সোমবার, ৭ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

ভয়ঙ্কর সাইবার অপরাধীরা

সাড়ে চার বছরে মামলা বেড়েছে ২৬২ গুণ

সাখাওয়াত কাওসার

ভয়ঙ্কর সাইবার অপরাধীরা

মাত্র তিনটি মামলা নিয়ে ২০১৩ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে সাইবার মামলার বিচারে বিশেষ ট্রাইব্যুনালের যাত্রা শুরু হয়েছিল। পরের বছর ২০১৪ সালে ট্রাইব্যুনালে মামলা আসে ৩২টি। ২০১৫ সালে ১৫২, ২০১৬ সালে ২৩৩টি। সর্বশেষ চলতি বছরের জুলাই পর্যন্ত আসা ৩৬৬টি মামলা নিয়ে ট্রাইব্যুনালে মোট মামলার সংখ্যা গিয়ে দাঁড়িয়েছে ৭৮৬টি। তবে ট্রাইব্যুনালের পেশকার মো. শামীম আল মামুন জানিয়েছেন, এরই মধ্যে ২২২টি মামলা নিষ্পত্তি হয়ে গেছে। বিচারাধীন রয়েছে ৫৬৫টি। অর্থাৎ প্রতিষ্ঠার পর থেকে এ যাবৎকাল পর্যন্ত সাড়ে চার বছরে সাইবার আইনে মামলার সংখ্যা বেড়েছে ২৬২ গুণ। উপরের সংখ্যাই বলছে, জ্যামিতিক হারে বাড়ছে সাইবার মামলা। তবে অন্য সূত্র বলছে, প্রকৃত চিত্র আরও ভয়াবহ। ভুক্তভোগীদের মাত্র ৩০ শতাংশ মামলা পর্যন্ত যান। সব মিলিয়ে রীতিমতো ভয়ঙ্কর হয়ে উঠেছে সাইবার অপরাধীরা। আইন প্রয়োগকারী সংস্থারও মাথাব্যথার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে এরা। ‘সাইবার অপরাধের তুলনায় মামলার সংখ্যা অনেক কম’ স্বীকার করে এ বিষয়ে ঢাকা মহানগর পুলিশের (ডিএমপি) সাইবার সিকিউরিটি অ্যান্ড ক্রাইম বিভাগের অতিরিক্ত উপকমিশনার মিশুক চাকমা বলেন, আমরা অনেক সময়ই ঘটনার গভীরতা এবং গুরুত্বের বিষয়টি আমলে নিয়ে লিখিত অভিযোগের ভিত্তিতে ব্যবস্থা নিই। তবে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই ভুক্তভোগীরা মামলা করতে অনীহা প্রকাশ করেন, অথবা নিজেরাই সমঝোতা করে নেন। তিনি আরও বলেন, পর্নোগ্রাফি, ফেসবুক হ্যাকিং, অ্যাকাউন্ট হ্যাকিং, সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে অপপ্রচার— এসব নিয়েই সাধারণত সাইবার অপরাধের অভিযোগগুলো আসে। ফেসবুক হ্যাকিংয়ের ক্ষেত্রে দেখা গেছে, প্রায় সবাই ফিসিং লিংকে ক্লিক করেছেন। তবে এক্ষেত্রে ইন্টারনেট ব্যবহারকারী এবং অভিভাবকদের আরও সচেতন হওয়ার পরামর্শ দেন তিনি।  জানা গেছে, গত ১ আগস্ট উত্তরা ৯ নম্বর সেক্টর থেকে পর্নোগ্রাফি ও প্রতারণার অভিযোগে পুলিশের সাবেক ডিআইজি মরহুম সুলতান মাহমুদের ছেলে ফুয়াদ বিন সুলতানকে গ্রেফতার করে এলিট ফোর্স র‌্যাব। প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদেই সে অসংখ্য নারীর সঙ্গে বন্ধুত্বের সম্পর্ক স্থাপন করে ব্ল্যাকমেইল, একপর্যায়ে জোরপূর্বক যৌন সম্পর্ক স্থাপন, ওয়েবসাইটভিত্তিক যৌনকর্মী সরবরাহ এবং খদ্দেরদের সঙ্গম দৃশ্য ধারণ করে অর্থ হাতিয়ে নেওয়ার বিষয়টি স্বীকার করেছে। অনেক সঙ্গম দৃশ্য এডিট করে পর্নো ছবি তৈরি করে দেশি-বিদেশি বিভিন্ন সাইটে উচ্চমূল্যে বিক্রির বিষয়েও তথ্য দিয়েছে ফুয়াদ। তথ্যপ্রযুক্তি আইনে দায়ের করা মামলায় ফুয়াদকে এক দিনের রিমান্ডে নিয়ে জিজ্ঞাসাবাদ করার পর কারাগারে পাঠায় উত্তরা পশ্চিম থানা পুলিশ।  এদিকে বাংলাদেশ সরকারের তথ্য ও যোগাযোগ প্রযুক্তি (আইসিটি) বিভাগের সাইবার হেল্প ডেস্কের তথ্য অনুযায়ী, ৭০ শতাংশ অভিযোগই আসছে নারীদের কাছ থেকে। তবে অন্যান্য অভিযোগগুলোর মধ্যে আরও আছে ফেসবুক আইডি হ্যাক, ই-মেইল আইডি হ্যাক, বিভিন্ন ধরনের পর্নো সাইট বা ব্যক্তিগত ছবি পর্নো সাইটে ছেড়ে দেওয়া ইত্যাদি। এর বাইরেও অনলাইনে প্রতারণা বাংলাদেশে সাইবার অপরাধের বড় একটি জায়গা দখল করে ফেলেছে।  