শিরোনাম
বৃহস্পতিবার, ৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

এত রোহিঙ্গা রাখব কোথায়

সাগরে নৌকাডুবি, আট লাশ উদ্ধার, গুলিবিদ্ধ চারজন চট্টগ্রাম মেডিকেলে, স্রোতের মতো আরও আসছে

ফারুক তাহের ও আয়ুবুল ইসলাম, কক্সবাজার, টেকনাফ ও উখিয়া ঘুরে

এত রোহিঙ্গা রাখব কোথায়

টেকনাফে ব্যক্তিগত উদ্যোগে গতকাল ত্রাণ বিতরণকালে রোহিঙ্গাদের মধ্যে কাড়াকাড়ি সৃষ্টি হয় —বাংলাদেশ প্রতিদিন

সীমান্তের বিভিন্ন স্থান দিয়ে বাংলাদেশে রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত আছে। দুই সপ্তাহ ধরে চলা রোহিঙ্গার স্রোত সীমান্ত এলাকা ছাড়িয়ে ছড়িয়ে পড়ছে কক্সবাজার, বান্দরবান ও চট্টগ্রাম জেলার গ্রামগঞ্জে। জাতিসংঘের তথ্যানুযায়ী, গত ১৩ দিনে সোয়া লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে আশ্রয় নিয়েছে। তবে প্রকৃত সংখ্যা দেড় লাখ ছাড়িয়ে গেছে বলে দাবি করেছেন স্থানীয় জনপ্রতিনিধিসহ বিভিন্ন বেসরকারি সংস্থার কর্মকর্তারা। স্রোতের মতো রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ অব্যাহত থাকায় কক্সবাজার ও এর আশপাশে স্থানসংকুলান হচ্ছে না। টেকনাফ-কক্সবাজার সড়কের বিভিন্ন স্থানে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বসে থাকতে দেখা গেছে। কেউ কেউ গাড়িতে উঠে কক্সবাজারের দিকে চলে যাচ্ছেন। সমুদ্র উপকূলের ‘কক্সবাজার-টেকনাফ’ মেরিন ড্রাইভ সড়কেও একই অবস্থা। রোহিঙ্গারা ইজিবাইক, জিপ ও অটোরিকশায় করে উখিয়া ও কক্সবাজারের দিকে ছুটছে। মিয়ানমার থেকে নৌপথে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশকালে গতকাল ভোরে রোহিঙ্গা শরণার্থী বহনকারী ১১টি নৌকা ডুবে যায়। বঙ্গোপসাগর ও নাফ নদের মোহনায় এ দুর্ঘটনা ঘটে। এরপর উদ্ধার অভিযান শুরু হলে দুপুর দেড়টা পর্যন্ত শিশুসহ আট রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়। আরও অর্ধশতাধিক রোহিঙ্গা নিখোঁজ রয়েছে বলে তাদের স্বজনরা জানিয়েছেন। জানা গেছে, নাফ নদের মোহনা অতিক্রম করার সময় নৌকা উল্টে যায়। প্রতিটি নৌকায় ধারণক্ষমতার বাইরে ২৫ থেকে ৩০ জন যাত্রী ছিল। টেকনাফ মডেল থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) মো. মাঈনুদ্দিন খান বলেন, ‘স্থানীয়দের কাছ থেকে রোহিঙ্গাদের ১১টি নৌকাডুবি হয়েছে বলে শুনেছি। ঘটনাস্থলে পুলিশ পাঠানো হয়েছে। এ পর্যন্ত আট রোহিঙ্গার লাশ উদ্ধার করা হয়েছে।’

 

 

মিয়ানমার সহিংসতায় গুলিবিদ্ধ আরও চার রোহিঙ্গাকে গতকাল চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। তারা হলেন মো. শফি, হাসিনা বেগম, জাফর আলম ও মো. ওসামা। তাদের প্রত্যেকের শরীরের পেছনের দিকে গুলি লেগেছে।

মঙ্গলবার গভীর রাত থেকে গতকাল বিকাল পর্যন্ত টেকনাফ, উখিয়া ও বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ি উপজেলার অন্তত ৪০টি সীমান্তপথ দিয়ে আরও ২০ হাজার রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ করেছে। সরেজমিন দেখা গেছে, বাংলাদেশে আসা রোহিঙ্গার উল্লেখযোগ্য একটি অংশ টেকনাফের ল্যাদা, মুছনী ও উখিয়ার কুতুপালং, বালুখালীসহ বিভিন্ন শিবিরে আশ্রয় নিলেও অনেকে গ্রামগঞ্জে ঢুকে পড়ছে। টেকনাফের নাইট্যংপাড়া, কোরনতলি, হ্নীলার দমদমিয়া, জাদিমোরা, ল্যাদা, আলীখালী, হোয়াইক্যং মিনাবাজার, কানজরপাড়া, বান্দরবানের নাইক্ষ্যংছড়ির ঘুমধুম, জলপাইতলী, তমব্রু আজোহাইয়াসহ বেশ কয়েকটি গ্রামের বিভিন্ন বাড়ির আঙিনায় দিশাহারা রোহিঙ্গাদের আশ্রয় নিতে দেখা গেছে। সীমান্ত পার হওয়ার সময় গত কয়েক দিন তাদের তেমন কোনো বাধার মুখে পড়তে দেখা যায়নি। তবে অধিকাংশ রোহিঙ্গা শরণার্থী উখিয়ার কুতুপালং ও বালুখালীর ১২ থেকে ১৫টি পাহাড়ে তাঁবু ও বাঁশ-পলিথিনের কুড়েঘর নির্মাণ করে আশ্রয় নিয়েছে। গতকাল দিনভর এসব পাহাড়ে ছোট ছোট ঘর তৈরি করে তাদের নতুন ঠিকানা গড়তে দেখা গেছে। সরকারের পক্ষ থেকে নতুন করে আসা রোহিঙ্গাদের জন্য বালুখালী পাহাড়ের ৫০ একর জায়গা ছেড়ে দেওয়া হয়েছে। অনেকেই সেখানে আশ্রয়স্থল তৈরি শুরু করেছে। বিচ্ছিন্নভাবে কেউ বসবাস করলে তাদের আটক করা হবে বলে জানানো হয়েছে। টেকনাফ ও উখিয়ার ইউপি চেয়ারম্যান এবং উপজেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে মাইকিং করে রোহিঙ্গাদের উখিয়া ও টেকনাফের বিভিন্ন ‘রোহিঙ্গা শিবিরে’ পৌঁছে দেওয়ার জন্য জনগণকে অনুরোধ জানানো হচ্ছে।

রাখাইন রাজ্যে গুলির শব্দ ও আগুনের শিখা : সীমান্তের ওপারে গতকাল সকাল থেকে দফায় দফায় গুলির শব্দ শোনা গেছে। রোহিঙ্গাপাড়া জ্বালিয়ে দেওয়ায় বেশ কয়েকটি স্থানে আগুনের শিখা ও ধোঁয়ার কুণ্ডলী দেখা গেছে। আন্তর্জাতিক বিভিন্ন মহল থেকে চাপ থাকলেও থামছে না রোহিঙ্গা নির্যাতন। মিয়ানমারের বর্ডার গার্ড পুলিশ (বিজিপি) ও সেনাবাহিনী রোহিঙ্গা সংখ্যালঘুদের ওপর তাদের অত্যাচার-নির্যাতন অব্যাহত রেখেছে বলে জানা গেছে।

 

 

আড়াই হাজার রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক : গতকাল সাগরপথ ও স্থলসীমান্তের কয়েকটি পয়েন্ট দিয়ে অনুপ্রবেশকালে প্রায় আড়াই হাজার রোহিঙ্গাকে পুশব্যাক করেছে বিজিবি। টেকনাফ ২ বিজিবি ব্যাটালিয়নের অধিনায়ক লে. কর্নেল এস এম আরিফুল ইসলাম জানান, গতকাল অনুপ্রবেশের সময় ২ হাজারেরও বেশি রোহিঙ্গাকে প্রতিরোধ করা হয়েছে এবং তাদের পুনরায় মিয়ানমারে ফেরত পাঠানো হয়েছে। রোহিঙ্গা অনুপ্রবেশ ঠেকাতে বিজিবি সাধ্যমতো চেষ্টা চালাচ্ছে। কিন্তু রাতের আঁধারে তারা ঢুকে পড়ছে বলে জানান তিনি।

শাহপরীর দ্বীপে হাজার হাজার রোহিঙ্গা : গতকাল টেকনাফের শাহপরীর দ্বীপে হাজার হাজার রোহিঙ্গাকে বেড়িবাঁধের ওপর দেখা গেছে। নৌকায় নাফ নদ ও বঙ্গোপসাগর পাড়ি দিয়ে আসা এসব রোহিঙ্গার চোখে-মুখে অনাহার ও আতঙ্কের ছাপ লক্ষ্য করা গেছে। শাহপরীর দ্বীপ ইউপি সদস্য নুরুল আমিন বলেন, ‘গতকাল এক দিনেই শাহপরীর দ্বীপে ঢুকেছে প্রায় সাত হাজার রোহিঙ্গা। মানবিক কারণে তাদের কেউ আর বাধা দিচ্ছে না।’ শাহপরীর দ্বীপ ছাড়াও খুরেরমুখ, সাবরাং, মহেশখালিয়া পাড়া, নাইটংপাড়া, বাহারছড়া, বড়ডেইল, শাপলাপুর উপকূল দিয়ে ঢুকেছে এসব রোহিঙ্গা। জানা গেছে, নৌকা দিয়ে রোহিঙ্গা পারাপার বন্ধ করতে গতকাল সাবরাং, টেকনাফ ও বাহারছড়া ইউনিয়ন পরিষদ কার্যালয়ে জেলে ও নৌকার মালিকদের নিয়ে পৃথক তিনটি সভা করেছে উপজেলা প্রশাসন। এ সময় নৌকার মালিক ও জেলেদের রোহিঙ্গা পারাপার বন্ধ রাখার নির্দেশ দিয়ে তাদের সতর্ক করা হয়।

চট্টগ্রাম মেডিকেলে ভর্তি ৪৯ রোহিঙ্গা : চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের বার্ন ইউনিট, ক্যাজুয়ালিটি ও বিভিন্ন ওয়ার্ডে চিকিৎসাধীন রয়েছে ৪৯ জন নির্যাতিত রোহিঙ্গা শরণার্থী। এ পর্যন্ত মোট ৫৪ রোহিঙ্গা চিকিৎসা নিতে ভর্তি হলেও গুলিবিদ্ধ দুজন মারা যান। আরও তিনজন চিকিৎসা নিয়ে চলে গেছেন। এ ছাড়া টেকনাফ, কক্সবাজার ও উখিয়া স্বাস্থ্য কমপ্লেক্সে আরও শতাধিক রোহিঙ্গা চিকিৎসাধীন রয়েছে বলে সংশ্লিষ্ট সূত্রে জানা গেছে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর