বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

মা পাশে ছিলেন বলেই বাবা সফল : প্রধানমন্ত্রী

নিজস্ব প্রতিবেদক

মা পাশে ছিলেন বলেই বাবা সফল : প্রধানমন্ত্রী

ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন প্রধানমন্ত্রী —বাংলাদেশ প্রতিদিন

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের ছয় দফাকে আট দফা করতে চেয়েছিলেন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ও মওদুদ আহমদ। তারা বঙ্গবন্ধু পরিবারকে বিভিন্নভাবে প্রভাবিত করারও চেষ্টা করেন।

গতকাল দুপুরে রাজধানীর ওসমানী স্মৃতি মিলনায়তনে বেগম ফজিলাতুন্নেছা মুজিবের ৮৭তম জন্মবার্ষিকী উপলক্ষ্যে আয়োজিত এক অনুষ্ঠানে প্রধানমন্ত্রী একথা বলেন। শেখ হাসিনা বলেন, আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা চলাকালে আন্দোলন যখন তুঙ্গে, যখন সংগ্রাম পরিষদ গঠন হল, ঠিক তখনই আইয়ুব খান বিরোধীদলসহ সবার সঙ্গে আলোচনার জন্য বৈঠক ডাকেন।

ওই বৈঠকে যোগ দেওয়ার জন্য আব্বাকে প্যারোলে নিয়ে যাবে। আমাদের প্রায় সব নেতাই রাজি ছিলেন যে, আব্বা প্যারোলে যাক। কিন্তু আমার মা কখনোই এর সঙ্গে একমত ছিলেন না।    তিনি বলেন, মায়ের মতো একটা সাথী পেয়েছিলেন বলেই কিন্তু আব্বা সংগ্রাম করে সফলতা অর্জন করতে পেরেছিলেন। তাজউদ্দিন আহমেদ, ড. কামাল হোসেন ও ব্যারিস্টার আমিরুল ইসলামের মতো সহযোগীরা যখন আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা থেকে বঙ্গবন্ধুর প্যারোলে মুক্তি নিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানে আইয়ুব খানের সঙ্গে বৈঠকের পক্ষে ছিলেন, তখন একমাত্র ফজিলাতুন্নেছা এর বিপক্ষে ছিলেন বলে জানান প্রধানমন্ত্রী। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার মনে আছে, মা আমাকে খবর দিলেন, ‘তুমি শিগগিরি আস, তোমাকে এক্ষুণি (ঢাকা সেনানিবাসে) যেতে হবে। ওখানে প্যারোলে নেবার জন্য সবাই অস্থির, উদ্গ্রীব। তোমার আব্বা যেন না যায়’। উনি ডিকটেশন দিলেন, আর মনি ভাই (শেখ ফজলুল হক মনি) লিখে দিলেন। ওয়াজেদ সাহেব গাড়ি চালাচ্ছিলেন, আমি জোরে জোরে পড়লাম সুযোগ পেলে চিঠিটা দেব, নয় তো ম্যাসেজটা দেব। সেদিন শেখ হাসিনা যখন সেনানিবাসে পৌঁছালেন, আওয়ামী লীগের বড় নেতারা তখন ভেতরে উপস্থিত। বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে যেতে তেজগাঁও বিমানবন্দরে বিমান প্রস্তৃুত। সেখানে গিয়ে দেখলাম, মানিক কাকার (তফাজ্জল হোসেন মানিক মিয়া) গাড়ি। সেই গাড়িতে করে আমাদের নেতা তাজউদ্দীন সাহেব (তাজউদ্দীন আহমদ), সালাম খান (আবদুস সালাম খান), ড. কামাল (কামাল হোসেন), আমিরুল ইসলাম (ব্যারিস্টার এম. আমিরুল ইসলাম) এরা সকলেই সেখানে উপস্থিত। সাথে আরেকজন ছিল, সে আমাদের আওয়ামী লীগের নেতা না হলেও সব সময় সাথে সাথে ঘুরঘুর করতো। সেটা হচ্ছে মওদুদ আহমদ। সেনানিবাসের তখনকার পরিস্থিতি স্মরণ করে শেখ হাসিনা বলেন, অনেক নেতা ছিলেন। কিন্তু আমাকে ভিতরে ঢুকতে দিচ্ছিল না। আমি কিন্তু গেইটের বাইরে দাড়ানো। সেখানে একজন কর্নেল নাসির নামে.. সে সবুজ একটা ফোর হুইলার জিপ নিয়ে দাড়িয়ে আছে, আব্বাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে। আমি খুব উসখুস করছি, আব্বা যদি একটু বের হয়, আব্বা যদি জানতে পারে আমি আছি আমার উপস্থিতিটা দেখলে উনি বুঝতে পারবেন যে মা কোনো ম্যাসেজ দিয়ে পাঠিয়েছেন। সকলের আড়ালে সেদিন বাবার কাছে মায়ের বার্তা পৌঁছে দেওয়ার কথা অনুষ্ঠানে তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, আব্বা কথা বলতে বলতে যখন দরজার কাছে এসে দাঁড়ালেন, দেখলেন আমি দাড়ানো। উনি হেঁটে বাইরে আসলেন। উনাকে বাইরে আসতে দিচ্ছে না। আমাকেও ঢুকতে দিচ্ছে না। নিচু কাঠের গেইট। গেইটটা একটু ফাঁক করা। ওখান থেকে উনি আমাকে আদর করার জন্য গলাটা জড়িয়ে ধরে বললেন, ‘কোনো চিঠি টিঠি দিস না, তোর মা কি বলেছে বল’। আমি শুধু বললাম, মা এখন প্যারোলে যেতে নিষেধ করেছে, কোনো সিদ্ধান্ত নিতে নিষেধ করেছে। উনি দেখা করার জন্য সময় চেয়েছেন। সময় পেলে উনি আসবেন। মা নিষেধ করেছে যেতে। আপনি কিন্তু যাবেন না। আব্বা শুধু বললেন, ‘আমি জানি।’ এটুকু বলে উনি ভিতরে গেলেন। তিনি বলেন, আমাদের নেতারা মনে হয় এটা খুব ভালো চোখে দেখলেন না। যতক্ষণ পর্যন্ত না তারা ওখান থেকে বের হয়েছেন, ততক্ষণ পর্যন্ত আমি ওখান থেকে সরিনি। একটা পর্যায়ে উনারা বের হয়ে আসলেন। কেউ জিপে, কেউ মানিক কাকার গাড়িতে করে রওনা হলেন। উনারা জাহাঙ্গীর গেইটের দিকে আসলেন। আমি আবার ভেতর থেকে মহাখালীর দিকের যে রাস্তা, ওখান থেকে বের হয়ে বাসায় আসলাম। শেখ হাসিনা সেদিন ধানমণ্ডির ৩২ নম্বর সড়কের বাড়িতে ফেরার আগেই জ্যেষ্ঠ নেতারা সেখানে উপস্থিত হয়েছিলেন। দেখি নিচের তলায় সব নেতারা বসা। আমার মায়ের ওপর বেশ জুলুম যাচ্ছে। তারা মাকে বললেন, আপনি এটা কী করলেন ভাবি? তারা বুঝে গিয়েছিলেন, আমি যখন গিয়েছি, কোনো তথ্য দিয়েছি। আব্বা তো আর যাবেন না। মাকে বললেন, আপনি কী জানেন যে আপনি বিধবা হবেন? মা শুধু জবাব দিলেন, আমি কেন, সাথে তো আরও ৩৪ জন আসামি আছে? বিধবা তো তাদের স্ত্রীরাও হবে। আর বাংলাদেশের কী হবে? বাংলাদেশের কী ভবিষ্যত? বাংলাদেশের কথা আগে চিন্তা করেন, দেশের কথা আগে চিন্তা করেন। আমার কথা চিন্তা করতে হবে না’। শেখ হাসিনা বলেন, যখন তিনি দেখলেন যে নেতারা তাদের যুক্তি বেগম ফজিলাতুন নেছাকে মানাতে পারছেন না, তখন তিনি বাড়ির উপরে চলে যান। পরে আমিরুল ইসলাম ও মওদুদ আহমদও উপরে যান। শেখ হাসিনা বলেন, আমাকে সামনে পেয়েই আমিরুল ইসলাম খুব কঠিনভাবে আমাকে বললেন, ‘তুমি কেমন মেয়ে, তুমি চাওনা তোমার বাবা বেরিয়ে আসুক? তোমার বাবা মুক্তি পাক?  মানে, তার কথা হচ্ছে, আমি কেন গেলাম। আমার খুব রাগ হল।

আমি শুধু বললাম, আমার বাবা মুক্তি পাবে। সম্মানের সাথে মাথা উঁচু করে আসবে। আপনারা উল্টা- পাল্টা করবেন না। এর মধ্যে মাও উপরে আসলেন। আমি তাকে জড়িয়ে ধরে চিৎকার দিয়ে কাঁদলাম। মা বললেন, ‘তুমি কাঁদো কেন? কাঁদবা না। তোমার আব্বা বেরিয়ে আসবেন, সম্মানের সাথে বেরিয়ে আসবেন’।

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, দেশের জনগণ কী চায় তা বোঝা এবং জনমত সৃষ্টি করার পেছনে মায়ের বিরাট অবদান ছিল। জীবনের সব আশা-আকাঙ্ক্ষা বিসর্জন দিয়ে, ভোগ বিলাস বিসর্জন দিয়ে আমার বাবার পাশে থেকে থেকে এদেশের মানুষের স্বাধীনতা দিয়ে গেছেন আমার মা। মায়ের রাজনৈতিক প্রজ্ঞার কথা বলতে গিয়ে তিনি বলেন, ১৯৬৬ সালে মে মাসে আব্বাকে গ্রেফতার করার পর ৭ই জুন একটা হরতাল দেওয়া হয়। সেই হরতালটাকে সংগঠিত করা, কার্যকর করা, এই কাজগুলো কিন্তু আমার মা করেছে।ৃ আমিতো বলব, আমরা মা ছিলেন আসলে একজন গেরিলা।

 বাষ্পরুদ্ধ কণ্ঠে থেমে থেমে সেই সময়ের কথা তুলে ধরে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৬৬ সালের ৮ই মে যখন নারায়ণগঞ্জে মিটিং করে আসলেন.. আর, ওই মিটিং করে ফিরে আসার পর আব্বাকে গ্রেফতার করে নিয়ে যাওয়া হল। ৯ তারিখে অফিসিয়ালি গ্রেফতার দেখানো হল। ওই অবস্থায় একটার পর একটা মামলা দিয়ে কোনো কোনো মামলায় শাস্তিও দিয়েছে। এরপর ১৯৬৮ সালের শুরুর দিকে বঙ্গবন্ধুকে ঢাকা সেনানিবাসে আটক করা হয়। দায়ের করা হয় তথাকথিত আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলা।

সর্বশেষ খবর