সোমবার, ২৪ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

কাবিখা কোথায় যায় কারা খায়

নিজস্ব প্রতিবেদক

ঘটনা-১ : সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলায় টিআর, কাবিখা, কাবিটা ও কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা  উত্তোলনের অভিযোগ উঠেছে। এমনকি প্রকল্পের কাজ অসম্পূর্ণ রেখেই টাকা ভাগ-বাটোয়ারা করছেন সংশ্লিষ্ট জনপ্রতিনিধিরা। এই সব প্রকল্পের কাজের মান নিয়েও প্রশ্ন তুলেছেন অনেকে। নামে প্রকল্প থাকলেও বাস্তবে খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে না অনেক প্রকল্প। বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউনিয়নে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ৩০টি প্রকল্প বাস্তবায়ন করতে (টিআর, কাবিখা, কাবিটা, কর্মসৃজন প্রকল্প) ৩৬ লাখ ৯৩ হাজার ৭৭৬ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। কিন্তু এখানে অনেক প্রকল্পের কাজ শেষ না করেই অধিকাংশ টাকা তোলা হয়েছে।

ঘটনা-২ : বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলা যুবলীগের যুগ্ম-সম্পাদক বাদশা আলমগীরের বিরুদ্ধে ২০১৬-১৭ অর্থবছরের গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ (টিআর-নগদ অর্থ) প্রকল্পের কাজ না করে তিন লক্ষাধিক টাকা আত্মসাতের অভিযোগ উঠেছে। মাঝিরা ইউনিয়নের প্যানেল চেয়ারম্যান উপজেলা আওয়ামী লীগ নেতা তারেক হোসেন সুমন এ ব্যাপারে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার কাছে লিখিত অভিযোগ করেছেন। ওই যুবলীগ নেতা স্থানীয় সংসদ সদস্য অ্যাডভোকেট আলতাব আলীর কাছ থেকে এসব প্রকল্প বাগিয়ে নেন বলে জানা গেছে।

শুধু এ দুই ঘটনাই নয়, গ্রামীণ দরিদ্র মানুষের দুর্দশা লাঘবে সরকারের টিআর (টেস্ট রিলিফ)-কাবিখা (কাজের বিনিময়ে খাদ্য) কর্মসূচিতে বরাদ্দ অর্থের অর্ধেকই চলে যায় প্রভাবশালীদের পেটে। যাদের জন্য প্রকল্প বরাদ্দ করা হচ্ছে তাদের উন্নয়ন না হয়ে উন্নয়ন হচ্ছে যখন যে দল ক্ষমতায় থাকে সেই দলের কতিপয় নেতা এবং স্থানীয় কিছু অসাধু কর্মকর্তার। এখন সর্বত্রই প্রশ্ন, টিআর-কাবিখা কারা নেয়? কী করে?

জানা গেছে, বরাদ্দকৃত অর্থের ৬০ থেকে ৭০ শতাংশেরই কোনো কাজ হয় না। অনেক সময় শতভাগই গায়েব করে দেওয়া হয়। টিআর ও কাবিখার বরাদ্দে উন্নয়নের নামে উপজেলা পর্যায়ে গড়ে উঠেছে ‘লুটে খা’ সিন্ডিকেট। নানা কৌশলে প্রশাসনের যোগসাজশেই এ লুটপাট ও দুর্নীতি এখন ওপেন সিক্রেট। আর ত্রাণ মন্ত্রণালয়ে রয়েছে ‘আকাশ-বাতাস’ নামে একটি সিন্ডিকেট। ওই সিন্ডিকেটের মূল হোতা এক প্রভাবশালী ব্যক্তির এলাকার বাসিন্দা হওয়া তার দাপটে তটস্থ থাকেন মন্ত্রণায়ল ও অধিদফতরের কর্মকর্তারা। এ ছাড়া তারা বিভিন্ন এমপির ভুয়া ডিও দিয়েও কোটি কোটি টাকার প্রকল্প হাতিয়ে নিচ্ছেন, যা অনেকটাই ওপেন সিক্রিট। টিআর-কাবিখা নিয়ে বিভিন্ন অনিয়ম প্রসঙ্গে ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বাংলাদেশ প্রতিদিনকে বলেন, ‘টিআর-কাবিখা নিয়ে অনিয়মের কোনো অভিযোগ আমাদের কাছে আসেনি। মাগুরার একটি ঘটনা আমাদের দৃষ্টিতে এসেছে। তাত্ক্ষণিক প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের জন্য সংশ্লিষ্টদের নির্দেশ দেওয়া হয়েছে।’ মন্ত্রণালয়ে বিশেষ সিন্ডিকেটের বিষয় অস্বীকার করে তিনি বলেন, ‘এ ধরনের ঘটনা আমার জানা নেই।’

দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয় সূত্রে জানা গেছে,  টিআর, কাবিখা, কাবিটাসহ এই মন্ত্রণালয়ের বিভিন্ন আর্থিক বিষয়ে পাঁচ হাজারের বেশি অডিট আপত্তি রয়েছে। আর ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশাল, রংপুর বিভাগে অডিট আপত্তির সংখ্যা তলনামূলক বেশি। প্রকল্প বাস্তবায়ন বিষয়ে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার খাজাঞ্চি ইউনিয়ন সরেজমিন ঘুরে দেখা যায় ভিন্ন চিত্র। এই ইউপিতে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (টিআর) কর্মসূচির আওতায় দ্বিতীয় পর্যায়ের ৩০ হাজার টাকা বরাদ্দের ৭ নম্বর ওয়ার্ডের ‘নোয়াগাঁও গ্রামের ফকিরবাড়ীর সামনে থেকে কবরস্থান পর্যন্ত রাস্তার মাটি ভরাট’, ৩৬ হাজার ৮২৯ টাকা বরাদ্দের ৫ নম্বর ওয়ার্ডের ‘তেলিকোনা এলজিইডি রাস্তা থেকে আলকাছ আলীর বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা উন্নয়ন’ ও অতিদরিদ্রদের জন্য কর্মসংস্থান কর্মসূচির আওতায় প্রথম পর্যায়ের এক লাখ ৮০ হাজার টাকা বরাদ্দের ২ নম্বর ওয়ার্ডের ‘হামদরচক মতিউরের বাড়ির সামনে থেকে চন্দ্রগ্রাম বিজয়নাথের বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা মেরামত’—এই তিন প্রকল্পের প্রথম দুটিতে কোনো কাজই করা হয়নি। তৃতীয় প্রকল্পের কাজ শুরু করা হলেও সিংহভাগই অসম্পূর্ণ রয়েছে। এদিকে খাজাঞ্চি ইউনিয়নে বরাদ্দকৃত একটি প্রকল্পের নাম ও জায়গার মধ্যে মিল খুঁজে পাওয়া যায়নি। ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে গ্রামীণ অবকাঠামো সংস্কার (কাবিটা) কর্মসূচির আওতায় সাধারণ খাতের দ্বিতীয় পর্যায়ের প্রকল্পের তালিকা বিবরণে ‘পূর্ব নোয়াগাঁও মসজিদ থেকে সোহেল মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত রাস্তা উন্নয়ন’ উল্লেখ থাকলেও সেখানে গিয়ে দেখা যায় কোনো কাজই করা হয়নি। খোঁজ নিয়ে জানা যায়, প্রকল্পটির কাজ পশ্চিম নোয়াগাঁও মসজিদ থেকে সোহেল মিয়ার বাড়ি পর্যন্ত বাস্তবায়ন করা হয়েছে। এদিকে সিলেটের বিশ্বনাথ উপজেলার দশঘর ইউনিয়নে টিআর, কাবিখা, কাবিটা, কর্মসৃজন প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা তুলে নেওয়া হচ্ছে। এ উপজেলার দশঘর ইউনিয়নে ২০১৬-২০১৭ অর্থবছরে ২৪টি প্রকল্পে (টিআর, কাবিখা, কাবিটা, কর্মসৃজন) ২৫ লাখ ৯২ হাজার ৬৩৮ টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়। এর মধ্যে আটটি প্রকল্পের কাজ না করেই টাকা তুলে নেওয়া হয়েছে। কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন দেখানো হলেও দৃশ্যমান কোনো কাজই হয়নি। বাকি প্রকল্পে নামমাত্র কাজ করেই টাকা হাতিয়ে নেওয়া হয়েছে। এ বিষয়ে উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা অমিতাভ পরাগ তালুকদার জানান, ‘কাজ না করে টাকা তুলে নেওয়া হলে অথবা প্রকল্প অনুযায়ী কাজ না হলে সংশ্লিষ্টদের বিরুদ্ধে আমরা প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নেব।’

ঘটনা-৩ : গেল রোজায় বিভিন্ন মসজিদ-মাদ্রাসায় ইফতার পার্টি করার নামে ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে জিআরের চাল বরাদ্দ নেওয়া হয় রাজশাহীর পবা উপজেলায়। এ ক্ষেত্রে ছয় ইউপি চেয়ারম্যান এক সংসদ সদস্যের ভুয়া ডিও লেটার দিয়ে ১৭৮ মেট্রিক টন চাল লোপাট করেছেন বলে অভিযোগ উঠেছে। এ ক্ষেত্রে ভুয়া ভাউচার দেখিয়ে ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় থেকে এই চাল বরাদ্দ নেওয়া হয়, ঈদের আগেই যার বেশির ভাগ চাল তোলা হয়েছে। কিন্তু পরে বাকি চাল তুলতে গিয়ে বিষয়টি জানাজানি হয়। এরপর স্থানীয় এমপি চাল তোলা বন্ধ করে দেন। পরে তদন্তের জন্য জেলা প্রশাসককে নির্দেশও দেওয়া হয়। জানা গেছে, প্রয়োজনীয় কাগজপত্র দেখে চিঠি (ডিও) ইস্যু করা হয়। সেই অনুযায়ী ঈদুল ফিতরের আগে প্রায় ১০০ মেট্রিক টন চাল তোলেন সংশ্লিষ্টরা। ঈদের পর ২০ মেট্রিক টন বরাদ্দ তোলার প্রক্রিয়া চলছিল। এমন সময় স্থানীয় এমপি অভিযোগের চাল তোলা বন্ধ করা হয়। এমপির পক্ষ থেকে  জানানো হয়, তার নামে জাল ডিও লেটার দিয়ে মসজিদ-মাদ্রাসায় ইফতারের জন্য ত্রাণ ও পুনর্বাসন মন্ত্রণালয় থেকে এ বরাদ্দ নেওয়া হয়েছে, যা শুধু বিএনপি-জামায়াত নিয়ন্ত্রিত ৫০টি প্রতিষ্ঠানের নামে তোলা হচ্ছিল। এ ছাড়া ভুয়া বিল তোলার সঙ্গে জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তা, পবা উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা ও উপজেলা খাদ্য কর্মকর্তাও জড়িত বলে সংশ্লিষ্টরা অভিযোগ তুলেছেন।

ঘটনা-৪ : গাইবান্ধায় টিআর, কাবিটা, কাবিখা প্রকল্পের বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান, সৌর বিদ্যুৎ (সোলার প্যানেল), গ্রামীণ জনপদের উন্নয়ন ও সংস্কারের নামে ভুয়া প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটি দেখিয়ে ব্যাপক লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। এ ছাড়া ত্রাণ ও দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা মন্ত্রণালয়ের অধীনে ব্রিজ, কালভার্ট নির্মাণসহ বিভিন্ন প্রকল্পের নামে বরাদ্দকৃত অর্থ আত্মসাৎ করে একটি সংঘবদ্ধ চক্র। এদিকে অর্থ লোপাটের অভিযোগে সম্প্রতি গাইবান্ধার সুন্দরগঞ্জ উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা (পিআইও) নুরুন্নবী সরকার, এলজিইডির উপসহকারী প্রকৌশলী মশিউর রহমান প্রধান, একজন ঠিকাদারসহ ছয় প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতিদের বিরুদ্ধে ছয়টি মামলা করেছে দুর্নীতি দমন কমিশন (দুদক)। জানা গেছে, দুদকের সমন্বিত রংপুর জেলা কার্যালয়ের উপ-পরিচালক মোজাহার আলী সরদার বাদী হয়ে সুন্দরগঞ্জ থানায় এসব মামলা করেন। বাদী এসব মামলায় উল্লেখ করেন, আসামিরা পরস্পর যোগসাজশে অপরাধজনক আচরণের মাধ্যমে ক্ষমতার অপব্যবহারপূর্বক সরকারি টাকা আত্মসাৎ করেছে। এসব প্রকল্পের বিপরীতে বরাদ্দকৃত মোট অর্থ থেকে আত্মসাত্কৃত অর্থের পরিমাণ নির্ণয় করা হয়েছে ২৩ লাখ ৫ হাজার ২৮৯ টাকা ৮ পয়সা। প্রকল্পগুলোর মধ্যে প্রয়াত এমপি মঞ্জুরুল ইসলাম লিটনের বিশেষ বরাদ্দের তিনটি। অপর তিনটি গাইবান্ধা জেলা পরিষদের। এর সঙ্গে জড়িত রয়েছেন সুন্দরগঞ্জ ডিডব্লিউ ডিগ্রি কলেজ ভবন নির্মাণকারী ঠিকাদার মাহমুদুল হক, কলেজের অধ্যক্ষ এ কে এম হাবিব সরকার ও উপসহকারী প্রকৌশলী মশিউর রহমান প্রধান। জেলা পরিষদের দেওয়া অপর দুটি প্রকল্পে তিনজন ছাড়াও আসামি রয়েছেন নাছরীন আক্তার। এদিকে ২০১৫- ২০১৬ অর্থবছরে তৎকালীন এমপির বিশেষ বরাদ্দের তিনটি প্রকল্প বাস্তবায়ন কমিটির সভাপতি মঞ্জুরুল হক, আলমগীর হোসেন, জাহাঙ্গীর আলম চৌধুরী সুজা। এই প্রকল্পের পৃথক তিন মামলার প্রতিটিতে প্রধান আসামি রয়েছেন পিআইও নূরুন্নবী সরকার।

ঘটনা-৫ : জুন ক্লোজিংয়ের নামে লালমনিরহাটেও ভয়াবহ লুটপাট হয়েছে। শুধু কাগজে-কলমে প্রকল্প দেখিয়ে অন্তত ১০ কোটি টাকা লুটপাটের অভিযোগ উঠেছে। বিশেষ টেস্ট রিলিফ (টিআর) ও গ্রামীণ অবকাঠামো রক্ষণাবেক্ষণ কর্মসূচির আওতায় প্রকল্পের কাজ শুরুর আগেই কাগজে-কলমে বাস্তবায়ন দেখিয়ে সরকারের এসব টাকা লুটপাটের অভিযোগ পাওয়া গেছে। আর প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তারা সরেজমিনে এসব কাজ তদারক না করেই মোটা অঙ্কের উেকাচের বিনিময়ে সরকারি অর্থ ছাড় করেছেন বলে জানা গেছে। ৩০ জুনের মধ্যে প্রকল্পের কাজ শেষ করার জন্য দুর্যোগ ব্যবস্থাপনা ও ত্রাণ মন্ত্রণালয়ের নির্দেশ থাকায় এই দ্রুত কাজ শেষ দেখানো হয়েছে। জেলা ত্রাণ ও পুনর্বাসন কর্মকর্তার কার্যালয় সূত্রে জানা গেছে, জেলার তিনটি সংসদীয় আসনে সংসদ সদস্যদের জন্য দ্বিতীয় পর্যায়ে টিআর কর্মসূচির আওতায় ২ কোটি ৩০ লাখ ৫৫ হাজার ৩৩৮ টাকার বিপরীতে প্রকল্প ধরা হয় ৩৭২টি। মাত্র দুই সপ্তাহের ব্যবধানে কাজের অগ্রগতি দেখানো হয়েছে ৭০ ভাগ।

সর্বশেষ খবর