শিরোনাম
বুধবার, ২৩ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

প্রিয় নায়ক রাজ্জাক

শাইখ সিরাজ

১৯৬৬ সালে মুক্তি পেল বেহুলা চলচ্চিত্র। নায়ক রাজ্জাক। আমি তখন ক্লাস সেভেনে কি এইটে পড়ি। দুর্দান্ত সিনেমা পাগল। সদরঘাটের রূপমহল সিনেমা হলে গিয়ে ওই সিনেমা দেখেছিলাম। সিটের ওপর পা তুলে ভয়ে ভয়ে ওই সিনেমা দেখতে হয়েছিল, সাপভীতির কারণে। কিন্তু সিনেমা দেখে যেন আওয়ারা হয়ে গেলাম। দারুণ এক নায়ককে দেখলাম। তারপর রাজ্জাক অভিনীত কোনো সিনেমা বাদ দিয়েছি এমন মনে পড়ে না। রাজ্জাক অভিনীত সিনেমা, তার অভিনীত সিনেমার গান, তার সঙ্গে অভিনয় করা নায়িকা থেকে শুরু করে তার প্রতিটি বিষয়ই আমার কৈশর ও তরুণ বয়সকে নাড়া দিয়েছে। আমি চলচ্চিত্রের এমনই পাগল ছিলাম যে, দিনের পর দিন এফডিসিতে গিয়েছি রাজ্জাককে আর তার অভিনীত নায়িকাদের সামনাসামনি দেখতে। এর দুয়েক বছর পর রাজ্জাক গুলশানে একটি বাড়ি করছেন, খবর পেয়ে সেই আমি মাঝে মাঝে সেই বাড়ির সামনে ঠাঁই দাঁড়িয়ে থাকতাম, কখন নায়ক রাজ্জাক গাড়ি নিয়ে বেরিয়ে যান কিংবা আসেন তা দেখার জন্য। আমি দেখেছি, রাজ্জাক শুধু রূপ চেহারায় ঝকঝকে কোনো নায়ক ছিলেন না, তিনি ছিলেন সামগ্রিক একজন নায়ক। তিনি একেকটি চলচ্চিত্রে যে পোশাক পরতেন, তা দেখে আমি মুগ্ধ হয়ে যেতাম। বাল্যবেলা থেকেই পোশাকের প্রতি আমার অন্যরকম নেশা। সিনেমায় রাজ্জাকের পরা শার্ট দেখে পরদিনই আমি কাপড় কিনে নিয়ে দর্জির দোকানে ছুটতাম। মালিবাগের একটি টেইলার্সে রাজ্জাক পোশাক বানাতেন, আমি খোঁজ করে সেখানে গিয়েও বহুবার রাজ্জাকের মতো স্টাইলের শার্ট, একই স্টাইলের প্যান্ট বানিয়েছি। আমি নিজেই বুঝে নিয়েছি, পোশাকের এই বৈচিত্র্যের পেছনে নায়কের নিজেরই সৃৃজনশীল চিন্তা, ইচ্ছে আর আগ্রহ রয়েছে। কেউ তাকে শিখিয়ে দেয়নি। প্রিয় নায়ক বলেই রাজ্জাকের জীবনের অনেক ঘটনার সঙ্গেই দিনে দিনে পরিচিত হয়ে গেছি। প্রতিষ্ঠিত জীবনে আমার কর্মক্ষেত্র চ্যানেল আই এর নানা অনুষ্ঠানের প্রয়োজনেই নায়ক রাজ রাজ্জাকের কাজগুলো বার বার দেখেছি, আর ভেবেছি এমন নায়ক সত্যিই ভাবা যায় না। বহুবার চ্যানেল আই এর অনুষ্ঠানে আমন্ত্রণ জানিয়ে এনেছি তাকে। তিনিও এসেছেন নানা কাজে। কাছ থেকে তার সম্পর্কে জেনে বুঝেছি, বাংলাদেশ এমন একজন নায়ক পেয়েছিল বলেই হয়তো ষাটের দশকের শুরু থেকে নব্বইয়ে দশকের মাঝামাঝি পর্যন্ত টানা তিন দশক চলচ্চিত্রের এক স্বর্ণালি অধ্যায় পেয়েছিল। যা বাঙালির রাজনৈতিক, সামাজিক ও সাংস্কৃতিক ক্রমবিকাশের ক্ষেত্রের বড় এক মাইলফলক। আমি সিনেমা ভালোবাসি বলে সিনেমার গান বিষয়ক তিনটি অনুষ্ঠান নির্মাণ করি। এর মধ্যে দুটি অনুষ্ঠান একেবারে সরাসরি বাংলা চলচ্চিত্রের হারানো দিনের গান নিয়ে। একটি অনুষ্ঠানে তো গানের আসরের মতো। নাম ছিল ‘সেরা কণ্ঠ ফিরে দেখা সেরা গান’। সেখানে মধ্যমণি করেছিলাম প্রিয় নায়ক-নায়িকা নায়করাজ রাজ্জাক আর কবরীকে। প্রিয় গানগুলোতে নতুন করে কণ্ঠ ও ঠোঁট মেলানোর সুযোগ পেয়েছিলেন এই জুটি। কাছ থেকে শেয়ার করেছিলাম নায়ক রাজের প্রতি আমার অনুরাগ সম্পর্কে। তখন আমিও জেনে অবাক হলাম, টেলিভিশনে আমার কৃষি বিষয়ক অনুষ্ঠানগুলো তার অনেক পছন্দের। তিনি বহুদিন ধরেই আমার অনুষ্ঠান দেখছেন। জেনে যারপরনাই উৎসাহিত হই। আরেকটি অনুষ্ঠান করি ‘সেরাকণ্ঠ সোনালি ফ্রেম’। এই অনুষ্ঠান করতে গিয়ে রাজ্জাকের শতাধিক সিনেমায় পরিহিত পোশাক, গানে ঠোঁট মেলানোর দক্ষতা, নাচের ভঙ্গিমা, নিষ্ঠার সঙ্গে অভিনয় করার দক্ষতাগুলো খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে দেখতে হয়েছিল। আমি আজকের প্রজন্মের তরুণকে সেই পোশাক পরিয়ে সেই পরিবেশে গানের চিত্রধারণ করে রাজ্জাকের গানের সঙ্গে মেশানোর চেষ্টা করেছিলাম। আরেকবার নিবিড়ভাবে বুঝেছিলাম, রাজ্জাক একজনই হয়। অবশ্যই তার বহুমাত্রিক গুণগুলো খোদাপ্রদত্ত। সারাজীবন নিষ্ঠা আর পরিশ্রম দিয়ে তিনি মানুষের মাঝে জায়গা করে নিয়েছেন। বহুদিন ধরেই ভাবছিলাম নায়করাজ রাজ্জাককে নিয়ে চ্যানেল আইয়ের জন্য একটি জীবন-ভিত্তিক প্রামাণ্যচিত্র (Biographical Documentary film) বানাব। এ বিষয়ে বন্ধু ফরিদুর রেজা সাগরও আমাকে বার বার তাগিদ দিচ্ছিল কাজটি যেন শিগগিরই শুরু করি। কারণ, নায়ক রাজের শরীরটা অনেকদিনই ভালো যাচ্ছিল না। আমাদের পরবর্তী প্রজন্মের অবশ্যই জানা জরুরি এমন একজন সফল চলচ্চিত্র নায়কের নিষ্ঠা ও জীবন সংগ্রামের গল্প। আমাদের চলচ্চিত্রের ইতিহাস যাদের হাত দিয়ে পূর্ণতা পেয়েছে তার মধ্যে অন্যতম একজনই তো নায়করাজ রাজ্জাক। তার ওপর কাজ করতে হলে সময় যেমন দরকার, একইভাবে প্রয়োজন তার সান্নিধ্য। অনেক দিন যোগাযোগ করে করে ঠিক এক মাস আগে গত জুলাইয়ের ২২ তারিখ তিনি সময় দিয়েছিলেন তার গুলশানের বাড়ি ‘লক্ষ্মীকুঞ্জ’-এ। সত্যি সারাজীবন ভোলার নয় এই সাক্ষাৎকারের স্মৃতি। প্রায় আড়াই ঘণ্টাব্যাপী তার সঙ্গে কথা বলেছি। গরমের মধ্যে তার কক্ষের এসি বন্ধ করে দিয়ে রেকর্ড করেছি। কিছুক্ষণ পর পর বিরতি দিয়ে চা খেতে খেতে খোলামেলা কথা বলেছি। কখনো তিনি আবেগপ্রবণ হয়ে পড়েছেন, কখনো হয়ে উঠেছেন উচ্ছ্বসিত। বিস্মিত হয়েছি, তার জীবনের গল্প শুনে। একটি রক্ষণশীল ধার্মিক পরিবারে জন্ম তার। সংস্কৃতির নানামুখী চর্চা ছিল ঠিক, কিন্তু ওই পরিবার থেকে চলচ্চিত্রের এক মহানায়ক বেরিয়ে আসবে এমন ভাবনাটা কারও মাথাতেই ছিল না। কতটা নিষ্ঠা আর পরিশ্রম থাকলে ষাটের দশকের মাঝামাঝিতে একেবারে শূন্য হাতে পূর্ব বাংলায় এসে শুধু চলচ্চিত্রে অভিনয় করেই কত সমৃদ্ধ করে তুলেছেন জীবনের প্রতিটি দিক। শুনেছি কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে সে সময়ের চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট মানুষের দ্বারে দ্বারে ঘোরার কথা, শুনেছি গভীর রাত শুটিং করে সেটের ইট কাঠ ও আবর্জনার ভিতর রাতের পর ঘুমানোর গল্প। সেই