বুধবার, ৯ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
খোলা মত

বিশ্বজিৎ হত্যা মামলা আর কানাডীয় কোর্টের রায় নিয়ে কথা

শওগাত আলী সাগর

ঢাকার বিশ্বজিৎ আর টরন্টোর ওয়ারেন নিজেল এবির ঘটনাটা ঠিক একরকম নয়। বিশ্বজিৎ নৃশংসভাবে খুন হয়েছেন প্রকাশ্য দিবালোকে। ঢাকার রাস্তায় তাকে কুপিয়ে কুপিয়ে হত্যা করা হয়েছে। আর ওয়ারেন নিজেল নিজেই একটি হত্যা মামলার আসামি। তবু ঢাকায় উচ্চ আদালতে বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার আপিলের রায় হওয়ার পর প্রথম ওয়ারেন নিজেলের কথাই মনে পড়ল। তার মামলার রায়টাও হয়েছে মাত্র গত শুক্রবার। ওয়ারেন নিজেলকে পুলিশ গ্রেফতার করেছিল একটি হত্যা মামলার সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে। সন্দেহের কারণ, ওয়ারেন তার চোখের নিচে টিয়ার ড্রপ অশ্রুকণা টাট্টু এঁকেছিলেন। পশ্চিমা দেশে নারী-পুরুষনির্বিশেষে শরীরের বিভিন্ন অঙ্গে নানা ধরনের টাট্টু আঁকে। সেসব টাট্টুর নাকি আবার নানারকম অর্থও থাকে, থাকে কিছু ইতিহাস। টিয়ার ড্রপ টাট্টু আঁকার পেছনেও আছে তেমন ইতিহাস। সেই ইতিহাসের ধারণা থেকেই ওয়ারেনকে গ্রেফতার করে বিচারের মুখোমুখি করে টরন্টোর পুলিশ। সেটা ২০০৪ সালের কথা। ম্যালবারন ক্রু গ্যাংয়ের সদস্য পিটারকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছিল। সেই হত্যাকাণ্ডের সন্দেহভাজন আসামি হিসেবে গ্রেফতার হন ওয়ারেন। পুলিশের সন্দেহের কারণ, ওয়ারেনের চোখের নিচে টিয়ার ড্রপ টাট্টু। পুলিশের অভিযোগ, ওয়ারেন নিজেও ম্যালবারন ক্রু গ্যাংয়ের সদস্য। কিন্তু পিটারকে তিনি মনে করছিলেন প্রতিপক্ষ গ্যালওয়ে বয়েজের সদস্য। আর সেই ধারণা থেকেই তাকে গুলি করে হত্যা করেন ওয়ারেন। রাষ্ট্রপক্ষ একজন সমাজবিজ্ঞানীকে সাক্ষী হিসেবে আদালতে নিয়ে আসে। সমাজবিজ্ঞানী মার্ক টটেন টাট্টু নিয়ে গবেষণা করেছেন এবং নিজের শরীরে টাট্টু যারা আঁকে তাদের সাক্ষাৎকার নিয়ে তার গবেষণাকে যৌক্তিক হিসেবে উপস্থাপন করেছেন। ওয়ারেনের টিয়ার ড্রপ টাট্টু সম্পর্কে এই সমাজবিজ্ঞানীর বক্তব্য হচ্ছে : ‘তিনটি কারণে কোনো নারী বা পুরুষ টিয়ার ড্রপ আঁকে। প্রথমত, হয়তো সে কোনো নিকটজনকে কিংবা সহযোদ্ধা গ্যাং সদস্যকে হারিয়েছে, না হয় মাত্র জেল খেটে এসেছে, অথবা প্রতিপক্ষ গ্রুপের কাউকে খুন করেছে।’ কিন্তু আদালত সমাজবিজ্ঞানী মার্ক টটেনকে এই মামলায় বিশেষজ্ঞ সাক্ষী হওয়ার অনুমোদন দেয়নি। ফলে পর্যাপ্ত সাক্ষ্য-প্রমাণের অভাবে ওয়ারেনকে অভিযোগ থেকে খালাস দেওয়া হয়। রাষ্ট্রপক্ষ আপিল করে আদালতের এই সিদ্ধান্তের বিরুদ্ধে। আপিল আদালত সমাজবিজ্ঞানী মার্ক টটেনকে বিশেষজ্ঞ সাক্ষী হিসেবে গ্রহণ করে। মূলত বিশেষজ্ঞ গবেষণা বক্তব্যের ওপর ভিত্তি করেই আদালত ওয়ারেনের বিরুদ্ধে তোলা খুনের অভিযোগ গ্রহণ করে। কিন্তু ওয়ারেনের পক্ষ থেকে এর বিরুদ্ধে অন্টারিওর আপিল আদালতে আপিল করা হয়। আপিল আদালত উভয় পক্ষের বক্তব্য, নথিপত্র, প্রমাণাদি নতুন করে বিশ্লেষণ করে, নতুন করে শুনানিও হয়। সমাজবিজ্ঞানী মার্ক টটেনের গবেষণা নিয়ে আদালতের মনে