বুধবার, ৩০ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৩

সালেহার খুনি ছিল বাঁহাতি

মির্জা মেহেদী তমাল

সালেহার খুনি ছিল বাঁহাতি

পোস্টমর্টেম রিপোর্টটা খুব ভালো করে দেখে নিচ্ছেন গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবদুস সালাম। রিপোর্টের একটি জায়গায় গিয়ে চোখ আটকে গেল। ভালো করে পড়ে দেখতে টেবিলে রাখা চশমাটা হাতে তুলে নিলেন। রুমাল দিয়ে চশমাটা মুছে চোখে পরে নিলেন। রিপোর্টটা কাছে নিয়ে ভালো করে পড়লেন। চোখেমুখে কৌতূহলের ছাপ। রিপোর্ট পড়েই চোখ বুজে কী যেন ভাবলেন। চোখ খুললেন। আবারও চশমা মুছতে শুরু করলেন। বিশেষ বিশেষ সময়ে এমন হয় তার। বার বার চশমা মোছার রোগ আছে এই গোয়েন্দা কর্মকর্তার। তার সামনে বসা আছেন এক ব্যক্তি। যেন ভুলেই গেছেন তাকে। গোয়েন্দার হাবভাব দেখে লোকটি হতবাক। ভাবছেন, ঘটনা কী? কিছু কি বুঝতে পারলেন? না, বুঝতে পারেননি বোধহয়। কীভাবে বুঝবেন। সব ঠিকঠাক আছে না!

‘প্লিজ! কুড ইউ টেল মি, হোয়াট রং উইথ মি? অ্যাকচুয়ালি হোয়াট হ্যাপেন্ড? আই অ্যাম টায়ার্ড।’ বেশ দৃঢ়তার সঙ্গে হঠাৎ কথাগুলো বললেন সেই লোকটি। গোয়েন্দা কর্মকর্তাটি তার কথা শুনে কোনো জবাব দিলেন না। শুধু লোকটির দিকে তাকিয়ে রইলেন। গোয়েন্দা কর্মকর্তার এমন তাকিয়ে থাকার দৃশ্য দেখে লোকটি একটু ঘাবড়ে গেলেন। এবার তার মুখ থেকে কথা বেরোচ্ছে না। কিছু একটা বলতে গিয়েও মুখের ভিতরেই যেন কথা আটকে গেল। ‘না ইয়ে মানে অনেকক্ষণ ধরে বসা তো, তাই আর কি বলছিলাম’— এবার লোকটির সুর খুব নরম। গোয়েন্দা কর্মকর্তার হঠাৎ চিৎকার, ‘রাখেন মশায়, ইয়ে ইয়ে কী বলছেন? কী বলতে চান?’ আঁতকে উঠলেন লোকটি। গোয়েন্দা সালাম একটু হেসে বললেন, ‘কী ব্যাপার! আপনি ভয়টয় পেলেন কেন?’ লোকটি কোনো জবাব দেন না। গোয়েন্দা কর্মকর্তা বলে গেলেন, ‘আচ্ছা ঠিক আছে, আপনাকে আটকে রেখেছি। জিজ্ঞাসা করছি না কিছু, এটা ঠিক হচ্ছে না। আপনি আপনার নাম-ঠিকানা কাগজে লিখে দেন। তারপর দেখি কী করা যায়।’ লোকটি যেন হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন। হয়তো তাকে ছেড়ে দেবে। ‘গোয়েন্দা কর্মকর্তাটি আসলেই ভালো। কেন যে মানুষ পুলিশ সম্পর্কে খারাপ কথা বলে, বুঝি না।’ এমন সব কথা ভাবছেন লোকটি। কলম বের করে একটি সাদা কাগজ লোকটির সামনে ঠেলে দিলেন সালাম। কলমটি হাতে তুলে নিলেন। সাদা কাগজে শুধু নাম লিখেছেন লোকটি। ঠিকানা লিখতে যাবেন, ঠিক সেই সময়ে গোয়েন্দা সালাম তার হাত থেকে কলম টেনে নিলেন। বললেন, ‘থাক, আর লিখতে হবে না।’ অবাক হয়ে তাকালেন লোকটি। ফেকাসে দেখাচ্ছে তাকে। সালাম বললেন, ‘পানি খাবেন?’ আসলে খুবই তেষ্টা পেয়েছিল তার। ‘খাব’ বলতেই তার সামনে একটা পানির বোতল ও গ্লাস দেওয়া হলো। পরপর দুই গ্লাস পানি ডগডগ করে গলায় ঢেলে দিলেন। পানি পানের পর একটু ভালো লাগছিল লোকটির। গোয়েন্দা কর্মকর্তা এবার নিজের চেয়ার ছেড়ে দাঁড়ালেন। আস্তে আস্তে হেঁটে লোকটির পেছনে গেলেন। বলতে শুরু করলেন, ‘মি. ডা. ইকবাল, আমি আসলে ভাবছিলাম আপনার স্ত্রী সালেহার খুনের ঘটনা নিয়ে। পোস্টমর্টেম রিপোর্টের ভিত্তিতে বলা যায়, তাকে হত্যা করা হয়েছে। ভারী কোনো বস্তু দিয়ে তার মাথায় আঘাত করা হয়। যাতে মাথার ভিতরে রক্ত জমাট শুধু নয়, সেখানকার মগজ পর্যন্ত গলে গেছে। আর তার গলায় ব্লেড দিয়ে ৭ ইঞ্চি কাটা হয়। গভীরতা ছিল ৪ ইঞ্চি। সেটিও আমার কাছে এখন গুরুত্বপূর্ণ নয়। গুরুত্বপূর্ণ হলো, ব্লেড দিয়ে যিনি কেটেছেন, বাঁ হাতে কেটেছেন। সেটি কাটার ধরন দেখে নিশ্চিত হওয়া গেছে। আরও গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো আপনি নিজেই বাঁ হাতি। নয় কি? ভুল বলেছি?’ কথাগুলো একনাগারে বলেই প্রশ্ন ছুড়ে দেন ইকবালের কাছে। ডা. ইকবাল ঘাবড়ে যান। এর পরও বাঁচার শেষ চেষ্টা হিসেবে বলেন, ‘বাঁ হাতি আরও অনেকেই হতে পারেন।’ গোয়েন্দা কর্মকর্তা আবারও তার দিকে তীক্ষ দৃষ্টি দেন। চশমা নিয়ে মুছতে থাকেন। ডা. ইকবাল এবার নিজেকে ঠিক রাখতে পারেন না। গোয়েন্দা কর্মকর্তার হাত চেপে ধরেন। বলেন, ‘স্যার! আমি ভুল করেছি।’ এভাবেই তরুণী গৃহবধূর হত্যা রহস্য বেরিয়ে আসে। ধরা পড়েন খুনি ডা. ইকবাল।

১৯৭৮ সালে দেশ কাঁপানো চাঞ্চল্যকর তরুণী গৃহবধূ সালেহা খুনের ঘটনা এটি। রাজধানীর মালিবাগে সালেহাকে নৃশংসভাবে খুন করেন তার চিকিৎসক স্বামী এহতেশামুদ্দিন ইকবাল। খুনের দায় থেকে ডা. ইকবাল নিজেকে রক্ষার চেষ্টা করেছেন বার বার। ময়নাতদন্ত রিপোর্ট পরিবর্তন পর্যন্ত করিয়ে ফেলেছিলেন। জুরাইন কবরস্থান থেকে লাশ তুলে দ্বিতীয় দফার ময়নাতদন্তের রিপোর্টে হত্যাকাণ্ডের তথ্য পাওয়া যায়। পুলিশের জিজ্ঞাসাবাদেও নানা ছলচাতুরীর আশ্রয় নিয়েছিলেন ইকবাল। কিন্তু গোয়েন্দা পুলিশের তৎকালীন ইন্সপেক্টর আবদুস সালামের কাছে তার ছলচাতুরী ধোপে টেকেনি। স্বীকার করেছিলেন হত্যাকাণ্ডের কথা। পরনারী আসক্তির কারণে কীভাবে তার স্ত্রী সালেহাকে খুন করেছিলেন, প্রকাশ করেছিলেন সব।

সালেহা খুনের পর সারা দেশের মানুষ প্রতিবাদ করেছে। ফাঁসির দাবি নিয়ে রাস্তায় নেমেছে। পত্রপত্রিকাগুলোয় এ নিয়ে ধারাবাহিক প্রতিবেদন প্রকাশ হয়। আদালতে বলা হয়, গৃহপরিচারিকার সঙ্গে অবৈধ সম্পর্কের পরিণতিতে ডা. ইকবাল খুন করেন তার স্ত্রীকে। আদালতে আরও অভিযোগ করা হয়, যৌতুক আদায়ের জন্য ডা. ইকবাল নির্যাতন করতেন সালেহাকে। বিচারে ডা. ইকবালের মৃত্যুদণ্ড হয়। ১৯৮৭ সালে সেই দণ্ড কার্যকর হয়। এই মৃত্যুদণ্ড তখন খুব আলোচিত হয়েছিল। কারণ স্বাধীন বাংলাদেশে মধ্যবিত্ত সমাজের কোনো ব্যক্তির ফাঁসি হওয়ার ঘটনা ছিল ওটাই প্রথম। যৌতুকের নির্মমতার ইতিহাসে সালেহা ও তার স্বামী ডা. ইকবালের নাম মনে পড়লে আজও মানুষের অনুভূতি ভারাক্রান্ত হয়ে ওঠে। সালেহার মৃত্যুর পর সামাজিক সোচ্চারের কারণে ১৯৮০ সালে যৌতুকবিরোধী আইন প্রণীত হয়। সেই সময়ে সালেহা হত্যাকাণ্ড ও বিচার প্রক্রিয়া খুব কাছ থেকে দেখেছেন এবং এসব নিয়ে পত্রিকায় ধারাবাহিক প্রতিবেদন লিখেছেন, এমন সাংবাদিকদের মধ্যে বশির আহমেদ অন্যতম। তিনি বলেন, ‘ওই সময় সালেহা হত্যাকাণ্ডটি ছিল টক অব দ্য কান্ট্রি। অত্যন্ত চাঞ্চল্যকর ঘটনা। পত্রিকায় অনুসন্ধানীমূলক প্রতিবেদন না হলে হয়তো সালেহা খুনের ঘটনাটি প্রকাশ পেত না। অপমৃত্যু হিসেবেই থাকত। পত্রিকায় প্রতিবেদন হওয়ার কারণেই দ্বিতীয় দফা ময়নাতদন্ত হয়; যাতে খুনের ঘটনাটি প্রকাশ পায়।’ তিনি আরও বলেন, ‘ইকবালের পরিবার তাদের ওপর এমন ক্ষুব্ধ হয়েছিল যে, ফাঁসির রায় কার্যকরের পর ইকবালের বাসায় গেলে সাংবাদিকদের দা নিয়ে ধাওয়া করেছিলেন ইকবালের স্বজনরা।’ বিভিন্ন সূত্রে জানা যায়, ধনী ব্যবসায়ী পরিবারের সাত ভাইয়ের এক বোন ছিলেন সালেহা। তার ডাক নাম ছিল খুকি। সালেহার ধনাঢ্য বাবা মোমতাজুল করিম মেয়ের শিক্ষা অর্জনের বিষয়টিকে খুব একটা পাত্তা দেননি। তিনি বিত্তবান ছিলেন। ভেবেছিলেন বিত্তের জোরেই মেয়েকে ভালো একটা পাত্রের হাতে তুলে দেবেন। আর সে লক্ষ্যেই মেয়েকে সুখী করার সঠিক উপায় হিসেবে শিক্ষিত জামাই খুঁজতে শুরু করলেন। পেয়েও গেলেন। মেয়ের সুখের গ্যারান্টির জন্য সালেহার বাবা নিজের টাকায় ইকবালকে ডাক্তারি পাস করান। বিয়ের সময় প্রচুর উপহারের সঙ্গে ইকবালকে হলুদ রঙের একটি ডাটসান ১৩০ প্রাইভেট কার দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু তার পরের ঘটনা বড়ই মর্মান্তিক। ডা. ইকবালের দৃষ্টি ছিল পরনারীতে। অনৈতিক কাজের বিরোধিতা করেছিলেন সালেহা। প্রতিবাদ করেছিলেন স্বামীর দুশ্চরিত্রের বিরুদ্ধে।

সে সময় এই খুনের তদন্তে জড়িত ছিলেন যে কজন পুলিশ কর্মকর্তা, এদের কেউ আর চাকরিতে নেই। অবসরপ্রাপ্ত কজন পুলিশ কর্মকর্তার সঙ্গে কথা বলে সেই ঘটনার আদ্যোপান্ত জানা গেছে।

১৯৭৮ সালের ১৮ এপ্রিল। দুপুরের পর কাজের মেয়ে মনোয়ারার সঙ্গে এক লজ্জাকর পরিস্থিতিতে ধরা পড়ে যান সালেহার কাছে। প্রতিবাদ করতেই ডা. ইকবাল সালেহার চুল ধরে আছড়াতে থাকেন। এ সময় সামনে দাঁড়িয়ে ছিলেন কাজের মেয়ে মনোয়ারাও। একপর্যায়ে দরজার ডাঁসা দিয়ে সালেহার মাথায় আঘাত করেন। ঘটনাস্থলেই মারা যান সালেহা। এরপর ধারালো ব্লেড দিয়ে তার গলা কাটতে শুরু করেন। সে সময় গ্রেফতার হওয়া কাজের মেয়ে মনোয়ারার ভাষ্যমতে, সে নিজেও দেখেছে গলা কাটতে। বাধাও দিয়েছে। কিন্তু ইকবাল তাকেই উল্টো কয়েকটা চড় দিয়েছেন। সালেহার গলা কেটে তারা সবাই বারান্দায় গিয়ে চিৎকার করতে থাকেন। বলতে থাকেন, সালেহা আত্মহত্যা করেছেন। কে কোথায় আছো আসো। এসব নাটক ইকবাল সাজিয়ে দিয়েছিলেন বাসার সবাইকে। জবাই করে ইকবাল প্রচার চালান সালেহা আত্মহত্যা করেছেন। লাশ ময়নাতদন্তের জন্য ঢাকা মেডিকেল কলেজ মর্গে পাঠানো হয়। সেখানে ময়নাতদন্ত সম্পন্ন হয়। পরদিন ভোর ৬টায় লাশ মর্গ থেকে ইকবালের কাছেই হস্তান্তর করা হয়। রিপোর্টে আত্মহত্যাজনিত মৃত্যু বলে চিকিৎসকরা রিপোর্ট দেন। রিপোর্টটি ছিল ভুয়া, যা পরে প্রমাণিত হয়। ডা. ইকবাল ছিলেন ঢাকা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক। ময়নাতদন্তকারী ডাক্তার তার বন্ধু। আগে থেকে সবকিছু তারা ঠিক করে রেখেছিলেন। তাই সালেহার ময়নাতদন্ত করা ছিল শুধু আনুষ্ঠানিকতা। ডাক্তাররা বললেন, সালেহা আত্মহত্যাই করেছেন। এটি কোনো হত্যাকাণ্ড নয়। লাশের দাফন হয়। কিন্তু সাংবাদিকদের কাছে ঘটনাটি অত্যন্ত সন্দেহজনক মনে হতে থাকে। সন্দেহ হয় বিদেশে অবস্থানরত সালেহার এক ভাইয়ের। পত্রিকায় অনুসন্ধানী প্রতিবেদন প্রকাশ হতে থাকে। সালেহার পরিবার আবারও ময়নাতদন্তের অনুরোধ জানায়। দ্বিতীয় দফায় ময়নাতদন্ত হয়। এর আগে কবর থেকে লাশ উত্তোলন করে এবার সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে ময়নাতদন্ত হয়। তিন সদস্যের একটি বোর্ড ময়নাতদন্ত সম্পন্ন করে। এবার বেরিয়ে আসে আসল রহস্য। প্রতিবেদনে বলা হয়, এটি হত্যা। মাথায় আঘাত করেই সালেহাকে হত্যার পর গলায় পোচ দেওয়া হয়েছে। নিহতের গলা ও শরীরে যেসব স্থানে ধারালো ব্লেডের আঘাত রয়েছে তা নিজের হাতে করা সম্ভব নয়। শরীরে সূক্ষ্মভাবে যে পোচ দেওয়া হয়েছে তাতে কিছুটা বাঁকাভাবে ক্ষতের সৃষ্টি হয়। খুনি যেই হোক বাঁ হাত ব্যবহার করেছে। এই প্রতিবেদনের পর পুলিশি তদন্তে নতুন মোড় নেয়। পুলিশ বাঁ হাতের বিষয়টি মাথায় রেখে তদন্ত করে। আবিষ্কার করে খুনি তাদের সামনেই রয়েছে। কারণ হতভাগী ওই মহিলার স্বামী একজন বাঁ হাতি।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর