শিরোনাম
বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

রোহিঙ্গা উত্কণ্ঠা বিশ্বজুড়ে

দেশে দেশে বিক্ষোভ, সু চিকে মানবিক হতে বললেন এরদোগান, নোবেল বাতিলে জনমত, বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন মালদ্বীপের, ইন্দোনেশিয়ায় দূতাবাসে হামলা, বঙ্গোপসাগরে উদ্ধারকারী জাহাজ

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

রোহিঙ্গা উত্কণ্ঠা বিশ্বজুড়ে

উখিয়া সীমান্তে এভাবেই বাংলাদেশে আসছে রোহিঙ্গারা। মিয়ানমার সরকারের নিপীড়নের বিরুদ্ধে গতকাল ভারতের দিল্লিতে বিক্ষোভ —এএফপি

মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নৃশংসতার প্রতিবাদে বিশ্বের বিভিন্ন দেশে বিক্ষোভ হয়েছে। রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়া, ইন্দোনেশিয়া, যুক্তরাষ্ট্রসহ কয়েকটি দেশে রাজপথে সভা-সমাবেশ হয়েছে। নিন্দা জানিয়েছে জাতিসংঘসহ বিভিন্ন দেশ ও সংস্থা। তুরস্কের প্রেসিডেন্ট রিসেপ তাইয়েপ এরদোগান মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চিকে ফোন করে রোহিঙ্গাদের ওপর মানবিক আচরণ করার আহ্বান জানিয়েছেন। মিয়ানমারের সঙ্গে বাণিজ্যিক সম্পর্ক ছিন্ন করার ঘোষণা দিয়েছে মালদ্বীপ। রাখাইন প্রদেশের রোহিঙ্গাদের উদ্ধারে একটি স্বেচ্ছাসেবী সংস্থার জাহাজ ভূমধ্যসাগর থেকে বঙ্গোপসাগরের উদ্দেশে রওনা দিয়েছে। আলোচনার জন্য চলছে আন্তর্জাতিক পর্যায়ে দৌড়ঝাঁপ। ইতিমধ্যেই মিয়ানমার ও বাংলাদেশ সফর করেছেন ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী। আজ ঢাকা আসছেন তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী। জানা যায়, শান্তিতে নোবেলজয়ী মিয়ানমারের গণতন্ত্রপন্থি নেত্রী অং সান সু চি রোহিঙ্গাদের প্রতি তার দেশের নিরাপত্তা বাহিনীর চরম দমন-পীড়ন ও নির্যাতন বন্ধ করতে এবং নিন্দা জানাতে ব্যর্থ হওয়ায় আন্তর্জাতিক সমাজে ব্যাপক চাপের মুখে পড়েছেন। জাতিসংঘের বিশেষ মানবাধিকার কর্মকর্তা ইয়াংহি লি বলছেন, ‘গত অক্টোবরের তুলনায় এবার ধ্বংসযজ্ঞের মাত্রা অনেক বেশি। ২০১৬ সালের অক্টোবরে রাখাইনে সহিংসতার সময়ও এত বেশিসংখ্যক রোহিঙ্গা মিয়ানমার ছেড়ে আসেনি। তবে সে সময় এবং এখন দুই সময়েই রাখাইনে পুলিশ ফাঁড়িতে রোহিঙ্গা বিদ্রোহীদের হামলা-পরবর্তী সেনা অভিযানের কারণে রোহিঙ্গাদের এ ঢল নেমেছে। এ পরিস্থিতি সামাল দিতে অং সান সু চিকে এগিয়ে আসতে হবে।’ সু চি একটি কঠিন এবং বেকায়দা অবস্থার মধ্যে থাকলেও এখন তার সেই অবস্থা থেকে বের হয়ে আসার সময় হয়েছে বলে মনে করেন জাতিসংঘের কর্মকর্তা।

ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রীর হুঁশিয়ারি : ব্রিটিশ পররাষ্ট্রমন্ত্রী জনসন মিয়ানমার নেত্রী অং সান সু চিকে সতর্ক করে দিয়ে বলেছেন, ‘রাখাইনের রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর যেভাবে নির্যাতন এবং গণহত্যা চালানো হচ্ছে তাতে আপনার দেশই কলঙ্কিত হচ্ছে। আমি মনে করি, মিয়ানমারের জনগণকে একতাবদ্ধ করতে এবং রাখাইনের সব সম্প্রদায়ের মানুষের ওপর সহিংসতা ও নির্যাতন বন্ধে আপনি আপনার নেতৃত্ব ব্যবহার করতে পারেন।’ রোহিঙ্গাদের ওপর সব ধরনের সহিংসতা বন্ধে করতে অং সান সু চির প্রতি আহ্বান জানান তিনি।

ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রীর সঙ্গে তুরস্ক ও ইন্দোনেশিয়ার মন্ত্রীর ফোনালাপ : রোহিঙ্গা মুসলমানদের অমানবিক পরিস্থিতির বিষয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মুহাম্মাদ জাওয়াদ জারিফ গতকাল তুরস্কের পররাষ্ট্রমন্ত্রী মেভলুট ক্যাভুফোগলু, মালয়েশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আনিফা আমান ও ইন্দোনেশিয়ার পররাষ্ট্রমন্ত্রী রেতনো মারসুদির সঙ্গে টেলিফোনে কথা বলেছেন। ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেছেন, ‘রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে চলমান নৃশংসতা বন্ধে মুসলিম দেশগুলোর পক্ষ থেকে সমন্বিত পদক্ষেপ গ্রহণ করতে হবে। এ ক্ষেত্রে কার্যকর পদক্ষেপ গ্রহণে ইরান প্রস্তুত রয়েছে।’ তিনি আন্তর্জাতিক সংস্থাগুলোর পক্ষ থেকেও জোরালো পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানান। এর আগে এক টুইটার বার্তায় ইরানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী রোহিঙ্গা ইস্যুতে নীরবতা পালন করায় আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের তীব্র সমালোচনা করে বলেন, ‘আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের অব্যাহত নীরবতার কারণে রোহিঙ্গা মুসলমানদের ওপর সহিংসতা চলছে।’

অ্যাকশন প্রয়োজন বললেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট : ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট জোকো উইদোদো জাকার্তায় তার রাষ্ট্রীয় প্রাসাদে এক সংবাদ সম্মেলন করে মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে রোহিঙ্গা মুসলিমদের বিরুদ্ধে চলমান সহিংসতা শিগগিরই বন্ধ করতে হবে বলে হুঁশিয়ারি দিয়েছেন। রাখাইনে সংঘাত নিরসনে সব পক্ষকে দৃঢ় পদক্ষেপ নেওয়ার আহ্বান জানিয়েছেন তিনি। তিনি বলেন, ‘রাখাইন সংকট সমাধানে বাস্তব অ্যাকশন দরকার। শুধু সমালোচনামূলক বিবৃতিতে কাজ হবে না।’ জাকার্তার নাগরিক সমাজের পাশাপাশি আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সঙ্গে সমন্বয়ের মাধ্যমে রাখাইনের মানবিক সংকট সমাধানে ইন্দোনেশিয়া সরকার সহায়তা করতে রাজি আছে বলে জানান উইদোদো। জাতিসংঘ মহাসচিব অ্যান্টনিও গুতেরেস ও রাখাইন সহিংসতায় জাতিসংঘের স্পেশাল অ্যাডভাইজরি কমিশনের প্রধান কফি আনান এবং অন্য পক্ষগুলোর সঙ্গে যোগাযোগ করতে দেশটির পররাষ্ট্রমন্ত্রীকে নির্দেশ দিয়েছেন ইন্দোনেশিয়ার প্রেসিডেন্ট। তিনি বলেন, ‘জাতিগত নিপীড়নের শিকার রোহিঙ্গাদের মানবিক সহায়তা অব্যাহত রাখবে আমার সরকার। আমরা রাখাইনে একটি স্কুল তৈরি করেছি এবং শিগগিরই একটি হাসপাতাল নির্মাণ করা হবে। নির্মাণকাজ শুরু হবে অক্টোবরে।’

সম্পর্ক ছিন্ন করল মালদ্বীপ : মালদ্বীপের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় এক বিবৃতিতে জানিয়েছে, মিয়ানমারে সাম্প্রতিক সহিংতায় রোহিঙ্গা মুসলমানদের মৃত্যু এবং লাখো মানুষের বাস্তুচ্যুতিতে মালদ্বীপ গভীরভাবে উদ্বিগ্ন। সংখ্যালঘু মুসলিমদের ওপর নৃশংসতা বন্ধে ব্যবস্থা না নেওয়া পর্যন্ত মিয়ানমারের সঙ্গে সব বাণিজ্যিক সম্পর্ক বন্ধ রাখবে দেশটি। সেই সঙ্গে রোহিঙ্গাদের বিরুদ্ধে পদ্ধতিগত দমন-পীড়নের নিন্দা জানানোর পাশাপাশি রক্তক্ষয় বন্ধে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতিও আহ্বান জানায় মালদ্বীপ।

মিয়ানমার যাচ্ছে উদ্ধারকারী জাহাজ : বিবিসির প্রতিবেদনে বলা হয়েছে, দ্য মাইগ্রেন্ট অফশোর এইড স্টেশন (মোয়াস) ২০১৪ সাল থেকে ভূমধ্যসাগরে ইউরোপগামী শরণার্থীদের উদ্ধারকাজ চালিয়ে আসছে। তারা এখন তাদের কার্যক্রম মিয়ানমারে সরিয়ে নেওয়ার কথা জানিয়েছে। রাখাইনে সহিংসতার পর যে রোহিঙ্গারা শরণার্থী হয়ে অন্য কোথাও আশ্রয় খুঁজছে তাদের নিতে উদ্ধারকারী জাহাজ পাঠানোর পরিকল্পনা করছে তারা। তাদের উদ্ধারকারী জাহাজ ফিনিক্স তিন সপ্তাহের মধ্যে বঙ্গোপসাগরে পৌঁছবে বলে ধারণা করা হচ্ছে। এটিই গত তিন বছর ভূমধ্যসাগরে কাজ করেছে। এখন ফিনিক্সের মাধ্যমে রোহিঙ্গা গোষ্ঠীকে যত দূর সম্ভব মানবিক সহায়তা ও প্রয়োজনীয় সাহায্য দেওয়ার পাশাপাশি ওই অঞ্চলে স্বচ্ছতা, সমর্থন ও জবাবদিহিতার একটি প্লাটফরম তৈরিতেও ভূমিকা রাখতে চায় তারা।

দেশে দেশে বিক্ষোভ : রাশিয়া, অস্ট্রেলিয়াসহ এশিয়ার বিভিন্ন স্থানে মুসলিমরা গতকাল বিক্ষোভে ফেটে পড়ে। মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর নৃশংস নির্যাতনের প্রতিবাদে তারা রাস্তায় নেমে আসে। এর মধ্যে সবচেয়ে বড় বিক্ষোভ হয়েছে রাশিয়ার চেচনিয়ায়। সেখানে প্রায় ১১ লাখ মানুষ রাজপথে বিক্ষোভ করেছে। চেচনিয়ার নেতা রমজান কাদিরভ মিয়ানমারে রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর নির্যাতনকে গণহত্যা বলে আখ্যায়িত করেছেন। এ সময় কাদিরভ রাশিয়া সরকারের কড়া সমালোচনা করেন। এ ক্ষেত্রে তিনি ক্রেমলিনকে বড় ধরনের হুমকি দেন। মিয়ানমারের হত্যাকাণ্ডকে তিনি তুলনা করেন হলোকাস্টের সঙ্গে। কাদিরভ র‍্যালির আগে এক ভিডিও বার্তায় বলেন, ‘যারা এসব অপরাধ করছে, সেই শয়তানদের যদি সমর্থন দেয় রাশিয়া তাহলে আমি রাশিয়ার বিরুদ্ধে অবস্থান নেব।’ ওদিকে বিক্ষোভ হয়েছে অস্ট্রেলিয়ার ক্যানবেরায়। সেখানে অস্ট্রেলিয়ার পার্লামেন্টের বাইরে বিক্ষোভ মিছিল করে বিপুলসংখ্যক মানুষ। ইন্দোনেশিয়ার রাজধানী জাকার্তায় বিক্ষোভকারীরা আগুনে পুড়িয়ে দেয় অং সান সু চির ছবি। সেখানে মিয়ানমার দূতাবাসে ছুড়ে মারে গ্যাসোলিন বোমা। বিক্ষোভ সমাবেশে ব্যানার বা পোস্টারে অং সান সু চির ছবিতে তার মুখে রক্ত মেখে বিকৃত করার কারণ ব্যাখ্যা করে ইন্দোনেশিয়ার বিক্ষোভের আয়োজক ফরিদা সাংবাদিকদের বলেন, ‘রোহিঙ্গা মুসলিমদের গণহত্যা করা হচ্ছে। ক্ষমতায় আসার আগে গণতন্ত্র ও মানবাধিকারের জন্য সবার কাছে সু চি ছিলেন শ্রদ্ধেয়। কিন্তু তার দেশে এখন যা ঘটছে তাতে তিনি নিশ্চুপ। বাকি বিশ্বও রয়েছে নীরব। তাই অবলীলায় বলা যায়, অং সান সু চি রক্তপান করছেন।’

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর