সোমবার, ১১ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

দেশে ফিরতেও দুর্ভোগ বিড়ম্বনায় হাজীরা

মোস্তফা কাজল

পবিত্র হজ পালন শেষে বাড়ি ফিরতেও সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনার হাজীরা দুর্ভোগ এবং বিড়ম্বনার শিকার হচ্ছেন। এমনকি পাঁচ দিন ধরে বিমান বাংলাদেশ এয়ারলাইনসের প্রতিটি হজ ফ্লাইট দুই থেকে তিন ঘণ্টা দেরিতে ঢাকা পৌঁছাচ্ছে।

এ অবস্থায় বিমানবন্দরে হয়রানির শিকার ফিরতি হাজীদের অভিযোগ জানানোর জন্য রেজিস্টার বই খোলা হয়েছে। গতকাল দেখা গেছে, অনেক হাজী ভোগান্তির কথা লিপিবদ্ধ করছেন। জানা গেছে, বিকাল পর্যন্ত ৫০৯ জন সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় ফিরে আসা হাজী তাদের অভিযোগ লিপিবদ্ধ করেছেন। এ অভিযোগ আরও বাড়তে পারে বলে জানা  গেছে। অভিযোগের মধ্যে অন্যতম হলো— মক্কা ও মদিনায় নিম্নমানের আবাসন ব্যবস্থা, নিম্নমানের খাবার পরিবেশন, অপ্রতুল চিকিৎসা ব্যবস্থা, অসৌজন্যমূলক আচরণ, জোরপূর্বক অতিরিক্ত অর্থ আদায়, মালপত্র হারিয়ে যাওয়া ও অপর্যাপ্ত পরিবহন ব্যবস্থা ইত্যাদি। এ ছাড়াও যেসব সুযোগ-সুবিধা পাওয়ার কথা ছিল সেসব থেকে বঞ্চিত হওয়ার অভিযোগ অন্যতম। ভুক্তভোগীরা জানিয়েছেন, তাদের অনেকেই নানা অনিয়ম ও অসুবিধার শিকার হন। জেদ্দা বিমানবন্দরে ফ্লাইট বিড়ম্বনার পর ঢাকার হযরত শাহজালাল আন্তর্জাতিক বিমানবন্দরে নেমেও আরেক দফা ভোগান্তির মধ্যে পড়েছেন হাজীরা।  ফিরতি হজ ফ্লাইটের হাজীদের অভিযোগ, হজ ফ্লাইটের বিলম্ব যাত্রা, জেদ্দা বিমানবন্দরের হজ টার্মিনালে ঘণ্টার পর ঘণ্টা অপেক্ষা। আর ঢাকায় ফেরার পর দুর্ভোগ ও বিড়ম্বনা আরও বেড়ে গেছে। দেখা গেছে, হজ ফ্লাইটের অব্যাহত চাপে গোটা বিমানবন্দর এলাকার সড়কগুলো ভরে গেছে হাজীদের মালামালে। গাড়ি না পাওয়ায় অনেক হাজী সড়কের ওপর দাঁড়িয়ে আছেন ঘণ্টার পর ঘণ্টা। গাড়ি না পাওয়ায় বাড়ি ফিরতে পারছিলেন না তারা। যাদের ব্যক্তিগত গাড়ি ছিল তারাও যানজটের কারণে প্রধান সড়ক থেকে টার্মিনালের দিকে প্রবেশ করতে পারছিলেন না। এ ছাড়া বিমানবন্দরের গোলচত্বরে সিগন্যালে আটকে থাকার কারণে বিমানবন্দরের ভিতরে গাড়ির জট লেগে যায়। অন্যদিকে বিমানবন্দরে প্রবেশের সময় এপিবিএন সদস্যরা যাত্রীদের তল্লাশি করার কারণেও যানজট লেগেছে। কোনো কোনো ফ্লাইট যাত্রীদের বিমানবন্দরের আনুষ্ঠানিকতা শেষে কার পার্কিং এলাকা হয়ে গোলচত্বর পর্যন্ত যেতেই সময় চলে গেছে ঘণ্টার পর ঘণ্টা। ভুক্তভোগী হাজীরা আরও জানান, বিমানবন্দরে যারা নিরাপত্তার দায়িত্বে তাদের সিস্টেমের কারণেও যাত্রীদের ভোগান্তির মধ্যে পড়তে হচ্ছে। নিয়মিত ফ্লাইটের কাছাকাছি সময়ে বেশ কয়েকটি হজ ফ্লাইট এসেছে। ফলে একসঙ্গে হাজার হাজার যাত্রী টার্মিনাল থেকে বের হওয়ায় এমন ধরনের ভোগান্তিতে পড়েছেন বিভিন্ন দেশ থেকে আসা সাধারণ যাত্রীরাও।

উল্লেখ্য, চলতি বছর সরকারি ও বেসরকারি ব্যবস্থাপনায় হজ পালন করেছেন ১ লাখ ২৬ হাজার ১৯৮ জন। এর মধ্যে সরকারি ব্যবস্থাপনায় করেছেন চার হাজার ১৯৮ জন ও বাকিরা করেছেন বেসরকারি ব্যবস্থাপনায়। গতকাল গভীর রাত পর্যন্ত ১২ হাজার ৫০০ হাজী দেশে ফিরেছেন। এ ছাড়া বার্ধ্যকজনিত কারণে মারা গেছেন ৯৩ জন।

সরেজমিন চিত্র : গতকাল বিমানবন্দর চত্বরে কথা হয় ভুক্তভোগী হাজী আলী আকবরের সঙ্গে। তিনি থাকেন রাজধানীর পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়া এলাকায়। বেলা সোয়া ১১টায় সৌদি এয়ারলাইনসে ঢাকার বিমানবন্দরে অবতরণ করেন। আর ফরিদাবাদের বাসায় পৌঁছেছেন বিকাল সাড়ে ৫টায়। হাজীদের জেদ্দা থেকে ঢাকার বিমানবন্দরে আসতে সময় লেগেছে ৬ ঘণ্টা। আর বিমানবন্দর থেকে রাজধানীর ফরিদাবাদের বাসায় ফিরতে সময় লেগেছে ৫ ঘণ্টা। তিনি বলেন, অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাগেজ ও জমজমের পানি হাতে পেয়েছি। কিন্তু গাড়ির জন্য পড়েছি বিপদে। ঘণ্টার পর ঘণ্টা বিমানবন্দরের সামনের সড়কে নিরুপায় হয়ে বসেছিলাম। শাহজালাল বিমানবন্দর থেকে ৫ ঘণ্টায় বাসায়  পৌঁছতে পেরেছি। অপর হাজী গাবতলী এলাকার বাসিন্দা আবদুল কাদির জানান, কপালে কী আছে জানি না। জেদ্দা থেকে এলাম ৬ ঘণ্টায়। আর বিমানবন্দর থেকে বাড়ি ফিরতে লাগবে আরও ৪ ঘণ্টা। অপর ভুক্তভোগী দিনাজপুর সদরের রেজাউল ইসলাম তার মা ও দাদিকে নিয়ে সরকারি ব্যবস্থাপনায় হজে যান। সৌদি আরবে যাওয়ার সময় তেমন কোনো সমস্যায় না পড়লেও সেখানে গিয়ে চরম অবহেলা ও হয়রানির শিকার হন। গতকাল হজ শেষে দেশে ফিরে বিমানবন্দরে বলেন, হজের কার্যক্রম মূলত পাঁচ দিন। অথচ ওই পাঁচ দিনে চরম অবহেলার শিকার হতে হয়েছে। রেজাউল ইসলাম জানান, মিনায় ৭ নম্বর মোয়াল্লেমে ছিলেন তারা। যেখানে বাংলাদেশের মোট ৪৯ জন ছিলেন। এখানে খুবই নিম্নমানের তাঁবুতে তাদের থাকতে দেওয়া হয়। তীব্র গরমের মধ্যেও এসি ছিল না। অথচ পাশেই পাকিস্তানের হাজীরা এসিসহ সব ধরনের সুবিধা সংবলিত তাঁবুতে ছিলেন। পাকিস্তান-ভারতের হাজীদের  পোলাও, গোস্তসহ উন্নত মানের খাবার দেওয়া হলেও আমাদের দেওয়া হয়েছে পাতলা ডাল আর তরকারির ঝোল। রান্না করা সবজি দিলেও তা ছিল কাঁচা। আমার মা-দাদি খেতেই পারেননি। হজের পাঁচ দিন আমাদের চিঁড়া আর বিস্কুট খেয়ে কাটাতে হয়েছে। ধানমন্ডি এলাকার বাসিন্দা হাজী খোরশেদ আলম বলেন, ঢাকায় নেমে অল্প সময়ের মধ্যে ব্যাগেজ ও জমজমের পানি হাতে পেলেও গাড়ি না পাওয়ায় বিমানবন্দরেই ঠায় দাঁড়িয়ে থাকতে হচ্ছে। তিনি আক্ষেপ করে বলেন, প্রায় চার ঘণ্টা ধরে আমি বিমানবন্দরের সামনের সড়কে ঠায় দাঁড়িয়ে আছি। কখন বাসায় ফিরতে পারব তা আল্লাহপাকই জানেন। গাইবান্ধা জেলার সদর উপজেলার বাসিন্দা ও অবসরপ্রাপ্ত সরকারি কর্মকর্তা মাহবুবুর রহমান বলেন, সরকারি ব্যবস্থাপনায় যে মানের বাড়ি ভাড়া করার কথা ছিল, সে মানের বাড়িতে রাখতে পারেনি সরকার। এ ছাড়া যাতায়াতের জন্য ট্রেনের ব্যবস্থা করার কথা থাকলেও তা করতে পারেনি তারা। ফলে হেঁটেই অনেক পথ যেতে হয়েছে। তবে এ জন্য সরকার তাকে পাঁচশ রিয়াল ফেরত দিয়েছে। দিনাজপুরের আশরাফুল ইসলাম বলেন, আমাদের পাশেই পাকিস্তান ও ভারতের হাজীরা ছিলেন। তাদের থাকার ও খাওয়ার ব্যবস্থা অনেক ভালো ছিল। তাদের দেখে আমরা অপমানবোধ করতাম। লজ্জায় পড়তে হতো। এ বিষয়ে আমাদের গাইড বা মোয়াল্লেমকে বলে কোনো লাভ হতো না। তাদের খুঁজেই পাওয়া যেত না।

সর্বশেষ খবর