সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
কূটনীতিক ব্রিফিংয়ে পররাষ্ট্রমন্ত্রী

পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়

কূটনৈতিক প্রতিবেদক

পাশে দাঁড়িয়েছে বিশ্ব সম্প্রদায়

রোহিঙ্গা পরিস্থিতি মোকাবিলায় বাংলাদেশের পাশে আছে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়। অভ্যন্তরীণ বিভিন্ন সমস্যা সত্ত্বেও বাংলাদেশ যেভাবে মিয়ানমারের বিপুলসংখ্যক রোহিঙ্গা জনগোষ্ঠীকে আশ্রয় দিচ্ছে তার প্রশংসা করছে তারা। গতকাল রবিবার বিকালে ঢাকায় রাষ্ট্রীয় অতিথি ভবন পদ্মায় পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় আয়োজিত কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে তারা এ অবস্থান জানায়। ব্রিফিংয়ের পর পররাষ্ট্রমন্ত্রী এ এইচ মাহমুদ আলী সাংবাদিকদের জানান, গণহত্যা বন্ধে মিয়ানমারকে ধমক দেওয়া হয়েছে। সবাই বলেছে এটি গণহত্যা। আমরাও বলছি, গণহত্যা। বাংলাদেশের সঙ্গে পশ্চিমা দেশগুলো একমত। আমরা যুদ্ধ চাই না। যুদ্ধ কোনো সমাধান নয়। এতে উন্নয়ন ব্যাহত হয়। তাই শান্তিপূর্ণভাবেই রোহিঙ্গা সমস্যার সমাধান করতে হবে। তিনি বলেন, মিয়ানমার আন্তর্জাতিকভাবে চাপ অনুভব করছে বলেই এখন রোহিঙ্গা আসার সংখ্যা কমে যাচ্ছে। রোহিঙ্গাদের নৃতাত্ত্বিক পরিচয় এবং রাখাইন রাজ্যে তাদের অন্তত কয়েক শতাব্দী ধরে বসবাসের প্রসঙ্গ তুলে ধরে তিনি বলেন, মিয়ানমারকে রোহিঙ্গাদের ‘বেঙ্গলি’ বলা বন্ধ করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের রোহিঙ্গা সমস্যাকে এখন বাংলাদেশের জাতীয় সমস্যা হিসেবে উল্লেখ করে এর সমাধানে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের সমর্থন চেয়েছেন। তিনি বলেন, রোহিঙ্গা সমস্যার সৃষ্টি ও সমাধান— দুটোই মিয়ানমারে। তাই মিয়ানমারকেই এ সমস্যার সমাধান করতে হবে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী চলমান সংকটে দ্রুত মানবিক সহায়তা প্রদান, রোহিঙ্গাদের ভাসানচরে (ঠেঙ্গারচরের নতুন নাম) স্থানান্তর এবং মিয়ানমারের লোকদের তাদের নিজ দেশে ফিরে যাওয়া নিশ্চিত করতে সমর্থন দিতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান।

