সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

চোখে পড়ে শুধু গুলি আর আগুন

হেলিকপ্টার থেকে দাহ্য পদার্থ ফেলছে মিয়ানমার সেনারা, মাইন বিস্ফোরণে নিহত ৩, অস্ত্রবিরতি আরসার, বৃষ্টি উপেক্ষা করে মানুষের ঢল, রাস্তার দুই পাশে অবস্থান, ত্রাণে সমন্বয়হীনতা, হুমকিতে স্বাস্থ্যসেবা, রোহিঙ্গা সেল গঠন

মাহমুদ আজহার, উখিয়া ও টেকনাফ (কক্সবাজার) ঘুরে

চোখে পড়ে শুধু গুলি আর আগুন

উখিয়া পালংখালীতে গতকাল খোলা আকাশের নিচে রোহিঙ্গাদের অবস্থান —রোহেত রাজীব

জরিনা খাতুন নামে ৭৫ বছর বয়সী এক বয়োবৃদ্ধ নারী বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন মিয়ানমানের বুরাইঙ্গাপাড়া থেকে। লাম্বা বিল পাড়ি দিয়ে বৃষ্টিতে ভেজা কর্দমাক্ত শরীর নিয়ে পাঁচ দিনে তিনি গতকাল এসে বাংলাদেশে পৌঁছান। পড়শি একজনের সহায়তায় অনেক কষ্টে আসেন। নিজের চোখের সামনে বার্মিজ আর্মিদের গুলিতে স্বামী কালা মিয়ার নিথর দেহ পড়ে থাকতে দেখেন তিনি। এ ছাড়া নাতনি সাইমন ইসলামকে মিয়ানমারের মিলিটারিকে আছড়ে মেরে হত্যা করতে দেখেন চোখের সামনে। গতকাল বেলা ১টায় লাম্বা বিলে এসে বাংলাদেশ প্রতিদিনকে কান্নাজড়িত কণ্ঠে তিনি বলেন, ‘আঁর নাতি-পুতি-জামাই মারি ফেলাইয়্যে। পোয়া ও মাইয়া কডে আছে ন জানি। আই এহন কেন গইজ্জুম, মনরে বুঝাই ন পারির।’ জরিনা খাতুন জানান, তার চোখের সামনে ৩০ জনকে গুলি করে হত্যা করতে দেখেছেন। বুরাইঙ্গা গ্রাম জ্বালানোর পর কোনোমতে পালিয়ে আসেন তিনি। শুধু জরিনা খাতুনই নন, তার মতো আরও অনেকেই হারিয়েছেন স্বামী ও পরিবারের অন্য সদস্যদের। বার্মিজ আর্মি ছাড়াও বিজিপি, নাসাকা বাহিনী ও উগ্র বৌদ্ধরা এ হত্যাযজ্ঞ চালাচ্ছে। নাফ নদের ওপারে এখনো জ্বলছে গ্রামের পর গ্রাম। প্রাণভয়ে টেকনাফের লাম্বা বিল, উখিয়ার আঞ্জুমানপাড়াসহ অনেকেই সমুদ্রপথ পাড়ি দিয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছেন। দীর্ঘ পথ পাড়ি দিয়ে মিয়ানমার থেকে যারা ফিরছেন, তাদের অনেকেই গুলিবিদ্ধ, ক্ষুধার্ত ও জীর্ণশীর্ণ চেহারায় বাংলাদেশের ক্যাম্পগুলোতে অবস্থান নিয়েছেন। বিভিন্ন সীমান্ত এলাকায় গতকালও গুলির শব্দ শোনা যায়। এদিকে গতকালও বিচ্ছিন্নভাবে

ত্রাণ বিতরণ করতে আসে বিভিন্ন ব্যক্তি ও বেসরকারি সংস্থা। কক্সবাজার জেলা প্রশাসনের পক্ষ থেকে বিচ্ছিন্নভাবে ত্রাণ না দেওয়ার অনুরোধ জানালেও অনেকেই শুকনো খাবার ও পোশাক বিতরণ করেন। উখিয়া ও টেকনাফ সীমান্তের লেদা মুছুনি নয়াপাড়া, থাইনখালী, বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে ব্যক্তিগতভাবে অনেকেই টাকা-পয়সাও বিতরণ করেন। কেউ কেউ সীমান্ত এলাকায় গিয়েও নতুন আসা রোহিঙ্গাদের হাতে টাকা তুলে দেন। ফ্রি মেডিকেল ক্যাম্পও বসিয়েছেন অনেকেই। পুলিশ, র‌্যাব ও বিজিবিকেও তত্পরতা চালাতে দেখা যায়। তবে রাস্তার দুই ধারে আশ্রয় নেওয়া অন্তত লাখো রোহিঙ্গার স্বাস্থ্যসেবা চরম হুমকিতে পড়েছে। প্রাকৃতিক কাজ সারা কিংবা ঠিকমতো গোসলও করতে পারছেন না তারা। ঘুমানোর জায়গাটুকুও নেই তাদের। খোলা আকাশের নিচে বৃষ্টিতেও রাত কাটাতে হচ্ছে তাদের।

গতকাল টেকনাফের লাম্বা বিল সীমান্তের বিপরীতে মিয়ানমারের নাইছাদং, পোয়াখালী, বলিবাজার, শিকদারপাড়া গ্রামে দিনভর আগুনের কুুণ্ডলী লক্ষ্য করা যায়। ধোঁয়ায় ছেয়ে যায় আশপাশের এলাকা। উখিয়ার পালংখালীর আঞ্জুমানপাড়ার বিপরীতে মিয়ানমারের পোয়াংদিবন টমবাজার এলাকায়ও দিনভর আগুন জ্বলতে দেখা যায়। এসব এলাকায় মিয়ানমারের সেনাবাহিনী হেলিকপ্টারে টহল দিয়ে দাহ্য পদার্থ নিক্ষেপ করে। ওই এলাকাগুলোতে বসবাস করা কয়েক হাজার রোহিঙ্গা গতকালও বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করে। তারা সীমান্তের লাম্বা বিলের পাশে লেদা মুছুনি নয়াপাড়া, থাইনখালী, বালুখালী ও কুতুপালং ক্যাম্পে আশ্রয় নেয়। এর মধ্যে অনেকেই পরিবারের সব সদস্যকে হারিয়ে একাই চলে আসেন। কোনো কোনো নারীকে দেখা যায় কোলের সন্তানকে নিয়ে একাই ফিরে আসতে।

সরেজমিন টেকনাফের লাম্বা বিল এলাকা ঘুরে দেখা যায়, নাফ নদের ওপার থেকে নারী, শিশুসহ বয়োবৃদ্ধরা দল বেঁধে লাম্বা বিল হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করছে। নূরহাজান নামে ৩৫ বছর বয়সী এক নারী শিশুসন্তানকে সঙ্গে নিয়ে লাম্বা বিল হয়ে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশ করেন। মিয়ানমারের হাতিপাড়া গ্রাম থেকে ছয় দিনে লাম্বা বিলে আসেন তিনি। তিনি জানান, তার সামনে তিনজন তরুণী ধর্ষণের শিকার হয়েছে। বাচ্চাসহ কোনোমতে পালিয়ে আসতে সক্ষম হয়েছেন তিনি। ওই গ্রামের রহিমা নামে আরেকজন জানান, তাদের বাড়িঘর জ্বালিয়ে দিয়েছে। গরু-ছাগল, টাকা-পয়সা, বাড়িতে থাকা স্বর্ণালঙ্কারসহ সবকিছুই বার্মিজ আর্মিরা নিয়ে গেছে।

লাম্বা বিল দিয়ে আসা একাধিক রোহিঙ্গা পুরুষ জানান, মিয়ানমারে উগ্র বৌদ্ধরা মুসলিম বেশ ধারণ করে সবাইকে মসজিদে যাওয়ার আহ্বান জানাচ্ছে। কোনো কিছু না বুঝেই মুসলিমরা যখন দল বেঁধে মসজিদে যাচ্ছেন, তারা বার্মিজ আর্মিকে খবর দিচ্ছে। এরপর চারপাশে জড়ো হয়ে ওই মসজিদের সব রোহিঙ্গা মুসলিমকে গুলি করে মারছে। কোনো কোনো মসজিদের চারপাশে কেরোসিন ও পেট্রল দিয়ে আগুন ধরিয়ে দিচ্ছে তারা।

এদিকে বাংলাদেশের বিভিন্ন ক্যাম্প ঘুরে দেখা গেছে, মানবেতর জীবন-যাপন করছেন রোহিঙ্গা শরণার্থীরা। কয়েক দিনে আসা পাঁচ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গার বড় অংশই এখনো খোলা আকাশের নিচে অবস্থান করছেন। তাদের কাছে খাবার বা অন্যান্য সামগ্রী ঠিকমতো পৌঁছাচ্ছে না। আবার সরকারের পক্ষ থেকে বন বিভাগের জমিও দেওয়া হয়েছে তাঁবু খাটাতে। সেখানেও একটি প্রভাবশালী অংশ ক্যাম্প ভাড়া দিয়ে আশ্রয় দিচ্ছে বলে অভিযোগ উঠেছে। এদিকে বেসরকারিভাবে কাউকে ত্রাণ নিয়ে আসতে দেখলেই রাস্তায় উপচে পড়া ভিড় লক্ষ্য করা যায় রোহিঙ্গাদের। ত্রাণ বিতরণের সময় হুমড়ি খেয়ে পড়ছেন তারা।

স্থলমাইন বিস্ফোরণে তিন রোহিঙ্গা নিহত : বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তের জিরো পয়েন্টে পুঁতে রাখা স্থলমাইন বিস্ফোরণে তিন রোহিঙ্গা নিহত হয়েছেন। এ ছাড়া একজন গুরুতর আহত হওয়ার খবর পাওয়া গেছে। সীমান্তের রেজু আমতলী ও তুমব্রু এলাকায় হতাহতের এ ঘটনা ঘটে। ঘুমধুম ইউপি চেয়ারম্যান জাহাঙ্গীর আজিজ ও রেজু আমতলী এলাকার সাবেক ইউপি সদস্য ফরিদ আলম জানান, রেজু আমতলী সীমান্তের জিরো লাইনের কাছে স্থলমাইন বিস্ফোরণে তিন রোহিঙ্গা নিহত ও একজন আহত হন। সীমান্ত অতিক্রম করে বাংলাদেশে অনুপ্রবেশের চেষ্টাকালে হতাহতের এ ঘটনা ঘটে। আহত আবদুল করিমকে চিকিৎসার জন্য উখিয়া হাসপাতালে নেওয়া হলেও লাশগুলো ওপারের জিরো লাইনেই পড়ে রয়েছে।

তারা জানান, গতকাল ভোরে তুমব্রুর বাংলাদেশ-মিয়ানমার ৩৭-৩৮ নম্বর পিলারের মধ্যবর্তী স্থানে স্থলমাইন বিস্ফোরণের অন্য ঘটনাটি ঘটে। এ সময় ঘুমধুমের বাইশফাঁড়ি এলাকার বাসিন্দা আবুল খায়েরের ছেলে মো. হাসান (৩২) আহত হন। ভোরে ঘুমধুমের তুমব্রু সীমান্ত দিয়ে গরু আনতে গেলে মিয়ানমার সেনাবাহিনীর পুঁতে রাখা স্থলমাইন বিস্ফোরণে হাসানের একটি পা উড়ে যায় এবং চোখেও আঘাত লাগে। এ সময় আতাউল্লাহ নামে অপর এক রোহিঙ্গা যুবক আহত হন। পরে স্থানীয়রা মুমূর্ষু অবস্থায় তাদের উদ্ধার করেন। বর্তমানে তারা উখিয়া কুতুপালং এমএসএফ হাসপাতালে চিকিৎসাধীন। এর আগেও সীমান্তে স্থলমাইন বিস্ফোরণে বেশ কয়েকজন রোহিঙ্গা মুসলিম নারী-পুরুষ হতাহত হয়েছিলেন। মিয়ানমারের সেনাবাহিনী বাংলাদেশ-মিয়ানমার নো ম্যানস ল্যান্ডের কয়েকশ গজের মধ্যে নতুন করে স্থলমাইন পুঁতেছে। বিশেষ করে সীমান্তের যেসব পয়েন্ট দিয়ে রোহিঙ্গারা বাংলাদেশে আসছেন সেসব পয়েন্টে বিপুলসংখ্যক মাইন পুঁতে রাখছে তারা, যাতে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গারা মিয়ানমারে অনুপ্রবেশ করতে না পারে।

বিদ্রোহীদের অস্ত্রবিরতির প্রস্তাব প্রত্যাখ্যান : রোহিঙ্গা বিদ্রোহীরা রাখাইনে অস্ত্রবিরতির যে প্রস্তাব দিয়েছে তা প্রত্যাখ্যান করেছে মিয়ানমার সরকার। যাদের হামলার প্রতিক্রিয়ায় রাখাইনে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর ওপর সেনাবাহিনীর দমন অভিযান চলছে, সেই আরাকান রোহিঙ্গা স্যালভেশন আর্মি (এআরএসএ) রবিবার থেকে এক মাস অস্ত্রবিরতির ঘোষণা দিয়েছে। রাখাইনে সৃষ্ট মানবিক সংকট থেকে উত্তরণে ত্রাণ সহায়তাকারী সংস্থাগুলোকে কাজ করার সুযোগ দিতে মিয়ানমারের সেনাবাহিনীর প্রতি অস্ত্র রাখার আহ্বান জানিয়েছে ওই বিদ্রোহী গোষ্ঠী। এআরএসএ’র এই আহ্বানের জবাবে মিয়ানমার সরকারের মুখপাত্র জ তাই বলেছেন, সন্ত্রাসীদের সঙ্গে কোনো সমঝোতা করবেন না তারা।

আওয়ামী লীগের ত্রাণ বিতরণ : মিয়ানমারে সহিংসতা-পরবর্তী জীবনের ঝুঁকি নিয়ে বাংলাদেশে পালিয়ে আশ্রয় নেওয়া রোহিঙ্গাদের সার্বিক অবস্থা দেখতে গতকাল বিকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা বস্তি পরিদর্শন করে আওয়ামী লীগের একটি সাংগঠনিক টিম।

রোহিঙ্গা সেল গঠন : ১০টি কর্মপরিধি নির্ধারণ করে রোহিঙ্গা সেল গঠন করেছে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ। গতকাল জননিরাপত্তা বিভাগের রাজনৈতিক শাখা-১-এর উপসচিব আবু হেনা মোস্তাফা কামাল স্বাক্ষরিত এক বিজ্ঞপ্তিতে সেল গঠনের বিষয়টি নিশ্চিত করা হয়।

বিজ্ঞপ্তিতে জানানো হয়েছে, মিয়ানমারের অভ্যন্তরে চলমান সহিংসতা ও উদ্ভূত পরিস্থিতিতে সীমান্তের ওপার থেকে বাংলাদেশ ভূখণ্ডে রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীর অনুপ্রবেশের কারণে কক্সবাজার ও বান্দরবান জেলাসহ সন্নিহিত সীমান্তবর্তী এলাকার সার্বিক পরিস্থিতি ও আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ নিবিড়ভাবে পর্যবেক্ষণসহ বিভিন্ন সংস্থার কার্যক্রমের মধ্যে সমন্বয় সাধনের সুবিধার্থে স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জননিরাপত্তা বিভাগ রোহিঙ্গা সেল গঠন করেছে।

‘মিয়ানমার সরকারের বিচার হওয়া উচিত’ : মিয়ানমারে রোহিঙ্গাদের গণহত্যা চালানোর দায়ে মিয়ানমার সরকারের আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালে বিচার হওয়া উচিত বলে মন্তব্য করেছেন জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হক। গতকাল সকালে কুতুপালং রোহিঙ্গা ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে তিনি এ মন্তব্য করেন। তিনি বলেন, ‘মিয়ানমার যা করছে, সেটি গণহত্যার শামিল। ১৯৭১ সালের স্বাধীনতাযুদ্ধে যা ঘটেছিল, মিয়ানমারের আরাকানে অনুরূপ ঘটনাই ঘটেছে। রোহিঙ্গাদের সঙ্গে কথা বলে আমরা এ তথ্যই পেয়েছি।’ মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বলেন, ওপারে নির্যাতন থেকে প্রাণে বাঁচতে বাংলাদেশে আশ্রয় নেওয়াটাই রোহিঙ্গা সমস্যার মূল সমাধান নয়। পরিস্থিতি শান্ত হলে তাদের পুনরায় নিজ দেশে ফিরে যেতে হবে। প্রাণভয়ে পালিয়ে আসা রোহিঙ্গাদের ফিরিয়ে নিতে আন্তর্জাতিকভাবে মিয়ানমারকে চাপ দেওয়ার আহ্বান জানান তিনি। এর আগে সকাল সাড়ে ৯টায় টেকনাফের কুতুপালংয়ে রোহিঙ্গা ক্যাম্পে পৌঁছান মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান। সেখানে ক্যাম্প পরিদর্শন শেষে উখিয়ার বালুখালী রোহিঙ্গা ক্যাম্পে যান। সঙ্গে জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের উচ্চ পর্যায়ের কর্মকর্তারা ছিলেন।

# রিপোর্ট তৈরিতে সহায়তা করেছেন কক্সবাজার প্রতিনিধি আয়ুবুল ইসলাম ও উখিয়া প্রতিনিধি শফিক আজাদ।

সর্বশেষ খবর