বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

নাফ নদের ওপারে আগুন এপারে শরণার্থীর ঢল

মিয়ানমারকে চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান

ফারুক তাহের, টেকনাফ সীমান্ত থেকে

বাংলাদেশে রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে।  গতকালও ১০ থেকে ১৫ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। তারা উখিয়ার কুতুপালং, টেকনাফের ল্যাদা ও নয়াবাজার মুছনী শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নিয়েছে। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যের অন্তত ১৫ থেকে ২০টি রোহিঙ্গা পাড়ায় সেখানকার বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও সেনাবাহিনী নতুন করে আগুন দিয়েছে। নাফ নদের টেকনাফ সীমান্তের এপার থেকে ওপারের বিভীষিকাময় আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী প্রত্যক্ষ্য করা গেছে। হেলিকপ্টার থেকে ছোট ছোট ককটেল বোমা ফেলে রোহিঙ্গা পাড়াগুলোয় আগুন দেওয়া হয় বলে আশ্রয় নেওয়া নতুন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা জানিয়েছেন। নাফ নদের  ওপারে জ্বলছে সহিংসতার আগুন আর এপারে দিশাহারা শরণার্থীর ঢল। মিয়ানমারের ম্লু শহরের নোয়াপাড়া পাঁচ নম্বর ওয়ার্ডের সাবেক ইউপি সদস্য মো. আবদুল হাকিমসহ কয়েকজন রোহিঙ্গা জানান, গতকাল সকাল থেকে নতুন করে আগুনে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে জাম্বুন্যাপাড়া, বালুখালী, ফুপখালী, কাউয়ার বিল, ফখালী, মগনামারসহ বেশ কয়েকটি রোহিঙ্গাপাড়া। এ সময় অনেকে আগুনে পুড়ে মারা যায় এবং বিজিপির নির্মম সহিংসতার শিকার হন বলে জানা গেছে। এর আগে গত সোম ও মঙ্গলবার টেকনাফ সীমান্তের রাখাইন রাজ্যের ভুছিঢং ও রাছিঢং এলাকার শীলখালী, আলতাং, কুল্লুং, খোয়াইংডং, মেরল্যা, ছমুন্যাপাড়া, রাজারবিল, পাদংছা, গদুছড়াসহ রোহিঙ্গা অধ্যুষিত পাড়াগুলো জ্বালিয়ে দেওয়া হয় বলে জানান মিয়ানমারের সাবেক এই ইউপি সদস্য। টেকনাফের ল্যাদা ও মুছনী অস্থায়ী শরণার্থী ক্যাম্পে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের কেউ কেউ তাদের পূর্বপরিচিত পুরনো শরণার্থীদের শিবিরে আশ্রয় নিলেও এখনো অনেককে খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করতে দেখা গেছে। এ দুটি ক্যাম্পে নিবন্ধনভুক্ত শরণার্থী রয়েছে যথাক্রমে ৫০ হাজার ও ১৮ হাজার। গতকাল কুতুপালং শরণার্থী ক্যাম্পে ১০ হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থীর অনুপ্রবেশ ঘটেছে বলে স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে। ঘুমধুমের জলপাইতলী ও তমব্রু সীমান্তে বিজিবির কর্ডনে থাকা প্রায় তিন হাজার রোহিঙ্গা শরণার্থী এখন সীমান্তের জিরো পয়েন্টেই রয়ে গেছে। রোদে পুড়ে বৃষ্টিতে ভিজে তারা নিদারুণ মানবেতর জীবন কাটাচ্ছেন।   রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ প্রসঙ্গে পালংখালী ইউপির ভারপ্রাপ্ত চেয়ারম্যান নুরুল আবছার চৌধুরী জানান, দালালদের কারণেই রোহিঙ্গাদের অনুপ্রবেশ হচ্ছে। তাদের হাতে নানাভাবে রোহিঙ্গারা হয়রানির শিকারও হচ্ছেন বলে জানান তিনি।

ছয় হাজার রোহিঙ্গার ঝুঁকিপূর্ণ বাস : রোহিঙ্গা শরণার্থীর অনেকে টেকনাফ-উখিয়ার বিভিন্ন পাহাড়ে ঝুঁকিপূর্ণ বসতি গড়ে তুলেছে। উখিয়ার বালুখালী পাহাড় এবং টেকনাফের ল্যাদা ও মুছনী পাহাড়ে প্রতিমুহূর্ত মৃত্যুঝুঁকি নিয়ে তারা দিন কাটাচ্ছে। কেবল বালুখালীর পাঁচটি পাহাড়েই ঝুঁকিপূর্ণভাবে বসবাস করছে ৬ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গা। এ যেন মৃত্যুর এক ঝুঁকি থেকে মুক্তি পেয়ে আরেক ঝুঁকিতে স্বেচ্ছায় পা রাখা। চলতি বর্ষা মৌসুমে পৃথক তিনটি পাহাড়ধসের ঘটনায় এখানে এক মহিলাসহ চারজনের প্রাণহানি ঘটে। স্থানীয় সূত্রে জানা গেছে, চলতি বর্ষা মৌসুমে এসব ঝুঁকিপূর্ণ পাহাড় থেকে সরে যাওয়ার জন্য প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করা হলেও কেউ সাড়া দেয়নি। পালংখালী ইউপি চেয়ারম্যান মোজাফ্ফর আহমদ জানান, বর্ষার শুরুতেই তাদের (পাহাড়ে বসবাসরত রোহিঙ্গা) সতর্ক করা হয়েছিল।  কিন্তু তারা কেউ সরেনি। এ প্রসঙ্গে রোহিঙ্গা শরণার্থী নুরুল ইসলাম বলেন, আমরা কোনোমতে পাহাড়ে আশ্রয় নিয়েছি। এখান থেকে অন্য কোথাও সরে যাওয়ার জায়গাও নেই, সামর্থ্যও নেই। তাই ঝুঁকি নিয়েই থাকতে হয়।

মিয়ানমারকে চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রধানমন্ত্রীর আহ্বান : রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ বন্ধে মিয়ানমারকে চাপ দিতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রতি আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। যুক্তরাষ্ট্রের দক্ষিণ ও মধ্য এশিয়াবিষয়ক ভারপ্রাপ্ত সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী এলিস ওয়েলস গতকাল সকালে তেজগাঁওয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ে দেখা করতে এলে এ আহ্বান জানান তিনি। বৈঠক শেষে প্রধানমন্ত্রীর প্রেস সচিব ইহসানুল করিম সাক্ষাতের বিভিন্ন বিষয়ে সাংবাদিকদের জানান। প্রধানমন্ত্রীর বক্তব্য উদ্ধৃত করে ইহসানুল করিম বলেন, ‘মানবিক বিবেচনায় আমরা বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা উদ্বাস্তুকে বাংলাদেশে আশ্রয় দিয়েছি এবং এটি আমাদের জন্য একটি বিরাট সমস্যা। এ জন্য মিয়ানমারের প্রতি প্রবল চাপ বাড়ানোর জন্য আপনাদের (যুক্তরাষ্ট্র) প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি।’

ইহসানুল করিম বলেন, এ সংকট নিয়ে মিয়ানমারের সঙ্গে আলোচনা হচ্ছে কিনা, সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী তা জানতে চাইলে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে মিয়ানমার কর্তৃপক্ষের সঙ্গে যোগাযোগ রাখছে’।

প্রেস সচিব বলেন, বৈঠকে সন্ত্রাসবাদের বিষয়ে বাংলাদেশের ‘জিরো টলারেন্স’ নীতির কথা উল্লেখ করে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেছেন, বাংলাদেশের মাটি ব্যবহার করে কোনো দেশেই সন্ত্রাসবাদী কর্মকাণ্ড চালাতে দেওয়া হবে না। অর্থনৈতিক উন্নয়ন ও সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় বাংলাদেশের প্রশংসা করে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, তারা চান সন্ত্রাসবাদ মোকাবিলায় একসঙ্গে কাজ করতে। যুক্তরাষ্ট্রে পালিয়ে থাকা বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ফেরত দিতে সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রীর মাধ্যমে আহ্বান জানিয়েছেন প্রধানমন্ত্রী।

আলোচনায় দেশের গণমাধ্যমের প্রসঙ্গও এসেছে বলে জানান ইহসানুল করিম। এ প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেছেন, বাংলাদেশে গণমাধ্যম সম্পূর্ণ স্বাধীনতা ভোগ করছে। আগে একটা টেলিভিশন চ্যানেল থাকলেও এখন দেশে ৪৪টি টেলিভিশন চ্যানেল অনুমোদনে এবং ২৪টি চ্যানেল সম্প্রচারে রয়েছে। পত্রিকা প্রকাশ হচ্ছে প্রায় ৭৫০টি। প্রধানমন্ত্রী বলেন, মিডিয়া সরকারের সমালোচনাও করছে। এখানে কোনো হস্তক্ষেপ নেই।

