রবিবার, ৩০ জুলাই, ২০১৭ ০০:০০ টা

নওয়াজের ভাই শাহবাজ হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

প্রতিদিন ডেস্ক

নওয়াজের ভাই শাহবাজ হচ্ছেন প্রধানমন্ত্রী

শাহবাজ শরিফ

পাকিস্তানের অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিলেন দেশটির তেল ও প্রাকৃতিক সম্পদবিষয়ক মন্ত্রী শহীদ খাকান আব্বাসী। গতকাল ক্ষমতাসীন পাকিস্তান মুসলিম লিগের (নওয়াজ) এক বৈঠকে এ সিদ্ধান্ত নেওয়া হয়েছে। বৈঠকে পাকিস্তানের পরবর্তী প্রধানমন্ত্রী হিসেবে নওয়াজের ভাই শাহবাজ শরিফের নাম চূড়ান্ত করেছে দলটি। শাহবাজ সংসদ সদস্য নির্বাচিত হয়ে প্রধানমন্ত্রী হওয়ার আগ পর্যন্ত অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী  হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন আব্বাসী। ধারণা করা হচ্ছে, আগামী দেড় মাস তিনি পাকিস্তানের প্রধান নির্বাহী হিসেবে দায়িত্ব পালন করবেন। পাকিস্তানের অনলাইন ডনের এক প্রতিবেদনে বলা হয়, সদ্য পদত্যাগকারী প্রধানমন্ত্রী নওয়াজ শরিফ নিজে শহীদ আব্বাসীকে অন্তর্বর্তীকালীন প্রধানমন্ত্রী হিসেবে বেছে নেন। যদিও এর আগে খবরে বলা হয়েছিল, পিএমএলএনের অধিকাংশ নেতা ও শরিফ পরিবারের সদস্যরা সাবেক প্রতিরক্ষামন্ত্রী খাজা মোহাম্মদ আসিফকে ওই পদে বসানোর ব্যাপারে সম্মত ছিলেন।

উল্লেখ্য, পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্ট পানামা পেপারস কেলেঙ্কারির ঘটনায় ২৮ জুলাই নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী হিসেবে অযোগ্য ঘোষণা করে। এরপরই প্রধানমন্ত্রী পদ থেকে পদত্যাগ করেন তিনি। পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার জন্য শাহবাজকে পার্লামেন্ট নির্বাচনের উপনির্বাচনে জয়ী হতে হবে, পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রীর দায়িত্ব ছাড়তে হবে এবং তার স্থলাভিষিক্ত নির্ধারণ করতে হবে। নওয়াজের পদত্যাগে শূন্য হওয়া আসনে নির্বাচন করবেন শাহবাজ। পাকিস্তানের পার্লামেন্টে পিএমএলএনের একক সংখ্যাগরিষ্ঠতা থাকায় তারা যাকেই মনোনয়ন দিক না কেন, তিনিই নির্বাচিত হবেন। তাই শাহবাজ শরিফের প্রধানমন্ত্রিত্ব নিশ্চিত বলেই ধরে নেওয়া হচ্ছে। দলীয় সূত্রে ডন জানিয়েছে, পাঞ্জাবের করমন্ত্রী মুজতবা শুজাউর রেহমান পাঞ্জাবের মুখ্যমন্ত্রী হিসেবে দায়িত্ব নিতে পারেন।

২০০৮ সাল থেকে পাঞ্জাবের দায়িত্বে থাকা শাহবাজ বিভিন্ন স্থাপনা ও অবকাঠামো নির্মাণে মনোযোগ দিয়ে দক্ষ শাসকের খ্যাতি অর্জন করেছেন; সামরিক বাহিনীর সঙ্গে তার সম্পর্ক ভাইয়ের চেয়ে ভালো বলে প্রকাশিত প্রতিবেদনে বলা হয়েছে।

নওয়াজ কি আজীবনের জন্য অযোগ্য? : পাকিস্তানের সুপ্রিম কোর্টের পাঁচ সদস্যের একটি বেঞ্চ শুক্রবার সংবিধানের ৬২ অনুচ্ছেদ মোতাবেক নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী-অযোগ্য ঘোষণা করে। পরে দেশটির অ্যাটর্নি জেনারেল আসতার আউসাফ বলেন, নওয়াজ শরিফকে প্রধানমন্ত্রী পদে আজীবনের জন্য অযোগ্য ঘোষণা করা হয়েছে। তিনি ভবিষ্যতে কোনো নির্বাচনেও প্রতিদ্বন্দ্বিতা করতে পারবেন না। আদালতের রায়ের পর নওয়াজের প্রধানমন্ত্রিত্ব চলে গেলেও তার আজীবনের জন্য প্রধানমন্ত্রী হওয়ার পথ বন্ধ হয়ে গেল কি না, তা নিয়ে বিতর্ক শুরু হয়েছে। নওয়াজের ভাগ্যে আসলে কী ঘটতে চলেছে, তা নিয়ে পাকিস্তানের আইনজীবীরা ভিন্ন ভিন্ন মত দিয়েছেন। কেউ আবার বলছেন, এ বিষয়ে সুনির্দিষ্ট একটি সিদ্ধান্ত প্রয়োজন। কারণ, সুপ্রিম কোর্টের এই রায়ের আগে প্রশ্নটি দীর্ঘদিন ধরে আড়ালেই ছিল। সুপ্রিম কোর্ট বার অ্যাসোসিয়েশনের সাবেক সভাপতি তারিক মেহমুদ বলেন, সংবিধানের ৬২ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী কাউকে অযোগ্য ঘোষণা করা হলে তিনি সাময়িকভাবে, নাকি স্থায়ীভাবে অযোগ্য হবেন, তা স্পষ্ট নয়। সাবেক প্রধান বিচারপতি আনোয়ার জহির জামালি এ ধরনের (নওয়াজের মামলা) একটি মামলার শুনানিতে বিস্ময় প্রকাশ করে বলেছিলেন, সংবিধানের ৬২ ও ৬৩ অনুচ্ছেদের ভিত্তিতে কীভাবে একজনকে চিরতরে নির্বাচনে অংশ নেওয়ার অযোগ্য ঘোষণা করা হয়! তিনি বলেন, এটা কিছু সময়ের জন্য অযোগ্যতা। মানুষ নিজেকে সংশোধন করে নিতে পারেন। আগের কথা স্মরণ করে জ্যেষ্ঠ আইনজীবী রাহিল কামরান শেখ বলেন, সাবেক প্রধানমন্ত্রী ইউসুফ রাজা গিলানিও আদালত অবমাননার অভিযোগে ২০১২ সালের ১৯ জুন অযোগ্য হয়েছিলেন। সংবিধানের ৬৩ অনুচ্ছেদ অনুযায়ী তাকে অযোগ্য ঘোষণা করেছিল আদালত। তাকে কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে পাঁচ বছরের জন্য অযোগ্য উল্লেখ করা হয়েছিল। পাকিস্তানের বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান আহসান ভুন বলেন, নওয়াজ শরিফের অযোগ্যতা আজীবনের জন্য। নিজের দৃষ্টিকোণের সমর্থনে ২০১৩ সালের আবদুল গফুর লেহরি মামলার উদ্ধৃতি দিয়ে তিনি বলেন, সাবেক প্রধান বিচারপতি ইফতিখার মোহাম্মদ চৌধুরী ৬৩ অনুচ্ছেদের অধীনে কিছু অযোগ্যতার কথা বলেছিলেন। এই অনুচ্ছেদ অনুযায়ী নির্দিষ্ট সময়ের পর অযোগ্য ব্যক্তি আবার যোগ্যতা ফিরে পেতে পারেন। কিন্তু ৬২ অনুচ্ছেদের আওতায় অযোগ্য ঘোষিত হলে তা স্থায়ীভাবেই অযোগ্য। আহসান ভুন বলেন, একজন ব্যক্তির ক্ষেত্রে ৬২ অনুচ্ছেদে নির্দিষ্ট কোনো সময়ের কথা বলা হয়নি। কেউ যদি এ অনুচ্ছেদের বলে সংসদ নির্বাচনের জন্য অযোগ্য বলে বিবেচিত হন, তবে তিনি সংসদ নির্বাচনের জন্য যোগ্যও হতে পারেন। সাবেক অতিরিক্ত অ্যাটর্নি জেনারেল তারিক খোখারও বলেন, নওয়াজ শরিফের অযোগ্যতা চিরস্থায়ী। কিন্তু দেশটির নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক একজন জ্যেষ্ঠ আইনজীবী বলেন, ৬২ অনুচ্ছেদে অযোগ্য ঘোষিত হলেও নির্দিষ্ট সময়ের পর যোগ্যতা ফিরে পাওয়ার কথা বলা হয়েছিল; ১৯৭৩ সালে এটা কার্যকর হয়। পরে ১৯৭৭ সালে জেনারেল জিয়াউল হক ক্ষমতা দখল করে ৬২ অনুচ্ছেদে সংশোধনী এনে সেটি অস্পষ্ট করেন। ফলে এই অনুচ্ছেদে কেউ অযোগ্য ঘোষিত হলে তা স্থায়ী না সাময়িক, সেটা নিয়ে বিতর্ক হচ্ছে।

কোন পথে যাবে পাকিস্তান : নওয়াজ শরিফের পতনের ফলে পারমাণবিক শক্তিধর পাকিস্তানের ক্ষমতার শীর্ষস্থানে শূন্যতা সৃষ্টি হয়েছে। যদি তা দীর্ঘ সময় চলতে থাকে তাহলে দেশ অস্থিতিশীল হয়ে উঠতে পারে বলে সতর্কতা দিয়েছেন বিশেষজ্ঞরা। এ খবর দিয়েছে বার্তা সংস্থা এএফপি। এতে বলা হয়েছে, পাকিস্তানের ইতিহাসে কোনো প্রধানমন্ত্রীই পুরো ৫ বছর ক্ষমতার মেয়াদ পূরণ করতে পারেননি। আর দেশটিতে সেনাবাহিনীর শাসনের ইতিহাস আছে। তা সত্ত্বেও ক্ষমতা দৃশ্যত রয়ে যাচ্ছে বেসামরিক সরকারের হাতে এবং সেটা সেই নওয়াজের পাকিস্তান মুসলিম লীগ-নওয়াজ (পিএমএলএন)-এর হাতেই। এ বিষয়ে ওয়াশিংটন ডিসির উইলসন সেন্টারের মাইকেল কুগেলম্যান বলেছেন, পাকিস্তানের মতো একটি পরিবর্তনশীল (ভোলাটাইল) দেশে যখন একজন প্রধানমন্ত্রীকে বরখাস্ত করা হয় তখন উদ্বিগ্ন হওয়ার যথেষ্ট কারণ রয়েছে। তবে আমার বিশ্বাস বলছে, সবকিছুই ঠিকঠাক থাকবে। একজন উত্তরসূরি বাছাই করা হবে এবং বর্তমান সরকার তার মেয়াদ পূরণ করবে। উল্লেখ্য, পাকিস্তানের ৭০ বছরের ইতিহাসে অনেকবার সামরিক অভ্যুত্থান হয়েছে। এসেছে অস্থিতিশীলতা। কিন্তু সম্প্রতি তা একটি উন্নয়নশীল দেশের দিকে এগিয়ে যাচ্ছিল। তারা নিরাপত্তা ও ইতিবাচক অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধির দিকে অগ্রসর হচ্ছিল সাম্প্রতিক বছরগুলোতে। ২০১৩ সালের গণতান্ত্রিক নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো ক্ষমতায় আসেন নওয়াজ শরিফ। এটাকে স্থিতিশীলতার একটি শক্তিশালী চিহ্ন হিসেবে দেখা হয়। ওই নির্বাচনের মাধ্যমে একটি গণতান্ত্রিক নির্বাচনে নির্বাচিত একটি সরকার থেকে আরেকটি সরকারের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর হয়। এখন দেখার বিষয় বেসামরিকের হাতেই ক্ষমতা থাকবে নাকি সেনাবাহিনী ‘শূন্যস্থান’ পূরণে এগিয়ে আসবে। এএফপি, বিবিসি, ডন অনলাইন।

সর্বশেষ খবর