বিদেশি কূটনীতিকরা চলমান সংকট নিয়ে ব্রিফিং আয়োজনের জন্য বাংলাদেশ সরকারকে ধন্যবাদ জানান। তারা মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে সামরিক বাহিনীর চলমান অভিযানে অতিরিক্ত বলপ্রয়োগ বন্ধ ও বেসামরিক জনগণের সুরক্ষার ওপর জোর দিয়েছেন। তারা রোহিঙ্গা সমস্যা সমাধানে কোফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলোর বাস্তবায়ন দেখতে চান। আর এটি মিয়ানমারকেই করতে হবে।  জানা গেছে, আন্তর্জাতিক সম্প্রদায় কীভাবে বাংলাদেশকে সহযোগিতা করতে পারে সেটিও আলোচনা হয়েছে কূটনৈতিক ব্রিফিংয়ে। সেখানে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বিভিন্ন সূত্রের বরাত দিয়ে দাবি করেছেন, রাখাইন রাজ্যে গত ২৫ আগস্ট থেকে তিন হাজার লোকের প্রাণহানি হয়েছে। সেখানে সন্ত্রাসী হামলা হয়েছে। বাংলাদেশও এর নিন্দা জানিয়েছে। কিন্তু সন্ত্রাসী হামলার শাস্তি দিতে গিয়ে গ্রামের পর গ্রাম জ্বালিয়ে দেওয়া, হাজার হাজার মানুষ মেরে ফেলা মেনে নেওয়া যায় না। রোহিঙ্গা ইস্যুতে কূটনৈতিক তৎপরতার অংশ হিসেবে গতকাল দুই দফায় ঢাকায় বিভিন্ন দেশ ও জাতিসংঘের বিভিন্ন সংস্থার প্রতিনিধিদের ব্রিফ করেন পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবুল হাসান মাহমুদ আলী। প্রথম দফা ব্রিফিংয়ে অস্ট্রেলিয়া, ব্রাজিল, কানাডা, ডেনমার্ক, ফ্রান্স, জার্মানি, ইতালি, তুরস্ক, সুইডেন, সুইজারল্যান্ড, স্পেন, নরওয়ে, নেদারল্যান্ডস, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য এবং ইউরোপীয় ইউনিয়নের (ইইউ) রাষ্ট্রদূত/হাইকমিশনার এবং জাতিসংঘের আবাসিক সমন্বয়ক, শরণার্থীবিষয়ক হাইকমিশনার (ইউএনএইচসিআর), বিশ্ব খাদ্য কর্মসূচি, জরুরি শিশু তহবিল (ইউনিসেফ), আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থা (আইওএম), আন্তর্জাতিক রেডক্রস ও রেডক্রিসেন্ট কমিটির প্রতিনিধিরা উপস্থিত ছিলেন।  দ্বিতীয় দফা ব্রিফিংয়ে ছিলেন মিসর, ইরান, ইরাক, কুয়েত, লিবিয়া, মরক্কো, ওমান, ফিলিস্তিন, কাতার, সৌদি আরব ও সংযুক্ত আরব আমিরাতের রাষ্ট্রদূত/ হাইকমিশনার/ চার্জ দ্য অ্যাফেয়ার্সরা উপস্থিত ছিলেন। ব্রিফিংগুলোতে পররাষ্ট্রমন্ত্রী বাংলাদেশে রোহিঙ্গা পরিস্থিতি তুলে ধরেন। তিনি বলেন, গত দুই সপ্তাহে প্রায় তিন লাখ রোহিঙ্গা বাংলাদেশে ঢুকেছে। গত তিন দশক ধরে বাংলাদেশ চার লাখ রোহিঙ্গাকে আশ্রয় দিয়ে আসছে। সে হিসাবে ইতিমধ্যে বাংলাদেশে মিয়ানমারের রোহিঙ্গার সংখ্যা সাত লাখে দাঁড়িয়েছে। তাদের আশ্রয়ের পাশাপাশি মানবিক সহায়তা দেওয়া বাংলাদেশের জন্য একটি বিরাট চ্যালেঞ্জ।  পররাষ্ট্রমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশ সব সময় মিয়ানমারের সঙ্গে দ্বিপক্ষীয় আলোচনার মাধ্যমে বহু পুরনো এ সমস্যার সমাধান করার চেষ্টা করেছে। ১৯৯২ সালের দ্বিতীয় চুক্তির আওতায় বাংলাদেশ সফলভাবে দুই লাখ ৩৬ হাজার ৫৯৯ জন রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে ফেরত পাঠিয়েছে। ওই চুক্তিতে রোহিঙ্গাদের ‘মিয়ানমার সমাজের সদস্য’ হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী মিয়ানমারের নিরাপত্তা উদ্বেগ নিরসনে ২০১৪ সালে বাংলাদেশের পক্ষ থেকে দুটি সমঝোতা স্মারক সইয়ের প্রস্তাব দেওয়ার কথাও উল্লেখ করেন। তিনি বলেন, বাংলাদেশ মিয়ানমারকে সমন্বিত যৌথ টহল ও যৌথ অভিযানেরও প্রস্তাব দিয়েছে। দুর্ভাগ্যজনক বিষয় হলো, মিয়ানমার এখনো সেগুলোর ব্যাপারে সাড়া দেয়নি। মিয়ানমার তার দেশের রোহিঙ্গাদের ‘বাংলাদেশ থেকে যাওয়া অবৈধ অভিবাসী’ এবং হামলাকারীদের ‘বেঙ্গলি সন্ত্রাসী’ হিসেবে অভিহিত করে বিদ্বেষমূলক প্রপাগাণ্ডা চালাচ্ছে বলেও কূটনীতিকদের জানান পররাষ্ট্রমন্ত্রী। তিনি কোফি আনান কমিশনের সুপারিশগুলোর কথা উল্লেখ করে সেগুলো মিয়ানমার সরকারকে বাস্তবায়নে বাধ্য করতে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তিনি বলেন, ওই সুপারিশগুলোর নিঃশর্ত বাস্তবায়ন রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধান আনতে পারে।  কূটনৈতিক সূত্রগুলো জানিয়েছে, ইউরোপীয় ইউনিয়ন, জার্মানি, যুক্তরাষ্ট্র, যুক্তরাজ্য, জাতিসংঘসহ বিশ্বের সর্বত্র বাংলাদেশের কূটনৈতিক মিশনগুলো রোহিঙ্গা ইস্যুতে জোর কূটনৈতিক তৎপরতা চালাচ্ছে। প্রভাবশালী বেশকিছু দেশ ও জোট বলেছে, জাতিসংঘে রোহিঙ্গা ইস্যুতে তারা বাংলাদেশের সঙ্গে সুর মিলিয়ে কথা বলবে এবং বাংলাদেশকে সমর্থন করবে। উল্লেখ্য, বাংলাদেশ মিয়ানমারের ভিতর রোহিঙ্গাদের জন্য ‘নিরাপদ অঞ্চল’ (সেফ জোন) গড়ার প্রস্তাব দিয়ে আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের কাছে চিঠি পাঠিয়েছে।

সর্বশেষ খবর