সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১১

মিস গাইডেড গার্ল

মির্জা মেহেদী তমাল

মিস গাইডেড গার্ল

১৯৯২ সাল। ঢাকা (বর্তমানে শাহজালাল) আন্তর্জাতিক বিমানবন্দর। রাতে ফ্লাইট কম থাকায় যাত্রীদের চাপ কম। শুধু লন্ডনগামী যাত্রীদের লম্বা লাইন। বোর্ডিং কার্ড নিচ্ছেন। লাইনের পেছনের দিকে দাঁড়ানো মার্কিন এক তরুণী। হাতে পাসপোর্ট। কাঁধে ভ্যানিটি ব্যাগ। কোমর পর্যন্ত ঝোলানো। শীতাতপ নিয়ন্ত্রণের মধ্যেও তিনি ঘামছেন। টিস্যু দিয়ে কপাল, মুখ মুছছেন। বার বার লাইন ছেড়ে বেরিয়ে যাচ্ছেন। সামনের দিকে উঁকিঝুঁকি দিচ্ছেন। অস্থির। তার চোখ যাচ্ছে বার বার কাস্টমস কর্মকর্তা আর কাচ ঘেরা তাদের রুমের দিকে। সেখানে যাত্রীদের ব্যাগ তল্লাশি চলছে। সন্দেহ হলেই গোপন কক্ষে নিয়ে যাত্রীর পুরো শরীর। লাইন সামনের দিকে এগোচ্ছে। কিন্তু তিনি এগোচ্ছেন না। লাইন থেকে তিনি হঠাৎ বেরিয়ে গেলেন। ইতস্তত করছেন। টয়লেটের দিকে পা বাড়ালেন। তার চোখে মুখে ভয়ের ছাপ। টয়লেটে আয়নার সামনে দাঁড়ালেন। চোখে মুখে পানির ঝাপটা দেন। কী করবেন তিনি! শরীরে বেঁধে রাখা জিনিসগুলো ফেলে দিবে? সেই ভালো। নতুবা নির্ঘাত আজ ধরা পড়তে হবে তাকে। শরীরে বাঁধা জিনিসগুলো সরিয়ে ফেলার চেষ্টা চালায়। কিন্তু তার হাত এমনভাবে কাঁপছিল, সেগুলো খুলতেই পারছেন না। চেষ্টা করতে করতেই বেশ খানিকটা সময় চলে গেছে। ইতিমধ্যে টয়লেটে আরও লোকজনের আনাগোনা। সেই কাজটি তার হলো না। তিনি নিশ্চিত, টয়লেট থেকে বেরনোর পরই তার দেহ তল্লাশি করা হবে। ভয়ে ভয়ে টয়লেট থেকে বেরিয়ে আসেন। কাস্টমস কর্মকর্তারা তখন একজন যাত্রীর ব্যাগ-দেহ তল্লাশি করছেন। তার দিকে নজর নেই। এইতো সুযোগ! বুকে ধুক ধুক নিয়েই তিনি কাস্টমস এলাকা অতিক্রম করতে শুরু করেন। এগিয়ে যাচ্ছেন। কিন্তু দু-পা তার ভীষণ ভারী লাগছে। স্বাভাবিকভাবে হাঁটতে পারছেন না। কিছুটা হেলেদুলে হাঁটছেন। শরীর থেকে তার নিচের দিকে তাকে বেখাপ্পা লাগছে দেখতে। এরপরেও হাঁটছেন। পেছনে তাকাচ্ছেন না। কোনো কণ্ঠ শুনলেই মনে হচ্ছিল তাকে বুঝি পেছন থেকে ডাকছেন কেউ। নাহ! কেউ ডাকছেন না তাকে। মনে মনে নিজেকে ধন্যবাদ দিচ্ছেন। ভয়ের বাধা অতিক্রম করে ফেলেছেন তিনি। এখন শুধু সিঁড়ি বেয়ে নিচে নামলেই চলবে। রানওয়েতে গাড়ি আছে। সেটাতে উঠেই হিথ্রোগামী উড়োজাহাজের দরজার কাছে চলে যাবে। তাকে আর পায় কে! সিঁড়ি বেয়ে নামছেন তিনি। একটু মোড় ঘুরে আবারও নিচের দিকে। হ্যালো! মহিলার কণ্ঠ। তরুণীটি ভাবছেন, তিনি ভুল শুনেছেন। তিনি সেটা কানে না নিয়ে চলতে শুরু করলেন। হ্যালো মিস! এবার একটু জোরেই ডাকা হলো পেছন থেকে। এবার থামলেন। পেছনে তাকাতেই দেখেন কাস্টমস কর্মকতা তাকেই ডাকছেন। ইশারায় তাকে উপড়ে উঠে আসতে বললেন। তিনি মাথা নিচু করে উপরে উঠলেন। দর দর করে ঘামছেন। মহিলা কর্মকর্তা তাকে নিয়ে গেলেন গোপন কক্ষে। দেহ তল্লাশি হবে। তল্লাশি চালাতেই কাস্টমস কর্মকর্তার চোখ কপালে। দুরানে স্কচ টেপ দিয়ে মোড়ানো বেশ কয়েকটি প্যাকেট। রান থেকে খুলে পরীক্ষা করে দেখা যায় সেগুলো হেরোইন। সাড়ে তিন কেজি। গ্রেফতার হলেন সেই অষ্টাদশী তরুণী। তার দুপা অস্বাভাবিক মোটা দেখানোর কারণেই কাস্টমস কর্মকর্তারা ধরে ফেলেন এই তরুণীকে।

২৫ বছর আগে এভাবেই শরীরের সঙ্গে সাড়ে দিন কেজি হেরোইন বেঁধে দেশত্যাগের চেষ্টা করেছিলেন নিষ্পাপ চেহারার মার্কিন নাগরিক অষ্টাদশী এলিয়েদা মেকর্ড লিয়া। অল্পের জন্য তিনি ধরা পড়ে যান। এ ঘটনাটি দেশে-বিদেশে তোলপাড় হয়। বিচারে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড হয় এলিয়েদার। তিনি ছিলেন প্রথম কোনো মার্কিন নাগরিক, যাকে মাদক পাচারের অভিযোগে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হয়।

দ্রুততম সময়ের মধ্যে এই মামলার বিচার কার্জ শেষ হয়। ১৯৯৩ সালের ৮ জুলাই এই মামলার বিচারের রায় ঘোষণা করে আদালত। বিশেষ ট্রাইব্যুনালের বিচারক আনসারউদ্দিন শিকদার তার রায়ে বলেন, এলিয়েদা মেকর্ড লিয়া পেশাদার মাদক পাচারকারী নয়। সে ঘটনার শিকার মাত্র। ‘মিসগাইডেড গার্ল’ আখ্যায়িত করে বিচারক বলেন, তার বয়স, ব্যবহার, শিক্ষার বিষয়গুলো বিবেচনায় এনে তাকে মৃত্যুদণ্ডে দণ্ডিত না করে যাবজ্জীবন কারাদণ্ডে দণ্ডিত করা হলো। তবে তাকে যাবজ্জীবন কারাদণ্ড ভোগ করতে হয়নি।

মার্কিন এই তরুণীর একসময় দুনিয়া ছিল ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগার। কারাগারের পাথর দেয়ালের মাঝে থেকে সেই এলিয়েদা স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন। স্বপ্ন দেখতেন এই বন্দীশিবির থেকে তাকে কেউ একদিন মুক্ত করে নিয়ে যাবে। এলিয়েদার সেই স্বপ্ন বেশিদিন স্বপ্ন থাকেনি। তার স্বপ্ন বাস্তবে রূপ নিয়েছিল। এক সকালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের সিনেটর বিল রিচার্ডসন তার মুক্তির ফরমান নিয়ে হাজির ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে। সেই জেলখানা থেকে তাকে সোজা বিমানবন্দর। লন্ডনগামী ফ্লাইটে চড়ে হিথ্রো বিমানবন্দর। সেখান থেকে ওয়াশিংটন ডিসি। ওয়াশিংটন থেকে টেক্সাস ডুলে বিমানবন্দর। নিজের বাসা। মাত্র ৭২ ঘণ্টার মধ্যেই ঢাকা জেল থেকে উড়ে একদম নিজভূম টেক্সাস।

কারা সূত্র জানায়, সাড়ে চার বছর কারাগারে বন্দী থাকার সময় বাংলা ভাষা শিখেছেন এলিয়েদা। তিনি বাচ্চাদের সঙ্গে খেলতেন, নাচতেন ও গাইতেন। সবার প্রিয় হয়ে উঠেছিলেন মার্কিন এই সুন্দরী তরুণী। এ ছাড়া ধর্মীয় আলোচনাও করতেন খুব। বিশেষ করে তার খ্রিস্টান ধর্মের কথাই তিনি প্রত্যেককে বলতেন।

কারাগারের এক কর্মকর্তা জানান, এলিয়েদার প্রেমে পড়েছিলেন অসংখ্য তরুণ। যারা প্রায়ই জেলগেটে এসে দেখা করতেন। এলিয়েদার চলে যাওয়াটা এতটাই আকস্মিক ছিল যে, কেউই জানত না। চলে যাওয়ার পর অনেকেই জেলগেটে এসেছিলেন। কয়েকজনকে কাঁদতেও দেখা গেছে।

এলিয়েদা যেভাবে পাচারে

এলিয়েদা মেকর্ড। মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের টেক্সাসের হস্টনে তার বাবা মায়ের সঙ্গে থাকতেন। ১৮ বছর বয়সে তিনি বাসা ত্যাগ করেন। তার বন্ধু কিন্ডির সঙ্গে একটি এপার্টমেন্টে ওঠেন। কয়েক মাস পরই লিয়া অর্থকষ্টে পড়েন। বিশেষ করে তার বন্ধু যখন ইউরোপ সফরে যান সেই সময়ে লিয়ার অর্থনৈতিক অবস্থা বেশি খারাপ। বন্ধু কিন্ডি কিছুদিন পর ফিরে আসেন। লিয়াকে সে বলে, একটি গোপনীয় ব্যবসা করছে সে। আর এ জন্য ১০ হাজার ডলার সে পেয়েছে। ব্যবসার ধরন জানতে লিয়া চাপাচাপি করতে থাকে। এক পর্যায়ে কিন্ডি তাকে জানায়, ডায়মন্ড পাচার করে ১০ হাজার ডলার কামিয়েছে। কিন্ডি এ সময় লিয়াকে এই কাজে জড়িত হওয়ার পরামর্শ দেয়। লিয়া বিভিন্নভাবে খবর নিয়ে জানতে পারে, ডায়মন্ড নয়, তার বন্ধু মাদক পাচারের সঙ্গে জড়িত। আর এই পাচারের কাজে সে জড়িত হতে চাইলে তাকে বাংলাদেশে যেতে হবে। সেখান থেকে হেরোইন নিয়ে আসতে হবে। এ বিষয়টি জানতে পেরে তার বন্ধুকে সাফ জানিয়ে দেয়, সে পারবে না এ কাজ করতে। কারণ তার এক বন্ধু নেশা করে মারা গেছে। এ সময় তার বন্ধু কিন্ডি এবং পাচারকারী দলের একজন লিয়াকে বোঝানোর চেষ্টা করে। তাকে মনে করিয়ে দেয়, তার অর্থকষ্টের কথা। স্কুল খরচ থেকে শুরু করে পরিবারকে সাহায্য করার কথা। এক পর্যায়ে কিন্ডি তাকে আরও জানায়, এই মাদক আমেরিকায় নিয়ে আসতে হবে না। সুইজারল্যান্ডে নিয়ে যেতে হবে। সুইজারল্যান্ডে এই মাদক নিষিদ্ধ নয় বলে লিয়াকে তারা বোঝাতে থাকে। লিয়াকে এ সময় তারা ১০ হাজারের পরিবর্তে ২০ হাজার ডলার দেওয়ার লোভ দেখায়। লিয়া নিজেকে আর ঠিক রাখতে পারেনি। রাজি হয়ে যায়। লিয়া তার মা সিলভিয়াকে বিষয়টি জানায়। তার মা তাকে এ কাজে না জড়াতে অনুরোধ করেন। লিয়াকে বলেন, দেশের বাইরে যাওয়া চলবে না। কারণ এ ধরনের চক্র ভয়ঙ্কর হয়। ক্ষতি হয়ে যেতে পারে। কিন্তু শোনেনি লিয়া। 

ফ্লাই ঢাকা এবং গ্রেফতার

১৯৯২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসের শুরুতেই এক মাসের শিক্ষা ভিসা নিয়ে ঢাকায় আসে লিয়া। তাকে ঢাকা বিমানবন্দও থেকে একটি পাঁচ তারকা হোটেলে নিয়ে যান মাদকের সরবরাহকারী নাইজেরিয়ার নাগরিক রবার্ট ব্লাংকসন টনি। টনি পরে তার সঙ্গে দেখা করবে বলে হোটেলে রেখে চলে যায়। এদিকে লিয়ার দিন কাটতে থাকে হোটেলের রুমে শুয়ে বসে। এভাবেই প্রায় দুসপ্তাহ পেরিয়ে যাওয়ার পর অস্থির হয়ে পড়ে লিয়া। দেশের কথা তার মনে পড়ে। মনে পড়ে বাবা মায়ের কথা। মনের ভিতর তখন থেকে তার অজানা আশঙ্কা। ২৪ ফেব্রুয়ারি রাতে লিয়া সিদ্ধান্ত নেয়, সে কাউকে কিছু না বলেই হোটেল থেকে বেরিয়ে দেশে ফিরে যাবে। পরদিন দুপুরে লিয়া ব্যাগ গুছিয়ে নেয়। নিজের রুম থেকে বেরিয়ে পড়ে। হোটেলের লবিতে যাওয়া মাত্র একজন বেল বয় তাকে সাহায্য করতে ছুটে আসে। ব্যাগ তাকে দিয়েই সামনে চোখ রাখতেই দেখেন মাদকের ডিলার টনিকে। টনি তার সামনে এসে দাঁড়ায়। প্রশ্ন করে, কোথায় যাচ্ছ? লিয়ার জবাব, আমি আর দেরি করতে পারছি না। নইলে আমি ফ্লাইট মিস করব। টনি এ সময় উত্তেজিত হয়ে পড়ে। তার হাত ধরে হোটেলের বাইরে নিয়ে যায়। গেটের সামনে দাঁড়িয়ে থাকা একটি গাড়িতে জোর করে তুলে নেয়। টনি তাকে ভয় দেখিয়ে বলে, টেক্সাসে তার ছোট ভাইয়ের ক্ষতি হয়ে যাবে তার কথা মতো না চললে। লিয়াকে নিয়ে যায় আরও একটি হোটেলে। সেখানেই টেপ দিয়ে লিয়ার শরীরের মধ্যে সাড়ে তিন কেজি হেরোইন পেঁচিয়ে দেয় টনি। সাড়ে তিন কেজি ওজনের হেরোইন শরীরে বেঁধে চলতে খুব সমস্যা হচ্ছিল লিয়ার। লিয়া এ সময় টনির কাছ থেকে ডলার দাবি করে। কিন্তু টনি তাকে আশ্বাস দেয়। বলে টেক্সাসে যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই ডলার পেয়ে যাবে। লিয়া বুঝতে পারে সে প্রতারিত হয়েছে। এরপরই তাকে ঢাকা বিমানবন্দরে পাঠানো হলে ধরা পড়ে যায় কাস্টমস কর্মকর্তাদের কাছে। সেখানে তাকে জেরা করতে থাকে কর্মকর্তারা। পুলিশ আসে। পুলিশ তাকে জানায়, বাংলাদেশে হেরোইন পাচারের সর্বোচ্চ দণ্ড মৃত্যুদণ্ড। ভয় পায় ১৮ বছরের লিয়া। কাঁদতে থাকে। পুলিশ তাকে নির্ভয় দেয়। হেরোইন পাচারের মূল মালিকের নাম বলে দিলেই লিয়া বেঁচে যাবে বলে কথা দেয় পুলিশ কর্মকর্তারা। লিয়া তখন বলে, সে রাজি। কিন্তু তাকে তো ভালো করে চেনেই না। পুরো ঘটনা খুলে বলে লিয়া। পরদিন যশোর বেনাপোল এলাকায় আটক হয় মাদকের ডিলার রবার্ট ব্লাংকসন টনি। সীমান্ত দিয়ে দেশ ত্যাগের চেষ্টা করছিল। পুলিশ ছিল অ্যালার্ট। তাকে ধরার জন্য রেড অ্যালার্ট জারি করেছিল পুলিশ আগে থেকেই। টনিকে লিয়ার সামনা সামনি করা হয়। লিয়া দেখিয়ে দেয়, এই ব্যক্তিটিই তার শরীরের হেরোইন বেঁধে দিয়েছিল। টনি এ সময় লিয়াকে চেনে না বলে দাবি করে। পুলিশের জেরার মুখে পরে অবশ্য স্বীকার করে টনি।

এলিয়েদা এখন

দেশে ফিরে যাওয়ার পর সেই এলিয়েদা নিজেকে পরিবর্তন করেছেন। দেশে ফিরেই লেখাপড়ায় মনোনিবেশ করেন। ১৯৯৯ সালে তিনি অ্যাসোসিয়েট ডিগ্রি এবং ২০০১ সালে ব্যাচেলর ডিগ্রি নেন। তিনি নাসার জনসন স্পেস সেন্টারে চাকরি নেন। পরে এইএস করপোরেশনেও চাকরি করেন।

এই রকম আরও টপিক

এই বিভাগের আরও খবর

সর্বশেষ খবর