নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুনের মামলায় সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র্যাব-১১-এর সাবেক অধিনায়ক কর্নেল (বরখাস্ত) তারেক সাঈদ মোহাম্মদসহ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট। বিচারিক আদালতে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ২৬ জনের মধ্যে বাকি ১১ জনকে সাজা কমিয়ে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।
সাত খুনের দুই মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স, আপিল ও জেল আপিলের শুনানি শেষে গতকাল বিচারপতি ভবানীপ্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাইকোর্ট বেঞ্চ এ রায় দেন। এ মামলার ৩৫ আসামির মধ্যে বাকি নয়জনকে নিম্ন আদালতের দেওয়া সাজা বহাল রয়েছে। সাত খুনের অন্যতম শিকার নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি হাইকোর্টের রায়ে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন। স্বস্তি প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলমও। তবে তিনি বলেন, যাদের সাজা কমানো হয়েছে, পূর্ণাঙ্গ রায় পড়ে তাদের বিরুদ্ধে আপিলের ব্যাপারে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। এদিকে আসামিপক্ষের আইনজীবীরা বলেছেন, নির্দেশনা পেলে এ রায়ের বিরুদ্ধে তারা আপিল করবেন। রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, আসামিরা যে ধরনের অপরাধ করেছেন, তাতে তারা ছাড়া পেয়ে গেলে বিচার বিভাগের প্রতি জনগণ আস্থাহীনতায় ভুগবে। কতিপয় ব্যক্তির কপকর্মের কারণে র্যাবের গৌরবময় কর্মকাণ্ড বৃথা যেতে পারে না। এই নিষ্ঠুর হত্যাকাণ্ডকে ধামাচাপা দিতেই লাশ নদীতে ফেলে রাখা হয়েছে। এর পেছনে তাদের উদ্দেশ্য ছিল ঘটনার আলামত নিশ্চিহ্ন করা।
যেমন কর্ম তেমন ফল : হাইকোর্টে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত অপর আসামিরা হলেন—সাবেক দুই কোম্পানি কমান্ডার মেজর (বরখাস্ত) আরিফ হোসেন ও লেফটেন্যান্ট কমান্ডার (বরখাস্ত) এম মাসুদ রানা, হাবিলদার মো. এমদাদুল হক, এ বি মো. আরিফ হোসেন, ল্যান্স নায়েক হীরা মিয়া, ল্যান্স নায়েক বেলাল হোসেন, সিপাহী আবু তৈয়ব আলী, কনস্টেবল মো. শিহাব উদ্দিন, এসআই পূর্ণেন্দু বালা, সৈনিক আবদুল আলিম, সৈনিক মহিউদ্দিন মুনশি, সৈনিক আল আমিন ও সৈনিক তাজুল ইসলাম।হাইকোর্টে যাবজ্জীবন পাওয়া আসামিরা হলেন—সৈনিক আসাদুজ্জামান নূর, সার্জেন্ট এনামুল কবির, নূর হোসেনের সহযোগী আলী মোহাম্মদ, মিজানুর রহমান দিপু, রহম আলী, আবুল বাশার, মোর্তুজা জামান চার্চিল, সেলিম, সানাউল্লাহ, শাহজাহান ও জামালউদ্দিন। আসামিদের মধ্যে করপোরাল রুহুল আমিন, এএসআই বজলুর রহমান, সৈনিক নূরুজ্জামান, কনস্টেবল বাবুল হাসান, এএসআই আবুল কালাম আজাদ, এএসআই কামাল হোসেন, করপোরাল মোখলেছুর রহমান, কনস্টেবল হাবিবুর রহমান ও হাবিলদার নাসির উদ্দিনকে বিচারিক আদালতের দেওয়া বিভিন্ন মেয়াদের সাজা বহাল রেখেছেন হাইকোর্ট।
রোমহর্ষক সেই ঘটনা : ২০১৪ সালের ২৭ এপ্রিল ঢাকা-নারায়ণগঞ্জ লিংক রোড থেকে অপহূত হন নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের কাউন্সিলর নজরুল ইসলাম, তার বন্ধু সিরাজুল ইসলাম লিটন, সহযোগী মনিরুজ্জামান স্বপন, তাজুল ইসলাম ও স্বপনের গাড়িচালক জাহাঙ্গীর। ওই ঘটনা দেখে ফেলায় নজরুলের গাড়ির পেছনে থাকা আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিমও অপহূত হন। এর তিন দিন পর ৩০ এপ্রিল শীতলক্ষ্যা নদীতে একে একে ছয়টি লাশ ভেসে ওঠে। পরদিন পাওয়া যায় আরেকটি লাশ। এ ঘটনায় কাউন্সিলর নজরুলের স্ত্রী সেলিনা ইসলাম বিউটি বাদী হয়ে আওয়ামী লীগের স্থানীয় নেতা সিদ্ধিরগঞ্জ থানা আওয়ামী লীগের সহ-সভাপতি নূর হোসেনসহ ছয়জনের নাম উল্লেখ করে ফতুল্লা মডেল থানায় মামলা করেন। আইনজীবী চন্দন সরকার ও তার গাড়িচালক ইব্রাহিম হত্যার ঘটনায় একই থানায় আরেকটি মামলা করেন চন্দন সরকারের জামাতা বিজয় কুমার পাল। ইতিমধ্যে এ ঘটনায় র্যাব-১১-এর অধিনায়ক তারেক সাঈদসহ তিন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তার সম্পৃক্ততার তথ্য প্রকাশ পায়। টাকার বিনিময়ে হত্যার অভিযোগ ওঠে। ঘটনার ভয়াবহতায় শিউরে ওঠে মানুষ। দুটি মামলা একসঙ্গে তদন্ত করে পুলিশ। দুই মামলার তদন্ত শেষে নারায়ণগঞ্জের সাবেক কাউন্সিলর নূর হোসেন ও র্যাবের সাবেক তিন কর্মকর্তাসহ ৩৫ জনকে আসামি করে অভিযোগপত্র দেন তদন্ত কর্মকর্তা মামুনুর রশিদ মন্ডল। ১৬ জানুয়ারি নারায়ণগঞ্জ জেলা ও দায়রা জজ সৈয়দ এনায়েত হোসেন রায় দেন। রায়ে অপহরণ, হত্যা, লাশ গুম ও ষড়যন্ত্রের অভিযোগ প্রমাণিত হওয়ায় ২৬ জনকে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়। বাকি নয়জনকে বিভিন্ন মেয়াদে কারাদণ্ড দেওয়া হয়। ফাঁসির আদেশপ্রাপ্ত আসামিদের মৃত্যুদণ্ড অনুমোদনের জন্য পরে মামলাটি ডেথ রেফারেন্স হিসেবে হাইকোর্টে আসে। পাশপাশি আসামিরা আপিল ও জেল আপিল করেন। শুনানি শেষে ১৩ আগস্ট রায় ঘোষণার দিন ধার্য থাকলেও সেদিন রায় ঘোষণা হয়নি। পরিবর্তিত তারিখ অনুযায়ী গতকাল রায় দেন আদালত। সকাল সাড়ে ১০টায় হাইকোর্ট এ মামলার রায় পড়া শুরু করেন। প্রথমে বিচারকক্ষে সাংবাদিকদের প্রবেশে বাধা দেয় পুলিশ। পরে আদালতের হস্তক্ষেপে সাংবাদিকরা বিচারকক্ষে প্রবেশ করেন।
মিশ্র প্রতিক্রিয়া : নারায়ণগঞ্জে আলোচিত সাত খুন মামলা হাই কোর্টের রায়ের পর মিশ্র প্রতিক্রিয়া জানিয়েছেন বাদী-বিবাদী পক্ষের স্বজনেরা। রায়কে দৃষ্টান্তমূলক বলেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। তবে হাই কোর্টের এ রায়ের জন্য গণমাধ্যমকে দায়ী করে প্রতিক্রিয়া দিয়েছেন ফাঁসির দণ্ডপ্রাপ্ত নূর হোসেনের ভাই নূর উদ্দিন। আসামিদের করা আপিল ও ডেথ রেফারেন্সের শুনানি শেষে বিচারপতি ভবানীপ্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের বেঞ্চ গতকাল ১৫ জনকে ফাঁসি ও নিম্ন আদালতের রায়ে মৃত্যুদণ্ডপ্রাপ্ত ১১ জনকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেন। বাকি ৯ আসামির নিম্ন আদালতের রায়ই বহাল থাকে। বহুল আলোচিত এ মামলার বাদী ও নিহত নারায়ণগঞ্জ সিটি করপোরেশনের সাবেক কাউন্সিলর নজরুল ইসলামের স্ত্রী সেলিনা বেগম বিউটি গণমাধ্যমকর্মীদের কাছে তার প্রতিক্রিয়ায় বলেন, ‘আমরা এ রায়ে সন্তুষ্ট। আসামিরা যে ধরনের অপকর্ম করেছে সেসবের উপযুক্ত শাস্তি হয়েছে।’ সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও এ রায় বহাল থাকবে এবং দ্রুত দণ্ড কার্যকর হবে বলে তিনি আশা প্রকাশ করেন। নিহত নজরুলের সহযোগী নিহত তাজুল ইসলামের বাবা আবুল খায়ের বলেন, ‘আমার ছেলের মৃত্যুর পর থেকেই আমরা নিরাপত্তাহীনতায় ভুগছি। তবে আমরা এ রায়কে যুগান্তকারী রায়ই বলব। কারণ তিন বছরের মাথায়ই আমরা উচ্চ আদালতের রায় পেয়েছি। আমাদের বিশ্বাস, সুপ্রিম কোর্টের আপিল বিভাগেও এ রায় বহাল থাকবে।’ তবে নিহত নজরুলের শ্বশুর শহীদ চেয়ারম্যানের ভাষ্য, ‘হাই কোর্টের রায়ে আমরা পুরোপুরি সন্তুষ্ট হতে পারিনি। ঘটনার পর থেকে বিরামহীনভাবে আমি খুনিদের বিষয়ে কথা বলেছি। এ নিয়ে আমাকে অনেক চোখরাঙানি সহ্য করতে হয়েছে। নিম্ন আদালতের রায় উচ্চ আদালতে বহাল থাকলে আমি খুশি হতাম।’ অন্যদিকে প্রধান আসামি সাবেক ওয়ার্ড কাউন্সিলর নূর হোসেনের ভাই নূর উদ্দিন হাই কোর্টের রায়ের জন্য গণমাধ্যমকে দায়ী করেন। তিনি বলেন, ‘আমার ভাইয়ের বর্তমান পরিণতির জন্য মিডিয়া দায়ী। আসলে মিডিয়ার কারণেই এমন রায় হলো। আপনি আবার মাইন্ড কইরেন না।’ গতকাল সাত খুন মামলার রায় ঘোষণাকারী হাই কোর্ট বেঞ্চের এজলাস কক্ষের বাইরে প্রতিক্রিয়ায় নূর উদ্দিন এসব কথা বলেন। ছয় ভাইয়ের মধ্যে নূর হোসেনের পরই নূর উদ্দিনের অবস্থান। নূর হোসেনের ফেলে আসা ‘সাম্রাজ্য’ এখন নূর উদ্দিনের নিয়ন্ত্রণে বলে বিভিন্ন সংবাদমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হয়েছে। নূর উদ্দিন বলেন, মিডিয়ার চাপে সাত খুন মামলা তাড়াতাড়ি এগিয়েছে। এ কারণে তারা ঠিকমতো প্রস্তুতিও নিতে পারেননি। তারা নিম্ন আদালতে আইনজীবী দেওয়ার আগেই বিচার শুরু হয়ে যায়। তবে তার বিশ্বাস, তার ভাই ছাড়া পাবেন। আর ছাড়া না পেলে তারা আইনি লড়াই চালিয়ে যাবেন। সাত খুন মামলায় আসামিদের ডেথ রেফারেন্স (মৃত্যুদণ্ড অনুমোদন) ও আপিলের ওপর গতকাল রায় দেন বিচারপতি ভবানীপ্রসাদ সিংহ ও বিচারপতি মোস্তফা জামান ইসলামের সমন্বয়ে গঠিত হাই কোর্ট বেঞ্চ।
অ্যাটর্নি জেনারেল বললেন দৃষ্টান্তমূলক : নারায়ণগঞ্জের আলোচিত সাত খুন মামলার আপিলের রায়কে ‘দৃষ্টান্তমূলক’ বলে সন্তোষ প্রকাশ করেছেন অ্যাটর্নি জেনারেল মাহবুবে আলম। রায়ের পর অ্যাটর্নি জেনারেল সাংবাদিকদের বলেন, ‘এ হত্যাকাণ্ডে হাই কোর্ট বিভাগ ১৫ জনের মৃত্যুদণ্ড বহাল রেখেছে। এটিকে একটি দৃষ্টান্তমূলক রায়ই বলব আমি। আমরা স্বস্তি অনুভব করছি।’
কোন আসামির কী সাজা হয়েছে তা জানিয়ে রাষ্ট্রের প্রধান এই আইন কর্মকর্তা বলেন, ‘এই মৃত্যুদণ্ডের ব্যাপারে যেটা দেখতে পাচ্ছি, মূল হোতা যে চারজন ছিলেন, তারা ছাড়া মেজর আরিফের টিমে যারা ছিলেন, মাইক্রোবাসে, তাদের সবারই ফাঁসি হয়েছে। বস্তা তৈরিতে, অর্থাৎ বালুর বস্তা তৈরির টিমে থাকা ছয়জনের মধ্যে তিনজনের ফাঁসি হয়েছে।’ মাহবুবে আলম বলেন, ‘একজনের হয়েছে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড এবং দুজনের সাত বছরের জেল। নূর হোসেনের টিমে যারা ছিলেন তাদের সবারই যাবজ্জীবন হয়েছে, নূর হোসেন ছাড়া। রানার টিমে যারা ছিলেন তাদের সবাইকে, অর্থাৎ সাতজনকে ১০ বছর করে কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে। আরেকজন ছিলেন আশরাফুজ্জামান, যিনি কিনা ইনজেকশন জোগাড় করে দিয়েছিলেন, নিম্ন আদালতে তার ফাঁসির আদেশ হয়েছিল, তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড দেওয়া হয়েছে।’ ১১ জনের সাজা কমানোর বিরুদ্ধে আপিল করা হবে কি না, পুরো রায় পড়ার পর সিদ্ধান্ত নেবেন বলে জানান তিনি।