রবিবার, ১৭ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা
গোয়েন্দা কাহিনী ১৭

বেওয়ারিশ লাশে কাঁপল দেশ

মির্জা মেহেদী তমাল

বেওয়ারিশ লাশে কাঁপল দেশ

শীতের সকাল। কুয়াশায় ঢেকে আছে চারদিক। রাস্তায় লোকজন কম। গাড়ি-ঘোড়া খুব একটা নেই। দিনের বেলায়ও হেডলাইট জ্বালিয়ে কিছু গাড়ি চলাচল করছে। কিন্তু রাজধানীর পোস্তগোলা বুড়িগঙ্গা সেতুর ওপর ভিন্ন দৃশ্য। পুব দিকের রেলিং ঘেঁষে মানুষের জটলা। তাদের দৃষ্টি সেতুর মাঝামাঝি একটি পিলারের গার্ডারের দিকে। গার্ডারে আটকে আছে একটি লাশ। কেউ বলছেন ঝাঁপিয়ে পড়ে আত্মহত্যা করেছে মানুষটি। আবার কেউ বলছেন গাড়িতে করে এনে তাকে নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছে। মানুষের এমন সব জল্পনা-কল্পনার মধ্যেই পুলিশ হাজির। খবর দেওয়া হয় ফায়ার সার্ভিসকে। পিলারের গার্ডারে আটকে থাকা লাশটি উদ্ধার হয়। লাশটি এক তরুণীর। লাশ পাঠানো হয় সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে। পুলিশের সুরতহাল রিপোর্টে বলা হয়, লাশের বিভিন্ন অংশে থেঁতলানো জখম রয়েছে। মাথার খুলিতে ভোঁতা অস্ত্রের আঘাত। এতে পুলিশ নিশ্চিত, এটি একটি পরিকল্পিত হত্যাকাণ্ড। এ ঘটনায় কেরানীগঞ্জ থানার এএসআই শফিউদ্দিন ওইদিন দুপুরে একটি হত্যা মামলা করেন। মামলায় কাউকে আসামি করা হয়নি। পুলিশ কোনোভাবেই তরুণীর নাম-পরিচয় জানতে পারেনি। বেওয়ারিশ হিসেবে লাশ দাফনের প্রস্তুতি চলে। ঘটনাটি ২০০২ সালের নভেম্বরের।

এর মধ্যেই ‘লাশটি কার?’— এ শিরোনামে একটি জাতীয় দৈনিকের ভিতরের পাতায় ছোট্ট একটি সংবাদ ছাপা হয়। এক তরুণীর লাশের ছবিসহ ওই সংবাদে বলা হয়, ‘সলিমুল্লাহ মেডিকেল কলেজ মর্গে অজ্ঞাতনামা এক তরুণীর লাশ দুই দিন ধরে পড়ে আছে।’ পত্রিকার এই সংবাদেও কোনো দাবিদার মেলেনি। এর দুই দিন পর আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের মাধ্যমে লাশ দাফন করা হয়। দাফনের এ খবরটিও পত্রিকায় ছবিসহ ছাপা হয়। এ সংবাদটি তরুণীর আত্মীয়স্বজনের নজরে আসে। তারা নিশ্চিত হতে ছুটে যান আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামে। লাশ দাফনের আগে আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের পক্ষ থেকে বেওয়ারিশ লাশের তুলে রাখা ছবি দেখানো হয় তাদের। স্বজনরা ছবি দেখেই হকবাক! বেওয়ারিশ লাশটি আর কেউ নয়, লাশটি তাদের প্রিয় সন্তান তিন্নির! এই তিন্নি হলেন বাংলাদেশের জনপ্রিয় মডেল সৈয়দা তানিয়া মাহবুব তিন্নি। বেরিয়ে আসে তার খুন ও খুনের রহস্য।

পত্রিকায় প্রকাশিত একটি ছোট্ট সংবাদই জনপ্রিয় মডেল তিন্নির লাশ শনাক্ত করে দেয়। ফাঁস হয় তিন্নির নিখোঁজ হওয়া থেকে শুরু করে তার খুনের নেপথ্য কাহিনী। সেদিন পত্রিকায় সংবাদটি প্রকাশ না হলে হয়তো তিন্নি খুনের ঘটনাটি ভিন্ন মোড় নিত। অথবা নিখোঁজের তালিকায় থেকে যেতেন তিন্নি। স্বজনরা জানতেও পারতেন না, কোথা থেকে কী হয়ে গেছে তাদের সন্তানের জীবনে। বেওয়ারিশ লাশটি মডেল তিন্নির— এ খবর চাউর হওয়ার পর দেশজুড়ে তোলপাড়। আর এ ঘটনার সঙ্গে একসময়ের ছাত্রনেতা সাবেক এমপি গোলাম ফারুক অভির নামটি জড়িয়ে পড়ায় ঘটনাটি আলোচনার শীর্ষে থাকে। বেওয়ারিশ এ লাশেই তখন কাঁপে গোটা দেশ। তিন্নি হত্যা মামলার তদন্তে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তা জানান, ১০ নভেম্বর রাতের আঁধারে অজ্ঞাতনামা তরুণীকে হত্যা করে লাশ গোপন করার জন্য বুড়িগঙ্গা সেতুর নিচে ফেলে দেওয়া হয়েছিল। ময়নাতদন্ত শেষে দাবিদার না থাকায় মর্গেই পড়ে থাকে লাশটি। ১৫ নভেম্বর পর্যন্ত কোনো দাবিদার না আসায় লাশটি আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলামের কাছে হস্তান্তর করা হয়। সেই দিনই লাশটি দাফন হয়ে যায়। এরই মধ্যে দুবার পত্রিকায় লাশ উদ্ধার ও দাফনের সংবাদ প্রকাশিত হয়। পত্রিকায় ছবি দেখে তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম লাশটি শনাক্ত করেন। পরে ২১ নভেম্বর লাশ কবর থেকে উত্তোলন করে ফের ময়নাতদন্ত করা হয়। ১৫ বছর আগে ঘটে যাওয়া এ ঘটনাটি এখনো মাঝেমধ্যে আলোচনায় চলে আসে। বিশেষ করে মডেল তিন্নি হত্যা মামলার খড়্গ মাথায় নিয়ে লাপাত্তা বনে যাওয়া অভিকে নিয়ে সংশ্লিষ্ট মহলগুলোয় কৌতূহল বাড়ছেই। তবে আলোচিত এই খুনের পর ১৫ বছর পেরিয়ে গেলেও বিচার এখনো শেষ হয়নি। বিচার নিয়ে তিন্নির পরিবার হতাশ। হাই কোর্টের একটি রিটের কারণে প্রায় সাত বছর ধরে ঝুলে আছে মডেল তিন্নি হত্যার বিচার। এ হত্যা মামলার বিচারকাজ চলছিল ঢাকার সপ্তম অতিরিক্ত জেলা জজ আদালতে। ৪১ জন সাক্ষীর মধ্যে তিন্নির বাবাসহ তিনজনের সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ হয় মাত্র। এরপর ২০১০ সালে হাই কোর্টে আসামিপক্ষের এক আইনজীবীর রিটের পরিপ্রেক্ষিতে হাই কোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে আজও অসমাপ্ত রয়ে গেছে চাঞ্চল্যকর এ হত্যা মামলার বিচার। এরপর কেটে গেছে অর্ধযুগের বেশি। উচ্চ আদালতের স্থগিতাদেশের কারণে ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সপ্তম আদালতে মামলাটি পড়ে আছে বছরের পর বছর।

তিন্নি হত্যা যেভাবে : আদালতসংশ্লিষ্ট একাধিক সূত্রে জানা যায়, ১৫ বছর আগে ২০০২ সালের ১০ নভেম্বর রাতে খুন হন তিন্নি। এর আগে ৬ নভেম্বর তিন্নিকে তার স্বামী সাক্কাত হোসেন পিয়ালের সঙ্গে সম্পর্ক ছিন্ন করতে বাধ্য করেন অভি। তিন্নিও তাকে তালাক দেন। ওই দিনই পিয়ালকে তার দেড় বছর বয়সী কন্যাসন্তানসহ রাজধানীর বাড়ি থেকে বের করে দেওয়া হয়। এরপর বিয়ে করার জন্য অভিকে চাপ দিতে থাকেন তিন্নি। একপর্যায়ে তিন্নি বিষয়টি সাংবাদিকদের কাছে ফাঁস করে দেওয়ার হুমকি দেন।

১০ নভেম্বর রাতে খুন হন তিন্নি। মাথায় আঘাত করে তাকে হত্যা করা হয়। এরপর গুমের উদ্দেশ্যে ওই রাতে বুড়িগঙ্গার ১ নম্বর চীন মৈত্রী সেতুর ওপর থেকে নদীতে ফেলে দেওয়া হয় লাশ। কিন্তু পানিতে নয়, লাশটি পড়ে পিলারের উঁচু অংশে। পরদিন সকালে লাশ ঘিরে জমে উত্সুক মানুষের ভিড়। কেরানীগঞ্জ থানার পুলিশ লাশ উদ্ধার করে সুরতহালের পর ময়নাতদন্ত করে। মর্গে চার দিন রাখার পর ১৫ নভেম্বর অজ্ঞাত হিসেবে জুরাইন কবরস্থানে দাফন করা হয় তিন্নিকে। এদিকে তিন্নির চাচা সৈয়দ রেজাউল করিম কেরানীগঞ্জ থানায় একটি হারানো ডায়েরি করেন। লাশ উদ্ধারের দিন একই থানায় একটি হত্যা মামলা করেন থানার সহকারী উপ-পরিদর্শক (এএসআই) মো. শফি উদ্দিন। অজ্ঞাতনামা দুর্বৃত্তদের আসামি করা হয় মামলায়। পরে সংবাদপত্রে প্রকাশিত একটি ছোট্ট সংবাদের সূত্র ধরে তিন্নির স্বজনরা আঞ্জুমান মুফিদুল ইসলাম অফিসে ছুটে যান। ছবি দেখে চিনতে পারেন সেটা তাদের প্রিয় তিন্নির লাশ। এরপর ঘটনাটি ব্যাপক চাঞ্চল্যের সৃষ্টি করে।

শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের স্বীকারোক্তিতে অভির নাম : মামলাটি প্রথমে তদন্ত করেন একই থানার উপ-পরিদর্শক (এসআই) মো. কাইয়ুম আলী সরদার। পরে মামলাটিতে অভির নাম উঠে এলে তা নিয়ে পড়ে যায় হৈচৈ। চাঞ্চল্যকর বিবেচনায় মামলাটির ভার পড়ে সিআইডির ওপর। প্রথম দিকে দুই সিআইডি পরিদর্শক মো. ফজলুর রহমান ও সুজাউল হক তদন্ত করেন। এরপর যথাক্রমে সিআইডির সহকারী পুলিশ সুপার গোলাম মোস্তফা, মো. আরমান আলী, কমল কৃষ্ণ ভরদ্বাজ মামলাটি তদন্ত করেন। অবশেষে ঘটনার ছয় বছরের মাথায় মামলার সপ্তম তদন্ত কর্মকর্তা সিআইডির এএসপি মো. মোজাম্মেল হক ২০০৮ সালের ৮ নভেম্বর মামলাটির তদন্ত শেষ করেন। তিন্নি হত্যার ঘটনায় গ্রেফতার হয়েছিলেন তিন্নির স্বামী পিয়াল, এবাদুল্লাহ ওরফে স্বপন গাজী, গাজী শফিউল্লাহ ওরফে তপন গাজী, মো. শফিকুল ইসলাম ওরফে জুয়েল ও সোমনাথ সাহা বাপ্পীসহ কয়েকজন। পরে তাদের ছেড়ে দেওয়া হয়। মূলত কারাগারে বন্দী শীর্ষ সন্ত্রাসী ইমনের স্বীকারোক্তিতে ফাঁস হয় তিন্নি হত্যার আসল রহস্য। বেরিয়ে আসে অভির নাম। একমাত্র অভিকেই দায়ী করে তদন্ত প্রতিবেদন দেওয়া হয়। ২০০২ সালে অভি পালিয়ে প্রথমে ভারত চলে যান। সেখান থেকে কানাডায়।

আট বছর পর বিচার শুরু : বিচারের জন্য মামলাটি ২০১০ সালের ১৮ ফেব্রুয়ারি ঢাকা জেলা ও দায়রা জজ আদালতে পাঠানো হয়। সেখান থেকে তা ওই বছরের ১৬ মার্চ ঢাকার অতিরিক্ত জেলা ও দায়রা জজ সপ্তম আদালতে যায়। একাধিক শুনানি শেষে ওই বছরের ১৪ এপ্রিল অভির অনুপস্থিতিতে তার বিরুদ্ধে চার্জ গঠন করা হয়। মামলাটির তিন নম্বর সাক্ষী তিন্নির বাবা সৈয়দ মাহবুব করিম। ২০১১ সালের ১০ এপ্রিল আদালতে সাক্ষ্য গ্রহণ শুরু হয়। তিন্নির বাবা তার সাক্ষ্যে আদালতকে জানান, অভিনয়ে আগ্রহী ছিলেন না তিন্নি। স্বামী পিয়াল তাকে নানা কৌশলে অভিনয়ে নেন। একদিন পিয়াল তাকে ব্যাংককে শপিংয়ে পাঠান। সেখানে বাবু নামের এক ভদ্রলোক তাকে সহযোগিতা করবেন বলে জানানো হয়। সেই বাবুই ছিলেন অভি। এরপর অভির সঙ্গে তিন্নির সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তার সাক্ষ্য গ্রহণ শেষ না হতেই উচ্চ আদালতে অভির পক্ষে করা রিট পিটিশনে (নম্বর-৯৫৩১/২০১০) নিম্ন আদালতে মামলাটির ওপর স্থগিতাদেশ দেওয়া হয়।

অভির রিট : খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, কানাডার টরেন্টো থেকে অভি পাওয়ার অব অ্যাটর্নির প্রয়োজনীয় কাগজপত্র পাঠিয়ে এক আইনজীবীর মাধ্যমে মামলাটির স্থগিতাদেশ চেয়ে ২০১০ সালের ৫ ডিসেম্বর হাই কোর্টে একটি রিট আবেদন করেন, যার রিট পিটিশন নম্বর ৯৫৩১/২০১০। বাংলাদেশে নিম্ন আদালতে চলমান মামলাটিতে অংশ নেওয়ার জন্য বাংলাদেশ হাইকমিশনে (ওই দেশে অবস্থিত) পাসপোর্ট চেয়ে পাওয়া যায়নি বলে উল্লেখ করেন তিনি। ইচ্ছা থাকলেও দেশে আসতে পারছেন না বলেও উল্লেখ করেন। তাই তার ন্যায়বিচার পাওয়ার স্বার্থে পাসপোর্ট পেয়ে দেশে আসা পর্যন্ত মামলাটির কার্যক্রমে স্থগিতাদেশ চাওয়া হয় অভির পক্ষে।

এই রকম আরও টপিক

সর্বশেষ খবর