শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ৪

চোখ পাল্টাতে পারেনি তাজুল

মির্জা মেহেদী তমাল

চোখ পাল্টাতে পারেনি তাজুল

রাজধানী ঢাকার কাকরাইল মসজিদ। সিআইডি পুলিশের কয়জন সদস্য মসজিদের সামনে দিয়ে যাচ্ছিলেন। এদের মধ্যে একজন হাবিলদার এক মুসল্লিকে দেখে দাঁড়িয়ে যান। লম্বা দাড়ি। চুল পেছনে ঘাড়ের নিচ পর্যন্ত নেমে গেছে। মাথায় সাদা গোল টুপি। তাবলিগ জামাতের একদল মুসল্লির মাঝে লোকটি দাঁড়ানো। এরা মসজিদ থেকে নেমে কোথাও যাওয়ার প্রস্তুতি নিচ্ছিলেন।

সিআইডির ওই হাবিলদার পকেট থেকে ভাঁজ করা পত্রিকার ছেঁড়া একটি কাগজ বের করলেন। একবার কাগজের দিকে, আরেকবার ওই লোকটির দিকে তাকাচ্ছেন। বার বার। তিনি বুঝতে পারছেন না, পত্রিকার ছবির মানুষটি তার সামনে দাঁড়ানো ব্যক্তিটি একই কিনা। ছবিতে দাড়ি-গোঁফ নেই। চুল ছোট। কিন্তু বাস্তবের সন্দেহভাজন লোকটির চেহারায় সবই আছে। হাবিলদার এবার ভালো করে লোকটিকে দেখতে থাকেন। ঠিক সে সময়ে ওই ব্যক্তির সঙ্গে তার চোখাচোখি হয়ে যায়। চোখাচোখি হতেই হাবিলদার শতভাগ নিশ্চিত। এই ব্যক্তির ছবি নিয়েই তিনি ঘুরে বেড়াচ্ছেন। সঙ্গে সঙ্গেই তার সঙ্গীদের নিয়ে জাপটে ধরে ফেলেন আলখেল্লা পরা  লোকটিকে। লোকটি চিৎকার করে মুসল্লিদের কাছে সাহায্য চাইতে থাকেন। মুসল্লিরাও এগিয়ে আসেন। পুলিশের দলটি তাদের পরিচয়পত্র দেখায়। লোকটির ছবি দেখিয়ে মুসল্লিদের বলেন, এই ব্যক্তি হচ্ছে বর্তমান সময়ের সবচেয়ে ভয়ঙ্কর খুনি। এর নাম তাজুল। যাকে কসাই তাজুল বলেই চেনে। এ কথা শুনে মুসল্লিরা পুলিশকে সাহায্য করেন। পুলিশের দল তাজুলকে মালিবাগ সিআইডি দফতরে নিয়ে যায়।

সিআইডিতে নিয়ে সেই হাবিলদার তাজুলকে বলে, দাড়ি-গোঁফে নিজেকে পাল্টিয়ে ফেলেছিস। কিন্তু তোর চোখ তো পাল্টাতে পারিসনি। তোর দৃষ্টি! চোখের ওপরে কাটা দাগ! ওটা তো আগের মতোই রয়েছে। উল্লেখ্য, এই হাবিলদার নিদারাবাদে একসময় চাকরি করেছিলেন। এক-আধবার দেখেছিলেন এই তাজুলকে। ১৯৮৯ সালের অক্টোবরে গ্রেফতারের আগে ভয়ঙ্কর এই খুনিকে নিয়ে দেশজুড়ে ছিল আতঙ্ক। সরকারের ভিতর-বাইরে তোলপাড়। কোনোভাবেই পুলিশ তার নাগাল পাচ্ছিল না। পুলিশের ঘুম রীতিমতো হারাম। সরকারের শীর্ষ পর্যায়ের বৈঠকগুলোতে এ নিয়ে বিস্তর আলোচনা চলেছে। খুনিকে যে কোনো উপায়েই হোক গ্রেফতার করতেই হবে। স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়, পুলিশ সদর দফতরে দফায় দফায় মিটিং। গ্রেফতারের বিষয়ে সরকারি সিদ্ধান্ত পুলিশ কর্মকর্তাদের সাফ জানিয়ে দেওয়া হলো। পত্রিকায় ছবি দিয়ে পুরস্কারও ঘোষণা করা হয়। পুলিশ, ডিবি, সিআইডিসহ আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনী সংশ্লিষ্ট সব সংস্থার সদস্য মাঠ চষে বেড়াচ্ছিলেন। কিন্তু খুনি কীভাবে গ্রেফতার হবে? চেহারা ছবি সম্পর্কে তো কারও কোনো ধারণাই নেই। পুলিশের শীর্ষ পর্যায়ে এ নিয়েও ভীষণ ক্ষোভ। যে খুনিকে নিয়ে গোটা পুলিশ বাহিনী ব্যতিব্যস্ত তার ছবি পর্যন্ত নেই! তাহলে কীভাবে পাকড়াও হবে খুনি? এমন প্রশ্ন পুলিশ ও গোয়েন্দাদের মাথায় ঘুরপাক খায়। অবশেষে ছবি জোগাড় করে পেপারে ছাপানো হয়। ১৯৮৯ সালের সেপ্টেম্বরের প্রথম সপ্তাহে ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার (বর্তমান বিজয়নগর উপজেলা) নিদারাবাদ গ্রামে নৃশংসভাবে খুন হন একই পরিবারের ছয় সদস্য। গ্রামের নিরীহ শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী বিরজাবালা ও পাঁচ অবুঝ সন্তানকে টুকরা টুকরা করে কেটে হত্যার পর ড্রামে ভরে বিলের পানিতে ডুবিয়ে রাখে। সামান্য কিছু জমির জন্য ইতিহাসের নৃশংসতম জঘন্য ঘটনাটি ঘটান ওই গ্রামের তাজুল ইসলাম। যাকে সবাই কসাই তাজুল বলেই চেনেন। লাশ উদ্ধারের পর ঘটনাটি যখন দিনের আলোয় উঠে আসে তখন সারা দেশ স্তম্ভিত। কিন্তু হত্যাকাণ্ডের ১১ দিন পর লাশ উদ্ধারের ঘটনা জানতে পেরেই লাপাত্তা তাজুল তার দলবল নিয়ে। সেই তাজুলকে গ্রেফতারেই সে সময় গোটা পুলিশ বাহিনী ছিল প্রচণ্ড চাপে। যে এলাকার ঘটনা সে নিদারাবাদ গ্রামের সরসপুর তখন স্তব্ধ। সেখানকার পুলিশ তার ছবি খোঁজ করছে। হঠাৎ স্থানীয় এক সাংবাদিক পুলিশকে জানান, তাজুল কৃষি ব্যাংকে অ্যাকাউন্ট খুলেছে। সেখানে ছবি থাকতে পারে। এ কথা শুনেই পুলিশ আর দেরি করেনি। সেখানে গিয়ে পেয়েও যায় সেই ছবি।

ফ্লাশব্যাক : নিদারাবাদ ট্র্যাজেডি : ১৯৮৭ সালের ১৬ অক্টোবরের কুয়াশাচ্ছন্ন ভোরে শশাঙ্ক দেবনাথকে বাড়ি থেকে ডেকে নিয়ে যান একই গ্রামের পূর্ব পরিচিত তাজুল ইসলাম। সন্তানসম্ভবা স্ত্রীকে গুড় নিয়ে ফিরে আসার কথা বলে বাড়ি থেকে বের হন মুড়ির মোয়া বিক্রেতা শশাঙ্ক দেবনাথ। এরপর দিন যায়, মাস যায়, বছর ঘুরে। ফেরেন না শশাঙ্ক। তাজুল ইসলামসহ কয়েকজনের বিরুদ্ধে অপহরণের মামলা করেন বিরজাবালা। মামলার রায় ঘোষণার দিন ঘনিয়ে আসতে থাকে। তাজুল আর তার সহযোগী বাদশাসহ সবার অপরাধই প্রমাণ হতে থাকে আদালতে। নিশ্চিত বিচারের মুখোমুখি হওয়ার আশঙ্কায় ক্ষুব্ধ হন তাজুল। শশাঙ্কের পরিবারের সবাইকে খুনের পরিকল্পনা আঁটেন। ১৯৮৯ সালের ৬  সেপ্টেম্বর রাত। ঘুমিয়ে নিদারাবাদ গ্রাম। শুধু জেগে কসাই তাজুলের নেতৃত্বে একদল দুর্বৃত্ত। গভীর রাতে ৩০ থেকে ৪০ জনের ওই দুর্বৃত্তের দল হামলা চালায় শশাঙ্কের পরিবারের ওপর। জানালার লোহার রড ভেঙে ঘরে ঢুকে দুর্বৃত্তরা তাদের অস্ত্রের মুখে জিম্মি করে। তারা অপহরণ করে নিয়ে যায় শশাঙ্কের স্ত্রী বিরজাবালা (৪৫), মেয়ে নিয়তি বালা (১৭), প্রণতি বালা (১০), ছেলে সুভাষ দেবনাথ (১৪), সুপ্রসন্ন দেবনাথ সুমন (৫) ও দুই বছরের সুজন দেবনাথকে। বাঁচার জন্য তারা গগনবিদারী চিৎকার শুরু করেন। তাদের চিৎকারে আশপাশের লোকজন এগিয়ে এলেও সংঘবদ্ধ দলের সামনে দাঁড়াতে সাহস পাননি। গ্রামবাসীর সামনে দিয়েই অপহরণ করে নিয়ে যাওয়া হয় তাদের। বড় একটি নৌকায় তুলে নেওয়া হয় তাদের। এ নিয়ে কেউ উচ্চবাচ্য করেননি। তাজুল সবাইকে জানান, বিরজাবালা জমিজমা তার কাছে বিক্রি করে ভারত চলে গেছেন।

লাশের সন্ধান : ব্রাহ্মণবাড়িয়া সদর উপজেলার (বর্তমান বিজয়নগর উপজেলা) নিদারাবাদ গ্রাম। গ্রামের প্রায় আড়াই কিলোমিটার দূরে ধুপাজুড়ি বিল। নৌকায় করে সেই বিল দিয়ে প্রতিদিনই বিদ্যালয়ে যাওয়া-আসা ছিল ওই গ্রামের শিক্ষক আবুল মোবারকের। একদিন বিকালে স্কুল থেকে ফেরার পথে বিলের পানিতে দুর্গন্ধযুক্ত তেল ভাসতে দেখেন। তিনি নৌকার গতিপথটা একটু ঘুরিয়ে নেন। হঠাৎ নৌকার তলদেশে কী একটা আটকে যাওয়ায় দুলে ওঠে তার নৌকা! এবার মাঝির বৈঠায় খটখট শব্দ! সন্দেহ হয় শিক্ষক আবুল মোবারকের। তার নির্দেশমতো মাঝি বৈঠা দিয়ে পানির নিচে খোঁচাখুঁচি করতেই ভেসে ওঠে ড্রাম! তিনি ইউপি চেয়ারম্যান, মেম্বার ও এলাকার গণ্যমান্য ব্যক্তিদের খবর দেন। ড্রাম খুলতেই স্তব্ধ সবাই। তিন তিনটি লাশ! সন্ধান চলে আরও। মিলেও যায়। আরেকটি ড্রামে টুকরা টুকরা করে রাখা আরও তিনজনের লাশ! লাশ ছয়টি শনাক্ত হলো। এরা আর কেউ নন, একই গ্রামের নিরীহ শশাঙ্ক দেবনাথের স্ত্রী ও পাঁচ অবুঝ সন্তানের এগুলো। এ ছয় লাশ উদ্ধারের দুই বছর আগে অপহূত হন শশাঙ্ক। তার আর খোঁজ মেলেনি। শশাঙ্কের এক মেয়ে সুনিতী শ্বশুরবাড়ি থাকায় তিনি বেঁচে যান প্রাণে।

গ্রেফতারকৃতদের কাছ থেকে পুলিশ জানতে পারে সে রাতের ঘটনা। তারা জানান, নৌকার ওপরই তাদের ছয়জনকে কুপিয়ে হত্যার পর টুকরা টুকরা করে। পরে ড্রামে ভরে ফেলে দেয় ধুপাজুড়ি বিলে। ঘটনার ১০ দিন পর ১৬ সেপ্টেম্বর অপহূত ছয়জনের লাশ মেলে। প্রতিটি লাশই ছিল কয়েক টুকরা। লাশে দ্রুত পচন ধরায় ঘাতকরা ড্রামের ভিতর চুন দিয়ে রাখে। বিল থেকে ছয়জনের লাশ উদ্ধারের পর এ খবর ছড়িয়ে পড়ে আশপাশের গ্রামে। হাজার হাজার মানুষ মর্মান্তিক সে ঘটনা জানতে ও লাশ দেখতে ঘটনাস্থলে ভিড় জমান। আসে খুনের সঙ্গে জড়িতদের একজনও। সে হত্যাকাণ্ডের হোতা তাজুল ইসলামের বোনজামাই হাবিবুর রহমান। সে একা বড় একটি নৌকা নিয়ে লাশ দেখতে এলে এলাকাবাসী তাকে জিজ্ঞাসাবাদ করে। কথাবার্তায় সন্দেহ হলে তাকে পুলিশে দেওয়া হয়। তার স্বীকারোক্তির ভিত্তিতে আসামি করা হয় তাজুল ইসলাম, হাবিবুর রহমান, এনু মিয়া, ফিরোজ মিয়া, ফিরোজ মিয়া (২), হাবিব মিয়া, আবুল হোসেন, জজ মিয়া, বাদশা মিয়া, মো. কাজল, ফারুক মিয়া, আবুল কাশেমকে। এ ঘটনায় ইউনিয়ন পরিষদের তৎকালীন সদস্য (মেম্বার) মো. ধন মিয়া চৌধুরী বাদী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া থানায় মামলা করেন। পুলিশ এ ঘটনায় ৩৮ জনকে দায়ী করে আদালতে অভিযোগপত্র (চার্জশিট) দেয়। জানা গেছে, শশাঙ্কের সম্পত্তির ওপর লোভ ছিল পাশের গ্রামের কসাই তাজুল ইসলামের। এ কারণেই প্রথমে অপহরণ করে শশাঙ্ককে হত্যা করেন তিনি। দুই বছর পর তার স্ত্রী-সন্তানসহ ছয়জনকে হত্যা করেন। সে সময় দুই বছরের শিশুকেও হত্যা করতে হাত কাঁপেনি খুনিদের। নৌকার সঙ্গে ড্রামের ছোট্ট ‘একটি ধাক্কা’ খুলে দেয় রহস্যে ঘেরা নিদারাবাদ ট্র্যাজেডির আদ্যোপান্ত। অতঃপর খুনি ধরা পড়ে। ১৯৯০ সালের জুন মাসে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জজ আদালত এক রায়ে ৯ জনের ফাঁসি, ২৭ জনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ও দুজনকে বেকসুর খালাস দেয়। পরে উচ্চ আদালত খুনি তাজুল ইসলাম, বাদশা মিয়ার ফাঁসি ও আটজনের যাবজ্জীবন কারাদণ্ডের আদেশ বহাল রাখে। সাজাপ্রাপ্তদের মধ্যে আবুল হোসেন নামে একজন এখনো পলাতক। ১৯৯৩ সালের ১১ আগস্ট রাত ২টা ১ মিনিটে কুমিল্লা কারাগারে তাজুল আর বাদশার ফাঁসি কার্যকর হয়। খুনি কসাই তাজুলের প্রতি মানুষের ঘৃণা-ক্ষোভ এতটাই ছিল যে, তার ফাঁসি কার্যকরের পর ঘরে ঘরে মিষ্টি বিতরণ করা হয়। তার লাশ কারাগার থেকে বের করার সময় ক্ষুব্ধ মানুষ থু-থু দিয়েছে। ছুড়ে  মেরেছে জুতা।

 ২৮ বছর আগেকার এ ঘটনাটি এখনো মানুষের মনে গভীর দাগ কেটে আছে। ছয় খুনের ঘটনা মনে করলে এখনো আঁতকে ওঠেন সেখানকার মানুষ। ঘটনাটি এতটাই আলোচিত হয়েছিল যে, এ নিয়ে পরবর্তীতে একটি চলচ্চিত্রও নির্মাণ করা হয়। নাম ছিল ‘কাঁদে নিদারাবাদ’।

সর্বশেষ খবর