সব থেকে বেশি আমি দেখেছি আমাদের সরকারদলীয় সদস্যরাই বেশি সমালোচনা করেছেন। বাজেটের সমালোচনা করেছেন, সরকারের সমালোচনা করেছেন এবং তাদের এই আলোচনার ফলে অর্থমন্ত্রী বাজেটে বেশকিছু সংশোধনী এনেছেন। সংসদ সদস্যরা জনপ্রতিনিধি। আমাদের সংবিধানের সপ্তম অনুচ্ছেদে বলা আছে, প্রজাতন্ত্রের মালিক জনগণ। আর সেই জনগণের প্রতিনিধি সংসদ সদস্যরা। তারা স্বাধীনভাবে বক্তব্য দিয়েছেন। প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘আমি দেশবাসীকে বলব, সবাই যদি আয়কর দেন, ট্যাক্স দেন সেটা কিন্তু উন্নয়নের কাজেই লাগবে। রাস্তাঘাট তৈরি হবে, মানুষের চলাচলের পথ হবে, বিদ্যুৎ উৎপাদন বাড়াতে পারব, ফসল উৎপাদন বাড়াতে পারব। অর্থনৈতিক দিক থেকে মানুষের উন্নয়ন হবে। কাজেই সামান্য একটু ট্যাক্স দিলেই তিনি কিন্তু অনেক সুযোগ-সুবিধা পাবেন। আমাদের ঘাটতিও পূরণ হবে, দেশটাও উন্নত হবে।’ তিনি বলেন, ‘আমাদের উন্নয়নটা শুধু মুখের উন্নয়ন নয়, সেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা যেমন খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে পেরেছি। তেমনি খাদ্য উৎপাদন বৃদ্ধি করতেও পেরেছি। বন্যায় হাওর এলাকায় খাদ্য কিছু নষ্ট হয়ে গেছে বলে আমরা বসে থাকিনি। সেই সঙ্গে সঙ্গে আমরা ঘাটতি পূরণ করেছি। সামনে এই বন্যাটা হয়তো আরও বড় আকারে আসতে পারে, সে বিষয় বিবেচনা করে ইতিমধ্যে আমরা বিদেশ থেকে খাদ্য আমদানি করে মজুদ রেখেছি; যাতে আমাদের কোনোরকম বিপদ হলেও দেশের মানুষ কষ্ট না পায়।’

ক্ষুদ্র কৃষিজীবীদেরও ঋণ সুবিধা দেওয়া হবে : প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, সরকার এখন থেকে ছাগল,  ভেড়া এবং মহিষ লালন-পালনকারীদেরও পাঁচ শতাংশ হারে ব্যাংক ঋণ সুবিধা দেওয়ার চিন্তা-ভাবনা করছে। গতকাল তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে কটন ও জুট সিস্টেমে ভেড়ার পশম মিশিয়ে সুতা এবং সেই মিশ্রণে প্রস্তুতকৃত বস্ত্রসামগ্রী হস্তান্তর অনুষ্ঠানে শেখ হাসিনা এ কথা বলেন। বাংলাদেশ প্রাণিসম্পদ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএলআরআই)  ও বাংলাদেশ পাট গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিজেআরআই) এর যৌথ উদ্যোগে এই অনুষ্ঠান হয়। ভেড়ার পশম, পাট ও সুতার মিশ্রণে কম্বল, শাল, পাপোশ, জায়নামাজসহ অন্যান্য গৃহস্থালি সামগ্রী তৈরি করে প্রধানমন্ত্রীর কাছে হস্তান্তর করা হয়। কর্মকর্তারা জানান, দেশে প্রতিপালিত ভেড়ার সংখ্যা প্রায় ৩৪ লাখ এবং যা থেকে প্রতিবছর ৩৪০০ মেট্রিক টন উল উৎপাদন হয়। কিন্তু কারিগরি জ্ঞানের অভাবে এগুলোর যথাযথ অর্থনৈতিক ব্যবহার হচ্ছে না। ভেড়ার মাংসে ছাগলের চেয়ে চর্বির পরিমাণ কম থাকার কারণে হৃদরোগের ঝুঁকিও কম। এ ছাড়া ছাগলের চেয়ে কষ্টসহিঞ্চু পরিবেশে বেড়ে ওঠা ভেড়ার লোম ব্যবহার করা হয় বিভিন্ন পণ্য তৈরিতে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশে ভেড়ার মাংসের চাহিদা বাড়লেও বাংলাদেশে এখনো তেমন জনপ্রিয় হয়নি। পণ্য তৈরির জন্য প্রধানমন্ত্রী সংশ্লিষ্টদের ধন্যবাদ জানিয়ে এগুলো বাজারজাতকরণের নির্দেশ দেন।  ভেড়ার মতো অন্যান্য গৃহপালিত পশুর মাংস ছাড়া হাড় ও চামড়া থেকে বিভিন্ন পণ্য রপ্তানিরও আহ্বান জানান তিনি। অনুষ্ঠানে মৎস্য ও প্রাণিসম্পদমন্ত্রী সায়েদুল হক, প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ, মন্ত্রণালয়ের সচিব মো. মাসুদুল হক এবং বিএলআরআই মহাপরিচালক তালুকদার নুরুন্নাহার বক্তৃতা করেন।

বাংলাদেশকে ৭০টি রেল ইঞ্জিন দেবে সুইজারল্যান্ড : রেল যোগাযোগ নেটওয়ার্ককে জোরদার করতে সুইজারল্যান্ড বাংলাদেশকে ৭০টি রেল ইঞ্জিন দেবে। এ জন্য একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরের প্রক্রিয়া প্রায় চূড়ান্ত হয়েছে। সুইজারল্যান্ডের বিদায়ী রাষ্ট্রদূত ক্রিস্টিন ফটশ্চ গতকাল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে তার কার্যালয়ে সাক্ষাৎকালে এ কথা বলেন। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাংবাদিকদের বলেন, প্রধানমন্ত্রী রেল খাতে সহযোগিতার জন্য সুইস সরকারকে ধন্যবাদ জানান। শেখ হাসিনা বলেন, এই সহযোগিতার ফলে প্রতিবেশী দেশও দেশের মধ্যে রেল যোগাযোগের উন্নতি হবে। সুইস রাষ্ট্রদূত বিগত বছরগুলোতে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের অগ্রগতি ও অব্যাহত জিডিপি প্রবৃদ্ধির প্রশংসা করেন। তার দেশের সঙ্গে বাংলাদেশের ক্রমবর্ধমান অর্থনৈতিক সহযোগিতার উল্লেখ করে রাষ্ট্রদূত বলেন, সুইজারল্যান্ডের একটি কোম্পানি বাংলাদেশে এলএনজি রপ্তানির লক্ষ্যে শিগগির একটি সমঝোতা স্মারক স্বাক্ষরিত হতে পারে। পরে সুইডেনের রাষ্ট্রদূত জোহান ফ্রিসেল প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বিদায়ী সাক্ষাৎ করেন। এ সময় রাষ্ট্রদূত বলেন, তার দেশ জ্বালানি খাতে সহযোগিতায় আগ্রহী। প্রেস সচিব বলেন, প্রধানমন্ত্রী সুইডেনের স্বার্থকে স্বাগত জানিয়ে জানান, বাংলাদেশের মানুষের ক্রয় ক্ষমতা দ্রুত বাড়ছে। শেখ হাসিনা বলেন, জ্বালানি হচ্ছে উন্নয়নের চাবিকাঠি। এ জন্য তার সরকার জ্বালানির বর্ধিত চাহিদা মেটাতে এ খাতে বেসরকারি বিনিয়োগ উন্মুক্ত করেছে। বিদ্যুৎ উৎপাদন ২০০৬ সালের ১৬০০ মেগাওয়াটের স্থলে ১৫ হাজার মেগাওয়াটে উন্নীত হয়েছে। তিনি বলেন, সুইডেন বাংলাদেশের নির্মাণাধীন বিশেষ অর্থনৈতিক অঞ্চলগুলোর অন্যান্য খাতে বিনিয়োগ করতে পারে। প্রধানমন্ত্রী সম্প্রতি তার সুইডেন সফরের কথা স্মরণ করেন। রাষ্ট্রদূত বলেন, বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রীর এই সফরে দুই দেশের মধ্যকার সম্পর্ক সম্প্রসারিত হয়েছে।

সর্বশেষ খবর