সংশয় তৈরি হয়। আদালতের বিশ্লেষণে দেখা যায়, সমাজবিজ্ঞানী তার গবেষণায় যে দাবি করেছেন সরাসরি সাক্ষাৎকারের ভিত্তিতে তিনি তথ্য পেয়েছেন, টিয়ার ড্রপ টাট্টু আঁকা কোনো গ্যাং সদস্যের সাক্ষাৎকার সেই গবেষণায় নেই। আদালত টাট্টু সম্পর্কিত সমাজবিজ্ঞানীর গবেষণাকে ত্রুটিপূর্ণ বলে নাকচ করে দেয়। ফলে মামলার গতিবিধিও পাল্টে যায়। আদালত মামলার পুরো কার্যক্রমই বাতিল করে দিয়ে নতুন করে বিচার শুরুর নির্দেশ দেয়। সরকার পক্ষকে জানিয়ে দেওয়া হয়, ওয়ারেনের বিরুদ্ধে আনা অভিযোগের নতুন এবং শুদ্ধ প্রমাণাদি আদালতে উপস্থাপন করতে হবে। এই জায়গাটায় এসেই বিশ্বজিতের মামলার সঙ্গে ওয়ারেনের মামলাকে পর্যালোচনার সুযোগ তৈরি হয়। বিশ্বজিতের মামলার রায় দিতে গিয়ে আদালতের বক্তব্য হিসেবে যে তথ্য পত্রিকায় এসেছে, তা হচ্ছে সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত প্রতিবেদনের ক্ষেত্রে গাফিলতির কারণে নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা হাই কোর্টে এসে কমে গেছে। সুরতহাল ও ময়নাতদন্তে আঘাতের যে বর্ণনা দেওয়া হয়েছে, তার সঙ্গে আসামিদের জবানবন্দি ও সাক্ষীদের বর্ণনার মিল পায়নি আদালত। ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল মো. মনিরুজ্জামান জানান, বিশ্বজিতের লাশের সুরতহাল করার ক্ষেত্রে সূত্রাপুর থানার এসআই জাহিদুল হকের দায়িত্বে অবহেলা ছিল কিনা, তা তদন্ত করে আইজিপিকে প্রতিবেদন দিতে নির্দেশ দিয়েছে আদালত। আর ময়নাতদন্ত করার ক্ষেত্রে স্যার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজের ফরেনসিক বিভাগের শিক্ষক মাকসুদুর রহমানের কোনো গাফিলতি ছিল কিনা, তা তদন্ত করে স্বাস্থ্য অধিদফতরের মহাপরিচালক, স্বাস্থ্য মন্ত্রণালয়ের সচিব ও ডেন্টাল কাউন্সিলকে প্রতিবেদন দিতে বলেছে হাই কোর্ট। অর্থাৎ সুরতহাল ও ময়নাতদন্ত রিপোর্ট ত্রুটিপূর্ণ ছিল এবং ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্টের কারণে নিম্ন আদালতের দেওয়া শাস্তি বদলে গেছে। নৃশংস একটি হত্যাকাণ্ডের আসামিদের শাস্তি কমে গেছে, দুজন খালাসও পেয়ে গেছেন। বিশেষজ্ঞ সাক্ষীর সাক্ষ্য আদালতের কাছে ত্রুটিপূর্ণ মনে হওয়ায় কানাডার আদালত মামলাটির বিচার নতুন করে করার নির্দেশ দিয়েছে। আর বাংলাদেশের উচ্চ আদালতে ত্রুটিপূর্ণ রিপোর্টের কারণে খুনের মামলার আসামির সাজা কমে গেছে এবং দুজন খালাস পেয়েছেন। প্রশ্ন হচ্ছে, সুরতহাল, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট যদি ত্রুটিপূর্ণ মনে হয়, আদালত তা নাকচ করে দেবে না কেন? যেমনটি করেছে কানাডার আদালত, ওয়ারেনের বিচার করতে গিয়ে। বিশ্বজিৎ হত্যা মামলার ক্ষেত্রেও কি আদালত সুরতহাল, ময়নাতদন্ত রিপোর্ট নাকচ করে দিয়ে নতুন করে বিচারের নির্দেশ দিতে পারত? আইন বিশেষজ্ঞরা এই বিষয়ে ভালো বলতে পারবেন। আমরা সাধারণ মানুষ। আমরা শুধু এটাই বুঝি, ত্রুটিপূর্ণ দলিলে যে বিচার হয়, সেই বিচারও তো হয় ত্রুটিপূর্ণ।

শওগাত আলী সাগর : টরন্টোর ‘নতুনদেশ’ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক।

সর্বশেষ খবর