শিরোনাম
বুধবার, ৬ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

সীমান্তে গুলি, প্রতিদিনই প্রবেশ করছে রোহিঙ্গা

ফারুক তাহের, টেকনাফ ও উখিয়া সীমান্ত থেকে ফিরে

মানবিক বিপর্যয়ের আশঙ্কা

টেকনাফে তাঁবুর নিচে রোহিঙ্গাদের অবস্থান। বঙ্গোপসাগরে উদ্ধারকারী জাহাজ ফিনিক্স (ইনসেটে)

১২ দিন ধরে খোলা আকাশের নিচে থাকা রোহিঙ্গা শরণার্থীরা নানা রোগে আক্রান্ত হচ্ছে। পর্যাপ্ত খাবার ও পানীয় জল নেই তাদের। টেকনাফ, উখিয়া ও নাইক্ষ্যংছড়ির আশ্রয় কেন্দ্রে থাকা রোহিঙ্গারাও চরম মানবেতর অবস্থায় আছে। রেড ক্রিসেন্টসহ বিভিন্ন আন্তর্জাতিক সংস্থা তাদের খাদ্য সহায়তা দিলেও তা পর্যাপ্ত নয়। অনেকেই খাদ্যাভাবে অসুস্থ হয়ে পড়েছে। এদের বেশির ভাগই নারী, শিশু ও বৃদ্ধ।

টেকনাফ ও উখিয়ার শরণার্থী শিবিরগুলোয় নতুন আশ্রিত রোহিঙ্গারা তীব্র গরম, আবার কখনো বৃষ্টিতে খোলা আকাশের নিচে দুর্বিষহ জীবনযাপন করছে। যারা পলিথিন ও ত্রিপলের ছাউনি-বেড়া দিয়ে কোনোমতে মাথা গোঁজার ঠাঁই করে নিয়েছে, তারাও বিদ্যুিবহীন এই ঘরগুলোয় বসবাস করতে পারছে না। এর ওপর দেখা দিয়েছে সীমাহীন খাদ্য ও স্বাস্থ্য সংকট। পর্যাপ্ত খাদ্যের অভাবে নারী ও শিশুদের একটি বড় অংশ অপুষ্টিতে ভুগছে বলে জানিয়েছেন শিবিরে স্বাস্থ্য নিয়ে কাজ করা এনজিও কর্মকর্তারা। কক্সবাজারের উখিয়া উপজেলার কুতুপালং ও বালুখালী এবং টেকনাফের ল্যাদা ও মুছনী ক্যাম্পের রোহিঙ্গা বস্তি সরেজমিন ঘুরে দেখা গেছে, সহায়সম্পদ, আত্মীয়স্বজন হারিয়ে রোহিঙ্গারা কোনোরকমে বাঁচার আশায় আশ্রয় নিয়ে খেয়ে না খেয়ে আছে। নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য কয়েকটি এনজিও প্রথম দিকে ত্রাণসামগ্রী দিলেও নানা সমস্যার কথা বলে তারা চলে গেছে। এখন আশপাশের বিত্তশালী ও দূরদূরান্তের স্বেচ্ছাসেবীদের দেওয়া ত্রাণই ভরসা রোহিঙ্গাদের। বালুখালীসহ বিভিন্ন বনভূমিতে বসবাসরত নতুন আসা দেড় লক্ষাধিক রোহিঙ্গা খাদ্য সংকট ও তীব্র গরমে অসহনীয় জীবনযাপন করছে। কাজের সুযোগ না থাকায় এদের অধিকাংশই বেকার। উখিয়ার স্থানীয় রাজনৈতিক নেতা আলমগীর আলম মিনা বলেন, ‘শরণার্থীর অনুপ্রবেশ থামছে না। তবে এখন দেখা দিয়েছে খাদ্য সংকট। অপুষ্টিতে ভোগার কারণে অসুস্থ হয়ে পড়েছে অনেক রোহিঙ্গা নারী ও শিশু।’

তীব্র গরমের মধ্যে পলিথিনের ঝুপড়ি ঘরে গাদাগাদি করে বসবাস করছে ৭-১০ জনের একেকটি পরিবার। এমন একটি পরিবারের সদস্য আবদুর রহমান জানান, ‘দিনের বেলায় তাদের ঘরের ভিতরে যেন আগুন জ্বলছে। তাই তারা আশপাশের গাছ-গাছালির নিচে আশ্রয় নিয়ে থাকেন। কেউ কোনো কিছু দিলে তা খেয়েই তাদের জীবন চলছে।’

মিয়ানমারে দমন-পীড়ন ও চরম নির্যাতনের মুখে যেসব রোহিঙ্গা বাংলাদেশে পালিয়ে আসছে, কক্সবাজারের উখিয়ার বালুখালীতে বন বিভাগের ৫০ একর জমিতে তাদের থাকার ব্যবস্থা করছে জেলা প্রশাসন। কক্সবাজারের অতিরিক্ত জেলা ম্যাজিস্ট্রেট খালেদ মাহমুদ গতকাল সাংবাদিকদের বলেন, ‘গত বছর অক্টোবরে রাখাইনে সহিংসতার পর রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ শুরু হলে উখিয়ার বালুখালীতে বন বিভাগের ওই জমি বরাদ্দ দেওয়া হয়। গত বছর আসা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা সেখানে আছে। নতুন করে যারা আসছে, তাদেরও সেখানে আশ্রয়ের ব্যবস্থা করা হবে। অন্য কোথাও থাকলে তাদের উচ্ছেদ করা হবে।’ স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরা বলছেন, সীমান্তের বিভিন্ন পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা প্রতিদিনই আসছে। তারা যেভাবে পাহাড়ের যত্রতত্র আশ্রয় নিচ্ছে, তাতে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতির ওপর নেতিবাচক প্রভাব পড়তে পারে। প্রসঙ্গত, ২৪ আগস্ট মধ্যরাতের পর রোহিঙ্গাদের ওপর হেলিকপ্টার গানশিপের ব্যাপক ব্যবহার করে মিয়ানমারের সেনাবাহিনী। এতে মিয়ানমার সরকারের হিসাব অনুযায়ী চার শতাধিক রোহিঙ্গা মুসলিম নিহত হন। আহত শত শত রোহিঙ্গা নারী, পুরুষ ও শিশু বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। জাতিসংঘের শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনের (ইউএনএইচসিআর) সর্বশেষ হিসাব অনুযায়ী, মিয়ানমারে নির্যাতনের শিকার হয়ে ২৫ আগস্ট থেকে এখন পর্যন্ত বাংলাদেশে ১ লাখ ২৩ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে।

সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণ : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের ওপর নির্যাতন অব্যাহত আছে। গতকালও উখিয়ার বালুখালী ও তমব্রুর বাইশপারি সীমান্তে মাইন বিস্ফোরণ ঘটে। এতে দুই রোহিঙ্গা গুরুতর আহত হয় বলে জানা গেছে। এ ছাড়া সীমান্তের আরাকান রাজ্যের রোহিঙ্গা পাড়াগুলোয় দফায় দফায় আগুন ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী প্রত্যক্ষ করা গেছে বলে স্থানীয় সূত্রগুলো জানায়। এ বিষয়ে ঘুমধুম বিজিবি ৩৪ ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল মনজুরুল হাসান খান বলেন, ‘মাইন বিস্ফোরণের কথা আমরাও শুনেছি। তবে এটা মিয়ানমারের ভিতরেই ঘটেছে। তাই আমার কোনো মন্তব্য করা সমীচীন হবে না।’

রোহিঙ্গাদের ত্রাণবাহী মাইক্রোবাস খাদে : বান্দরবান সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য ত্রাণ নিয়ে যাওয়ার সময় একটি মাইক্রোবাস খাদে পড়ে যায়। এতে সাতজন আহত হয়েছেন। তাদের বান্দরবান সদর হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। গতকাল সকালে বান্দরবান-কেরানীহাট সড়কের রেইছা লম্বা রাস্তা এলাকায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। স্থানীয়রা জানান, জেলা শহরের মেম্বারপাড়া থেকে চারটি গাড়ি নিয়ে স্থানীয় যুবকরা সীমান্তে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের জন্য কোরবানির মাংসসহ বিভিন্ন ত্রাণসামগ্রী নিয়ে যাচ্ছিল।

৩১১৯ জন রোহিঙ্গাকে ফেরত : টেকনাফের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে আটকের পর ৩১১৯ জন রোহিঙ্গা নারী পুরুষকে ফেরত পাঠিয়েছে বিজিবি ও কোস্টগার্ড। গতকাল দুপুরে  বিজিবি-২ অধিনায়ক লে. কর্নেল এএসএম আরিফুল ইসলাম জানান, ২৪ ঘণ্টায় উপজেলার হোয়াইক্যং, হ্নীলা, সদর ও সাবরাং ইউনিয়নের বিভিন্ন সীমান্ত দিয়ে অনুপ্রবেশকালে ২৬৭৮ জন রোহিঙ্গাকে আটক করা হয়। পরে তাদের মানবিক সহায়তাপূর্বক স্বদেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে। অপরদিকে নাফ নদী হয়ে অনুপ্রবেশকালে  ৪৪১ জন রোহিঙ্গা নারী পুরুষকে আটকের পর মানবিক সহায়তা দিয়ে দেশে ফেরত পাঠানো হয়েছে বলে জানান টেকনাফ কোস্টগার্ডের স্টেশন কমান্ডার লে. জাফর ইমাম সজিব। এসব রোহিঙ্গার মধ্যে নারী ও শিশুর সংখ্যা বেশি।

 

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর