বৃহস্পতিবার, ৩১ আগস্ট, ২০১৭ ০০:০০ টা

হাজার সালাম জানানো শিল্পী আবদুল জব্বারের চির বিদায়

সাংস্কৃতিক প্রতিবেদক

হাজার সালাম জানানো শিল্পী আবদুল জব্বারের চির বিদায়

একাত্তরের মহান মুক্তিযুদ্ধের সময় হারমোনিয়াম হাতে ‘সালাম সালাম হাজার সালাম শহীদ ভাইয়ের স্মরণে’ গাওয়া জননন্দিত শিল্পী আবদুল জব্বার অগণিত ভক্ত, অনুরাগী, সুহৃদদের শোকের সাগরে ভাসিয়ে না ফেরার দেশে চলে গেছেন।

রাজধানীর বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব মেডিকেল বিশ্ববিদ্যালয় হাসপাতালে চিকিৎসাধীন অবস্থায় গতকাল সকাল ৯টা ১০ মিনিটে তিনি শেষ নিঃশ্বাস ত্যাগ করেন (ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন)। দীর্ঘদিন ধরে তিনি লিভার, ক্রনিক কিডনি ও হৃদরোগে ভুগছিলেন। তার বয়স হয়েছিল ৭৯ বছর। তিনি দুই স্ত্রী, দুই ছেলে ও দুই মেয়েসহ অসংখ্য আত্মীয়স্বজন ও গুণগ্রাহী রেখে গেছেন। বিশিষ্ট এই শিল্পী ও মুক্তিযোদ্ধার মৃত্যুতে গভীর শোক প্রকাশ করেছেন রাষ্ট্রপতি আবদুল হামিদ ও প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা। আরও শোক প্রকাশ করেছেন জাতীয় সংসদের স্পিকার ড. শিরীন শারমিন চৌধুরী, অর্থমন্ত্রী আবুল মাল আবদুল মুহিত, বাংলাদেশ আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক ও সেতুমন্ত্রী ওবায়দুল কাদের, মুক্তিযুদ্ধ বিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক, বেসামরিক বিমান পরিবহন ও পর্যটন মন্ত্রী রাশেদ খান মেনন, তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর প্রমুখ।

মৃত্যুর তিন ঘণ্টা পর গতকাল দুপুর ১২টার দিকে হাসপাতাল থেকে শিল্পীর মরদেহ মোহাম্মদপুরের মারকাজুলে নিয়ে যাওয়া হয়। সেখানে গোসল করানো শেষে মরদেহ নেওয়া হয় ভূতের গলির বাসায়। এরপর মরদেহ বারডেম হাসপাতালের হিম ঘরে রাখা হয়। সর্বস্তরের মানুষের শ্রদ্ধা নিবেদনের জন্য আজ বৃহস্পতিবার সকাল ১১টা থেকে দুপুর ১টা পর্যন্ত কেন্দ্রীয় শহীদ মিনারে রাখা হবে আবদুল জব্বারের মরদেহ। এরপর বাদ জোহর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের কেন্দ্রীয় মসজিদে নামাজে জানাজা শেষে মিরপুরের শহীদ বুদ্ধিজীবী কবরস্থানে তাকে সমাহিত করা হবে।

আবদুল জব্বারের মৃত্যুতে দেশের সংস্কৃতি অঙ্গনে নেমে এসছে শোকের ছায়া। কিংবদন্তি এই শিল্পীর মৃত্যুতে হাসপাতালে ছুটে আসেন তথ্যমন্ত্রী হাসানুল হক ইনু, সংস্কৃতিমন্ত্রী আসাদুজ্জামান নূর, আওয়ামী লীগ নেতা ও সাবেক আইনমন্ত্রী আবদুল মতিন খসরু, শিল্পী তিমির নন্দী, সম্মিলিত সাংস্কৃতিক জোটের সভাপতি গোলাম কুদ্দুছ প্রমুখ।

পাঁচ দশকের সংগীতজীবনে প্রেম, বিরহ, মরমী, দেশাত্মবোধক, প্রতিবাদী, উদ্দীপনামূলক, ভক্তিমূলক ও চলচ্চিত্রের গানসহ নানা ধরনের সংগীত পরিবেশন করে নিজেকে কিংবদন্তি শিল্পীতে পরিণত করেন আবদুল জব্বার। অসংখ্য কালজয়ী গানে কণ্ঠ দেওয়া শিল্পী আবদুল জব্বার মুক্তিযুদ্ধের সময় কাঁধে হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে গেরিলাদের বিভিন্ন ক্যাম্পে গিয়ে উদ্দীপনামূলক গান গেয়ে মুক্তিযোদ্ধাদের এবং জনগণকে উজ্জীবিত করেছিলেন। ওই দুঃসময়ে তিনি স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্রে অসংখ্য গান গেয়েছেন। স্বাধীন বাংলা বেতার কেন্দ্র থেকে এ শিল্পীর গাওয়া বিভিন্ন গান মুক্তিযোদ্ধাদের পাশাপাশি দেশবাসীরও প্রেরণা ও মনোবল বাড়িয়েছিল। গলায় হারমোনিয়াম ঝুলিয়ে ভারতের বিভিন্ন স্থানে গণসংগীত গেয়ে প্রাপ্ত ১২ লাখ টাকা তিনি স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের ত্রাণ তহবিলে দান করেন। ১৯৭১ সালে তিনি মুম্বাইয়ে ভারতের প্রখ্যাত কণ্ঠশিল্পী হেমন্ত মুখোপাধ্যায়কে সঙ্গে নিয়ে বাংলাদেশের স্বাধীনতার জন্য জনমত তৈরিতেও নিরলসভাবে কাজ করেছিলেন। তার গাওয়া উল্লেখযোগ্য গানগুলো হলো— তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়, সালাম সালাম হাজার সালাম, ওরে নীল দরিয়া, এ ভুবনে কে আপন, এ মালিকে জাহান, আমার সে প্রেম, আমি বসন্ত হয়ে এসেছি, আমি এক নীড় হারা পাখি, আমি নীরবে জ্বলতে চাই, আমি প্রদীপের মতো আলো দিয়ে যাব, আমি তো বন্ধু মাতাল নই, ভালোবাসা যদি, বিদায় দাও গো বন্ধু তোমরা, দোজাহানের মালিক তুমি, এ আঁধার কখনো যাবে না মুছে, এক বুক জ্বালা নিয়ে, জানি কবিতার চেয়ে তুমি, কে যেন আজ ডেকে নিয়ে যায়, খেলাঘর বারে বারে, কি গান শোনাব ওগো বন্ধু, মুখ দেখে ভুল করো না ইত্যাদি। তার গাওয়া ‘তুমি কি দেখেছো কভু জীবনের পরাজয়’, ‘সালাম সালাম হাজার সালাম, ‘জয় বাংলা বাংলার জয়, এই ৩টি গান ২০০৬ সালের মার্চ মাসজুড়ে অনুষ্ঠিত বিবিসি বাংলার শ্রোতাদের বিচারে সর্বকালের শ্রেষ্ঠ ২০টি বাংলা গানের তালিকায় স্থান করে নিয়েছে।

মেঘের পর মেঘ, অধিকার, মাস্তান, জীবন তৃষ্ণা, আলোর মিছিল, জয় পরাজয়, মা, বেঈমান, ঝড়ের পাখি, আপন পর, দাতা হাতেম তাই, বিনিময়, এতোটুকু আশা, কত যে মিনতি, মানুষের মন, অবুঝ মন, ঢেউয়ের পর ঢেউ, অনুরাগ, দ্বীপ নেভে নাই, পীচ ঢালা পথ, ঘর জামাই, সারেং বউ, ঈমান, যে আগুনে পুড়ি, সাধু শয়তান, আগুনের আলো, স্লোগান ইত্যাদি চলচ্চিত্রসহ প্রায় দুই শতাধিক চলচ্চিত্রের গানে তিনি কণ্ঠ দেন। সংগীতে অসামান্য অবদানের স্বীকৃতিস্বরূপ তিনি বঙ্গবন্ধু পদক (১৯৭৩), একুশে পদক (১৯৮০) ও স্বাধীনতা পদক (১৯৯৬), জহির রায়হান চলচ্চিত্র পুরস্কার, বাচসাস আজীবন সম্মাননা, সিটিসেল-চ্যানেল আই সংগীত পুরস্কারসহ জাতীয় পর্যায়ে বিভিন্ন পদক ও সম্মাননা অর্জন করেন।

সর্বশেষ খবর