বিভিন্ন খাতে বাংলাদেশের চমৎকার উন্নয়নের কথা উল্লেখ করে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকারের মূল লক্ষ্য হচ্ছে গ্রামীণ অর্থনীতিকে শক্তিশালী করা। বেসরকারি খাতের উন্নয়ন প্রসঙ্গে প্রধানমন্ত্রী বলেন, তার সরকার সব খাত বেসরকারি খাতে উন্মুক্ত করে দিয়েছে। নারীর ক্ষমতায়নে সরকারের বিভিন্ন পদক্ষেপের বর্ণনা দিয়ে শেখ হাসিনা বলেন, তার সরকার রাষ্ট্রের সব পর্যায়ে নারীর অংশগ্রহণ নিশ্চিত করেছে। তিনি বলেন, প্রশাসন, বিচার বিভাগ, শিক্ষা, সশস্ত্র বাহিনী এবং আইন প্রয়োগকারী সংস্থার মতো সব ক্ষেত্রে দেশের নারী সমাজ উচ্চ পদে রয়েছে।

বাংলাদেশ ও যুক্তরাষ্ট্রের মধ্যে দ্বিপক্ষীয় বাণিজ্য প্রসঙ্গে শেখ হাসিনা বলেন, ১৯৯৬ সালের মাত্র ২৫ মিলিয়ন মার্কিন ডলার থেকে দুই দেশের বাণিজ্য এখন বহু গুণ বৃদ্ধি পেয়েছে। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, দুই দেশের মধ্যে অর্থনৈতিক সম্পর্ক তাৎপর্যপূর্ণ বৃদ্ধি পেয়েছে। তিনি বলেন, যুক্তরাষ্ট্র হচ্ছে বাংলাদেশের আরএমজি পণ্যের বৃহত্তম বাজার। মার্কিন সহকারী পররাষ্ট্রমন্ত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার নেতৃত্বে বাংলাদেশের আর্থ-সামাজিক উন্নয়ন বিশেষ করে ৭ দশমিক ২৪ ভাগ জিডিপি প্রবৃদ্ধি অর্জনের উচ্ছ্বসিত প্রশংসা করেন।

এ সময় প্রধানমন্ত্রীর আন্তর্জাতিক বিষয়ক উপদেষ্টা ড. গওহর রিজভী, মুখ্য সচিব ড. কামাল আবদুল নাসের চৌধুরী এবং ঢাকাস্থ মার্কিন চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্স উপস্থিত ছিলেন।

কেউ না খেয়ে থাকবে না : এদিকে সকালে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা তার কার্যালয়ে পৃথক এক অনুষ্ঠানে বলেছেন, তার সরকার খাদ্য নিরাপত্তা নিশ্চিতকরণে ইতিমধ্যে বিদেশ থেকে খাদ্যশস্য আমদানি শুরু করেছে, যাতে দেশে খাদ্য সংকট দেখা না দেয়। ত্রাণ ও কল্যাণ তহবিলে বিভিন্ন সরকারি ও বেসরকারি সংস্থার অনুদানের চেক গ্রহণের পর তিনি বলেন, আমাদের সরকারের লক্ষ্য হচ্ছে কেউই ক্ষুধার্ত ও গৃহহীন থাকবে না এবং সবাই স্বাস্থ্যসেবা ও শিক্ষা পাবে। শেখ হাসিনা বলেন, বন্যার সময় যারা নদী ভাঙনে গৃহহীন হয়েছে, তাদের জন্য বাড়ি নির্মাণে ইতিমধ্যে নির্দেশ দেওয়া হয়েছে। পাশাপাশি তাদের ক্ষতিগ্রস্ত ঘরবাড়ি পুনর্নির্মাণেও সহায়তা দেওয়া হচ্ছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, আওয়ামী লীগ যখনই ক্ষমতায় এসেছে, তখনই গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া ও গণতান্ত্রিক প্রতিষ্ঠানগুলোকে শক্তিশালীকরণে কাজ করেছে। পাশাপাশি জনগণের মৌলিক চাহিদা পূরণের মাধ্যমে দেশকে অর্থনৈতিক সমৃদ্ধি ও উন্নয়নের দিকে এগিয়ে নিয়ে গেছে।

প্রধানমন্ত্রী বলেন, বন্যাদুর্গত মানুষকে সহায়তা প্রদান ও পুনর্বাসনে প্রয়োজনীয় সব পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে, যাতে তারা আবার নিজের পায়ে দাঁড়াতে পারে। তিনি বলেন, ভৌগোলিকভাবে বাংলাদেশ এমন একটি দেশ যেখানে বার বার প্রাকৃতিক দুর্যোগ আঘাত হানে। বিশ্বের বিভিন্ন দেশও প্রাকৃতিক দুর্যোগ মোকাবিলা করে আসছে। আমরা ক্ষমতা গ্রহণের পর থেকেই আমাদের সরকার খুবই সতর্ক রয়েছে এবং জীবন ও সম্পদের ক্ষয়ক্ষতি সর্বনিম্ন পর্যায়ে রাখার জন্য আন্তরিকতার সঙ্গে কাজ করে যাচ্ছে।

সর্বশেষ খবর