মানুষ জয় করেছেন একে একে এদেশের প্রতিটি মানুষের হৃদয়। ষাট, সত্তর, আশির দশকের একটি কিশোর তরুণও হয়তো পাওয়া যাবে না যে নায়ক রাজ্জাকের অভিনয়ে অনুরক্ত হননি। এমন মানুষ পাওয়া যাবে না, রাজ্জাক যাদের বহুভাবে অনুপ্রাণিত করেনি। এই তো সেদিনের কথা। আমাদের খিলগাঁও মসজিদের তরুণ খতিব মাওলানা মুফতি ফায়জুল্লাহ পত্রিকায় একটি সাক্ষাৎকার পড়েছেন নায়করাজ রাজ্জাকের। সেখানে তিনি তার জীবনের নানা কথা বলেছেন। বর্ণাঢ্য জীবনের শেষে এসে তার অনুভূতির কথা বলেছেন। মহান আল্লাহর প্রতি তার বিশ্বাসের কথা বলেছেন। ওই সাক্ষাৎকার পড়ে ফায়জুল্লাহ আমাকে তার একটি ইচ্ছের কথা জানান। তা হলো— তিনি নিজে নায়করাজ রাজ্জাককে তওবা করাতে চান। আল্লাহর কাছে প্রার্থনা করাতে চান। আমি ফোনে রাজ্জাক ভাইকে সে কথা জানাই। তিনিও বিষয়টিতে বেশ উৎসাহিত হন এবং একদিন সময় দেবেন বলে জানান। কিন্তু সেই সময়টি আর হয়ে উঠল না। আমার আরেকটি আফসোস সারাজীবন থেকে যাবে। নায়করাজ রাজ্জাক প্রতি ঈদে কৃষককে নিয়ে আমার অনুষ্ঠান ‘কৃষকের ঈদ আনন্দ’ দেখেন। তিনি অনুষ্ঠানটির এক রকমের ভক্ত বলা যায়। আমাকে একদিন বলেন, তিনি আমার ওই অনুষ্ঠানের একটি শুটিংয়ে যেতে চান। আমি বলেছি, রাজ্জাক ভাই আপনি গেলে মানুষের ভিড় সরানো যাবে না। ওই ভিড় ঠেলে অনুষ্ঠান করাই কঠিন হয়ে পড়বে। আমি জানি, নায়করাজ রাজ্জাককে গ্রাম বাংলায় যেকোনো অনুষ্ঠানে হাজির করা হলে লোকে লোকারণ্য হবে। বহু মানুষের শখ ও ইচ্ছে মিটবে। হয়তো একদিন ঠিকই নিয়ে যেতাম। কিন্তু সেটিও আর সম্ভব হলো না। নায়করাজ রাজ্জাককে নিয়ে অতি উঁচুমানের একটি প্রামাণ্যচিত্র নির্মাণের স্বপ্ন ছিল আমার। এজন্য আমি তার অভিনীত চলচ্চিত্র সংশ্লিষ্ট গীতিকার, সুরকার, জীবিত পরিচালক থেকে শুরু করে অনেকের সাক্ষাৎকারও গ্রহণ করেছি। কাজ অনেক দূর এগিয়েছিলাম। আরও একাধিকবার তার সঙ্গে বসার কথা ছিল। ভাবছি, এত বর্ণাঢ্য জীবনে আরও অনেক কথা ছিল। তার মৃত্যুর পর থেকে টেলিভিশনের টক শো থেকে শুরু করে সবখানে তার ভক্ত, সহকর্মীসহ বিভিন্ন পর্যায়ের মানুষের শোকগাথা শুনছি। সবাই বলছেন, তার মতো মানুষ আর হবে না। তার মতো নায়ককে আর পাওয়া যাবে না। কিন্তু আমার মনে হয়, এমন শক্তিমান নীতিনিষ্ঠ, দক্ষ একজন চলচ্চিত্র নায়ক ও গুণী ব্যক্তিত্বের জীবন ও দর্শনকে টিকিয়ে রাখার জন্য বহুমুখী কাজ হওয়া দরকার। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ফিল্ম অ্যান্ড মিডিয়া ইনস্টিটিউট থেকে শুরু করে সংস্কৃতি গবেষণা ও সংরক্ষণের প্রতিটি ক্ষেত্রে তার জীবনের প্রতিটি দিক নিয়ে কাজ করার উপযোগিতা রয়েছে। আমরা যদি সুস্থ সংস্কৃতি ও চলচ্চিত্রের কথা বলি তাহলে আরও বহুকাল নায়করাজ রাজ্জাকই হবেন তার অনুপ্রেরণা। তার মতো মানুষের জীবন ও কর্মের সুদূরপ্রসারী যে শক্তি, সে শক্তি ছড়িয়ে দিতে হবে আগামী তারুণ্যের মাঝে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর