বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা
শোক দিবসের আলোচনায় প্রধানমন্ত্রী

আদালতের বিবেক তখন কোথায় ছিল

নিজস্ব প্রতিবেদক

আদালতের বিবেক তখন কোথায় ছিল

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা গতকাল রাজধানীর আগারগাঁওয়ের বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগর উত্তর ও দক্ষিণ আওয়ামী লীগ আয়োজিত শোক দিবসের আলোচনা সভায় বক্তব্য রাখেন —বাংলাদেশ প্রতিদিন

বঙ্গবন্ধুকন্যা আওয়ামী লীগ সভানেত্রী প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ জারি করে যখন জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিচারের পথ রুদ্ধ করা হয়েছিল, তখন দেশের আদালতের বিবেক কোথায় ছিল, প্রশ্ন তুলেছেন। তিনি বলেন, ‘এখন তো দেখি কত রিট হয়, সুয়োমোটো অর্ডার হয়। কিন্তু যখন এত বড় অন্যায় হলো, ইনডেমনিটি দিয়ে খুনিদের বিচারের পথ বন্ধ করা হলো তখন আদালতের বিবেক কোথায় ছিল? উচ্চ আদালতের বিবেক কি তখন বন্দী ছিল? আর আমাদের দেশের এত বড় নামিদামি আইনজীবী থেকে শুরু করে এত এত বিবেকবান ছিলেন, একটু উনিশ-বিশ হলেই কত কথা বলেন। তখন তারা কোথায় ছিলেন? কেন তারা তখন প্রতিবাদ করেননি?’ প্রধানমন্ত্রী জাতীয় শোক দিবস উপলক্ষে গতকাল বিকালে বঙ্গবন্ধু আন্তর্জাতিক সম্মেলন কেন্দ্রে ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগ উত্তর ও দক্ষিণ আয়োজিত আলোচনা সভায় প্রধান অতিথির ভাষণ দিচ্ছিলেন। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, ‘হত্যার বিচার করা যাবে না— এ রকম আইন পৃথিবীর কোনো দেশে নেই। কিন্তু আমাদের দেশে সে আইন হয়েছিল। আমরা (শেখ হাসিনা ও শেখ রেহানা) কি এ দেশের নাগরিক নই? আমরা যারা বাবা-মাসহ সবাইকে হারিয়েছি, তাদের হত্যার বিচার চাইতে পারব না? আজ অনেকেই একটা হত্যাকাণ্ড হলেই বিচারের দাবিতে সোচ্চার হন। আমার কাছে আসেন। বিচার চান। তখন ভাবী আমিও তো সব হারিয়েছিলাম। কিন্তু তখন তো আমাদের বিচার চাওয়ার অধিকারটুকু কেড়ে নেওয়া হয়েছিল।’ তিনি বলেন, তার দল একুশ বছর পর ক্ষমতায় এসে সংসদে ইনডেমনিটি অধ্যাদেশ বাতিল করে। খুনিদের বিচার শুরু করে। কিন্তু রায় কার্যকর করতে পারেনি। তার সরকার দ্বিতীয় মেয়াদে ক্ষমতায় এসে সেই খুনিদের বিচার করেছে।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডে জিয়াউর রহমান সরাসরি জড়িত মন্তব্য করে শেখ হাসিনা বলেন, ‘বঙ্গবন্ধু হত্যা ষড়যন্ত্রে বেইমান ও মুনাফিক মোশতাকের ডান হাত ছিলেন জিয়াউর রহমান। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর মোশতাকই জিয়াউর রহমানকে সেনাপ্রধান করেছিলেন। কিন্তু বেইমানরা বেশিদিন ক্ষমতায় টিকে থাকতে পারেনি। মীর জাফরও পারেনি, বেইমান মোশতাকও তিন মাসের বেশি ক্ষমতায় থাকতে পারেনি। ’৭৫-পরবর্তী ২১টি বছর ক্ষমতাসীন জিয়া-এরশাদ-খালেদা জিয়ারা বঙ্গবন্ধুর হত্যার বিচার করেননি, বরং খুনিদের পুরস্কৃত ও মদদ দিয়েছেন।

সংবিধান লঙ্ঘন করে অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর আত্মস্বীকৃত খুনিদের বিভিন্ন দূতাবাসে চাকরি দিয়ে পুরস্কৃত করেছিলেন। কূটনৈতিক মিশনে যাদের চাকরি দেওয়া হলো, তাদের যোগ্যতা কী? তারা অনেক খুন করেছে, জাতির পিতা ও রাষ্ট্রপতিকে হত্যা করেছে, শিশু-নারীকে হত্যা করেছে। জিয়াউর রহমানের দৃষ্টিতে এরাই সবচেয়ে যোগ্য ছিল। আমি জানি সেই সময়ে যারা বিবেকবান ছিলেন, যারা বুদ্ধিজীবী ছিলেন, যারা আইনজীবী ছিলেন, তাদের অনেকেই কোনো প্রতিবাদ করেননি। হাতে গোনা কয়েকজন প্রতিবাদ করেছিলেন। কিন্তু এখন যারা অনেক কথা বলেন তারা তো তখন কোনো প্রতিবাদ করেননি।’

তিনি বলেন, ‘আত্মস্বীকৃত খুনিদের দূতাবাসে পাঠানোর কারণে পৃথিবীর বহু দেশ তাদের গ্রহণ করেনি। আমি পোল্যান্ডের কথা জানি, তারা খুনিদের গ্রহণ করেনি, ফিরিয়ে দিয়েছিল, নিষেধ করে বলেছিল— এরা মুজিবকে হত্যা করেছে, এদের আমরা নিতে পারি না। বিদেশি বন্ধুরাষ্ট্র সে সময় যে বিবেক দেখিয়েছিল, তখন আমাদের দেশের কজন বিবেকবান সেই বিবেক দেখিয়েছিলেন?’

ঢাকা মহানগরী আওয়ামী লীগ দক্ষিণের সভাপতি হাজী আবুল হাসনাতের সভাপতিত্বে আলোচনা সভায় আরও বক্তব্য দেন আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ড. আবদুর রাজ্জাক, লে. কর্নেল (অব.) মুহম্মদ ফারুক খান, ত্রাণমন্ত্রী মোফাজ্জল হোসেন চৌধুরী মায়া বীরবিক্রম, খাদ্যমন্ত্রী অ্যাডভোকেট কামরুল ইসলাম, নগর নেতা শাহে আলম মুরাদ, সাদেক খান, কামাল চৌধুরী, এস এম মান্নান কচি, হুমায়ুন কবির, শেখ বজলুর রহমান প্রমুখ। সভা পরিচালনা করেন দক্ষিণের প্রচার সম্পাদক আকতার হোসেন ও উত্তরের উপ-প্রচার সম্পাদক আজিজুল হক রানা।

বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ড-পরবর্তী দীর্ঘ একুশ বছর বঙ্গবন্ধুর নাম মুছে ফেলতে এবং দেশের নীতি-আদর্শ ধ্বংস করে ব্যর্থ রাষ্ট্রে পরিণত করতে ক্ষমতাসীনদের নানা ষড়যন্ত্র-চক্রান্তের কথা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘অবৈধভাবে ক্ষমতা দখল করে জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর খুনিদের শুধু পুরস্কৃত নয়, কারাগারে আটক সব যুদ্ধাপরাধীকে বিচারের হাত থেকে রেহাই দিয়ে রাজনীতিতে পুনর্বাসন, স্বাধীনতাবিরোধীদের প্রধানমন্ত্রী, মন্ত্রী ও উপদেষ্টা বানিয়ে ক্ষমতার অংশীদার করেছিলেন। অথচ তিনি নাকি মুক্তিযুদ্ধের খেতাবধারী মুক্তিযোদ্ধা! মুক্তিযুদ্ধের বিজয় ও স্বাধীনতার ইতিহাসই এই ব্যক্তিটি মুছে ফেলার চেষ্টা করেছিলেন।’

আবেগজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘সপরিবারে বঙ্গবন্ধুকে হত্যার পর দীর্ঘদিন জিয়াউর রহমান আমাদের দুই বোনকে দেশে ফিরতে দেননি। আমার অনুপস্থিতিতে আমাকে আওয়ামী লীগের সভাপতি নির্বাচন করা হয়। এরপর অনেক বাধা ও ষড়যন্ত্র মোকাবিলা করে দেশে ফিরলেও ধানমন্ডির ৩২ নম্বর সড়কে বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে আমাদের ঢুকতে দেওয়া হয়নি। আমরা বাড়ির সামনের রাস্তায় বসে দোয়া-মোনাজাত করেছি।’ তিনি বলেন, ‘তখন জিয়াউর রহমান বঙ্গবন্ধুর বাড়ির পরিবর্তে আমাকে আরেকটি বাড়ি দিতে চেয়েছিলেন। কিন্তু কোনো খুনির কাছ থেকে কোনো কিছু নেওয়ার মনোবৃত্তি আমার ছিল না। আমি ঘৃণাভরে সেই প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান করেছিলাম।’

প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘জিয়াউর রহমান হত্যাকাণ্ডের পর তড়িঘড়ি করে আমাকে বঙ্গবন্ধুর বাড়িটি বুঝিয়ে দেওয়ার চেষ্টা করা হয়। তখন তাদের ষড়যন্ত্র আমরা বুঝতে পারি। ওই সময় তো জিয়াকে সাধু বানাতে অনেক বিবেকবান মানুষই সোচ্চার ছিলেন। ভাঙা স্যুটকেস, ছেঁড়া গেঞ্জি ছাড়া জিয়া আর কিছু রেখে যাননি, আর বঙ্গবন্ধুর বাড়িতে অনেক সোনা-হীরা-জহরত ছিল এমন অপপ্রচার চালানো হয়েছিল প্রায় ৪০ দিন ধরে। পরে দেশের মানুষ কী দেখতে পেল? ভাঙা স্যুটকেস আর ছেঁড়া গেঞ্জি জাদুর বাক্স হয়ে গেল। জিয়া পরিবার শত শত কোটি টাকার মালিক হয়ে গেল।’

প্রধানমন্ত্রী এ সময় বিএনপি-জামায়াত জোটের আন্দোলন ও নির্বাচন বানচালের নামে শত শত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যা, নাশকতা, জঙ্গিবাদ ও সন্ত্রাস সৃষ্টির ভয়াল চিত্র দেশবাসীর সামনে তুলে ধরে বলেন, ‘নির্বাচনে যাননি এটা বিএনপি নেত্রীর নিজস্ব রাজনৈতিক সিদ্ধান্ত। আমি তো তাকে নির্বাচনে আনতে অনেক চেষ্টা করেছিলাম। ফোন করে বলেছিলাম— যে যে মন্ত্রণালয় চান দিয়ে দেব, তবুও আসুন সবাই মিলে নির্বাচন করি। তিনি নির্বাচনে না এসে জঙ্গি-সন্ত্রাসী স্টাইলে আন্দোলনের নামে অসংখ্য মানুষকে হত্যা করলেন। জীবন্ত মানুষকে পুড়িয়ে হত্যার নোংরা ও হিংস্র কর্মকাণ্ড করলেন। আসলে এরা (বিএনপি-জামায়াত) মানুষের কল্যাণ করতে পারে না, এরা দেশ ও মানুষের ধ্বংস করতে জানে। জনগণের প্রতিরোধের মুখে অবশ্য খালেদা জিয়া ঘরে ফিরে যেতে বাধ্য হয়েছিলেন। এখন নির্বাচন যতই এগিয়ে আসছে ততই তাদের নানা অজুহাত শোনা যাচ্ছে।’

শেখ হাসিনা বলেন, ‘নির্বাচনে তৃতীয়বারের মতো আমরা ক্ষমতায় আসতে পেরেছি বলেই জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু, জেল হত্যাকাণ্ড, অস্ত্র পাচার ও যুদ্ধাপরাধীদের বিচার করতে পেরেছি। বঙ্গবন্ধুর আদর্শ অনুযায়ী নিরলসভাবে দেশ পরিচালনা করছি বলেই বাংলাদেশ আজ সারা বিশ্বের কাছে উন্নয়নের রোল মডেল। পৃথিবীর অনেক দেশের কাছেই উন্নয়নের ক্ষেত্রে বাংলাদেশ এখন বিস্ময়। একটা ভালো কাজ করলেই মনে হয় আব্বা (বঙ্গবন্ধু) তা দেখে খুশি হচ্ছেন, দোয়া করছেন।’

ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেত্রী খালেদা জিয়া ও তার পরিবারের সদস্যদের দুর্নীতি, লুটপাট, অর্থ পাচারসহ এতিমের টাকা আত্মসাতের ঘটনা তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ‘দেশের কল্যাণে নয়, এরা ক্ষমতায় আসেই দুর্নীতি, দুঃশাসন, লুটপাট ও বিদেশে অর্থ পাচার করতে। ক্ষমতায় থাকতে বিএনপি নেত্রী এতিমের টাকা মেরে খেয়েছেন। বিদেশে অর্থ পাচারের দায়ে বিদেশের আদালতে বিএনপি নেত্রীর দুই পুত্র দোষী সাব্যস্ত হয়েছে, আমরা তাদের পাচারকৃত কিছু অর্থ ফেরতও এনেছি। শুধু তাই নয়, খালেদা জিয়া প্রধানমন্ত্রী থাকতেও জরিমানা দিয়ে দুর্নীতির কালো টাকা সাদা করেছেন।’

সর্বশেষ খবর