জানা গেছে, সম্প্রতি যৌন হয়রানির অভিযোগে খিলগাঁও তিলপাপাড়া থেকে গ্রেফতার আহসান হাবিব পেয়ারের তথ্যে রীতিমতো চোখ কপালে উঠেছে তদন্তসংশ্লিষ্টদের। এরই মধ্যে এই ভণ্ডপীর স্বীকার করেছে, জিন তাড়ানোসহ অনেক সমস্যার সমাধানের কথা বলে সে শতাধিক নারীর সঙ্গে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করেছে। এসব ভিডিও দেখিয়ে পরবর্তীতে সে উল্টো বিপুল পরিমাণ টাকা হাতিয়ে নিচ্ছিল ভুক্তভোগীদের কাছ থেকে। ইউটিউব চ্যানেলে বিভিন্ন ধর্মীয় ভিডিও প্রচার করে শুরুতে সে অনেক অনুসারী তৈরি করেছিল। পরবর্তীতে অনেক নারীকেই বাসায় এনে ইমোশনাল ব্ল্যাকমেইল করে যৌন সম্পর্ক স্থাপন করত। এরই মধ্যে সিটি পুলিশ তার কম্পিউটার থেকে অন্তত ২০টি পর্নো ভিডিও উদ্ধার করেছে।  ২০১৬ সালের মে মাসের ঘটনার ব্যাপারে জানা গেছে, ‘গ্লোব সফট ড্রিকংস লি.’-এর মেইল ([email protected]) হ্যাক করে ১৯ হাজার ১০০ ডলার হাতিয়ে নিয়েছিল দেশি-বিদেশি প্রতারক চক্র। আমদানিকারক প্রতিষ্ঠান কুয়েতস্থ টেকিনেইট করপোরেশন জেনারেল ট্রেডিংকে বোকা বানিয়ে চক্রটি তাদের দেওয়া রাজধানীর আশকোনার ব্র্যাক ব্যাংকে ‘ক্রিসেন্ট ট্যানারিজ’ এর নামে অ্যাকাউন্টে অর্থ আনিয়ে নেয়। প্রায় দুই মাস আমদানিকারকদের কাছ থেকে কোনো ধরনের সাড়া না পেয়ে গ্লোব ড্রিংকস কর্তৃপক্ষ ২১ মে মোবাইলে কথা বলে অর্থ ট্রান্সফারের বিষয়টি সম্পর্কে নিশ্চিত হয়। পরে ২৮ মে তেজগাঁও শিল্পাঞ্চল থানায় মামলা দায়ের করলে ঘটনার সঙ্গে জড়িত ডিএমপির সিটি ইউনিট প্রতারক চক্রের চার সদস্য আফ্রিকার নাগরিক ডেনিস গোমেজ, খোরশেদ বাবু, এনায়েত কবীর ও মনির হোসেন স্বপনকে গ্রেফতার করে। যদিও কিছুদিনের মধ্যেই তারা জামিনে বের হয়ে আসে।  অপরাধ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অনেক সমস্যা জিইয়ে রেখেই সাইবার ট্রাইব্যুনালের কার্যক্রম চলছে। অবকাঠামোগত সক্ষমতার অভাবে সেখানে অনেক মামলাই প্রমাণ করা সম্ভব হচ্ছে না। এর কারণে পার পেয়ে যাচ্ছে অপরাধীরা। অনেকেরই নেই তথ্যপ্রযুক্তি সম্পর্কে পর্যাপ্ত জ্ঞান। আবার অনেকেই কেবল হয়রানি করতে তথ্যপ্রযুক্তি আইনের ৫৭ ধারায় মামলা করছেন।  এ বিষয়ে সুপ্রিম কোর্টের অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম বলেন, সাইবার মামলাগুলো জেলা আদালতেও শুনানির ব্যবস্থা করার জন্য আমি মন্ত্রণালয়কে অনুরোধ করব। একই সঙ্গে সংশ্লিষ্ট ব্যক্তিদের বিশেষায়িত প্রশিক্ষণের প্রয়োজন রয়েছে।

তথ্যপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ তানভীর জোহা বলেন, সাইবার ট্রাইব্যুনালের অবকাঠামোগত সমস্যার কারণে অনেক মামলা প্রমাণ করা সম্ভব হয় না। তবে ব্যক্তি সচেতনতা ৬০ ভাগ ক্ষেত্রে সাইবার ক্রাইম মোকাবিলা করতে পারে।

 রপরও রাষ্ট্রের সব পর্যায় থেকে সবাইকে এ অপরাধ মোকাবিলায় যুগোপযোগী কর্মপন্থা গ্রহণ করতে হবে। তিনি আরও বলেন, কর্তৃপক্ষের উচিত হবে গেটওয়েগুলোতে ফিল্টারের ব্যবস্থা করা। এতে করে সাসপেক্টেড সাইটগুলোতে কারা প্রবেশ করছে- তা মনিটরিং করা সম্ভব হবে। একই সঙ্গে চাইলেই অভিভাবকরা পেরেন্টাল কন্ট্রোলের (ব্রডব্যান্ড ইন্টারনেট ব্যবহারকারী) মাধ্যমে তাদের সন্তাদের মনিটরিংয়ের মধ্যে রাখতে পারবেন।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর