শনিবার, ২৩ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

সহিংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধ করুন : জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী

শাবান মাহমুদ ও রুহুল আমিন রাসেল, নিউইয়র্ক থেকে

সহিংসতা ও জাতিগত নিধন বন্ধ করুন : জাতিসংঘে প্রধানমন্ত্রী

প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে জাতিসংঘে পাঁচ দফা প্রস্তাব উত্থাপন করেছেন। তিনি বাংলাদেশ সময় গতকাল ভোরে জাতিসংঘ সাধারণ পরিষদে ভাষণকালে এসব প্রস্তাব তুলে ধরেন। শেখ হাসিনা তার ভাষণে রোহিঙ্গা সমস্যার স্থায়ী সমাধানে দ্রুত কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণের জন্য জাতিসংঘ ও আন্তর্জাতিক সম্প্রদায়ের প্রতি আহ্বান জানান। তার উত্থাপিত পাঁচ দফা প্রস্তাবে রয়েছে : অনতিবিলম্বে এবং চিরতরে মিয়ানমারে সহিংসতা ও ‘জাতিগত নিধন’ নিঃশর্তে বন্ধ করা, দ্বিতীয়ত, অনতিবিলম্বে মিয়ানমারে জাতিসংঘের মহাসচিবের নিজস্ব একটি অনুসন্ধানী দল পাঠানো; তৃতীয়ত, জাতি-ধর্ম নির্বিশেষে সব সাধারণ নাগরিকের নিরাপত্তা বিধান এবং এ লক্ষ্যে মিয়ানমারের অভ্যন্তরে জাতিসংঘের তত্ত্বাবধানে সুরক্ষা বলয় গড়ে তোলা, চতুর্থত, রাখাইন রাজ্য থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত সব রোহিঙ্গাকে মিয়ানমারে তাদের নিজ ঘরবাড়িতে প্রত্যাবর্তন ও পুনর্বাসন নিশ্চিত করা; পঞ্চমত, কফি আনান কমিশনের সুপারিশমালার নিঃশর্ত, পূর্ণ এবং দ্রুত বাস্তবায়ন নিশ্চিত করা। শেখ হাসিনা বলেন, আমরা যুদ্ধ চাই না, শান্তি চাই। আমরা অর্থনৈতিক উন্নতি চাই, মানব ধ্বংস নয়- মানবকল্যাণ চাই। এটাই হোক আমাদের সবার লক্ষ্য। প্রধানমন্ত্রী সাধারণ পরিষদে নিউইয়র্ক সময় বৃহস্পতিবার সন্ধ্যা পৌনে ৭টায় এবারও জাতিসংঘে তার ১৪তম ভাষণ দিলেন মাতৃভাষা বাংলায়। ভাষণে বাংলাদেশের সম্ভাবনার কথা যেমন তুলে ধরেছেন, তেমনি গুরুত্বারোপ করেছেন মিয়ানমারে রোহিঙ্গা নির্যাতনের অবসান একং মধ্যপ্রাচ্য সংকট মোচন ও বিশ্বশান্তি প্রতিষ্ঠার ওপর। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার ১৭ মিনিটের বক্তৃতার সময় অধিবেশন কক্ষের দর্শক-সে াতারা ৯ বার করতালি দিয়েছেন। তার ভাষণের আগে প্রায় ৪ ঘণ্টায় ১৪ জন সরকার ও রাষ্ট্রপ্রধান ভাষণ দেন। তাদের ভাষণের সময় এমনটি ঘটেনি। প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, আমার হৃদয় আজ দুঃখ ভারাক্রান্ত। কেননা আমার চোখে বার বার ভেসে উঠছে ক্ষুধার্ত, ভীতসন্ত্রস্ত এবং নির্যাতিত রোহিঙ্গাদের মুখচ্ছবি। আমি মাত্র কয়েক দিন আগেই আমার দেশের কক্সবাজারে আশ্রয় নেওয়া কয়েক লাখ রোহিঙ্গার সঙ্গে দেখা করে এসেছি, যারা ‘জাতিগত নিধনে’র শিকার হয়ে আজ নিজ দেশ থেকে বিতাড়িত। আন্তর্জাতিক অভিবাসন সংস্থার তথ্যমতে, গত তিন সপ্তাহে বাংলাদেশে ৪ লাখ ৩০ হাজার শরণার্থী এসেছে। অথচ জাতিগত নিধনের শিকার এসব রোহিঙ্গা হাজার বছরেরও বেশি সময় ধরে মিয়ানমারে বসবাস করে আসছে। শেখ হাসিনা বলেন, নিজ ভূখণ্ড থেকে জোরপূর্বক বিতাড়িত ৮ লাখেরও বেশি রোহিঙ্গাকে আশ্রয় ও সুরক্ষা আমরা দিয়ে যাচ্ছি। মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান নৃশংসতা এবং মানবাধিকার লঙ্ঘনের ফলে বাংলাদেশ-মিয়ানমার সীমান্তে অবস্থার ভয়াবহ অবনতি ঘটেছে। এতে আমরা ভীষণভাবে দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, যখন দেখি এই রোহিঙ্গাদের ফেরত যাওয়া ঠেকানোর জন্য সেদেশের কর্তৃপক্ষ মিয়ানমারের অভ্যন্তরে সীমানা বরাবর স্থলমাইন পুঁতে রাখছে। এসব মানুষ যাতে নিরাপদে এবং মর্যাদার সঙ্গে নিজ দেশে ফিরে যেতে পারে এখনই তার ব্যবস্থা করতে হবে। একই সঙ্গে শেখ হাসিনা মিয়ানমারে চলমান সব ধরনের সন্ত্রাস ও জঙ্গিবাদের নিন্দা জ্ঞাপন করে বলেন, এ বিষয়ে আমাদের সরকার ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলে। তিনি মিয়ানমারের রাখাইন রাজ্যে চলমান সহিংসতা বন্ধে এবং ওই অঞ্চলে শান্তি ও স্থিতিশীলতা প্রতিষ্ঠায় সক্রিয় উদ্যোগ গ্রহণ করায় নিরাপত্তা পরিষদের সদস্য রাষ্ট্রসমূহ ও জাতিসংঘ মহাসচিবকে ধন্যবাদ জানান। সন্ত্রাসবাদকে বৈশ্বিক সমস্যা অভিহিত করে তা মোকাবিলায় তিনটি প্রস্তাব দিয়ে প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসীদের অস্ত্র সরবরাহ বন্ধ করতে হবে। সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন বন্ধ করতে হবে। শান্তিপূর্ণ উপায়ে আন্তর্জাতিক বিবাদ মীমাংসা করতে হবে। অর্থ পাচার, সন্ত্রাসবাদে অর্থায়ন এবং অন্যান্য আন্তরাষ্ট্রীয় সংঘবদ্ধ অপরাধের ক্ষেত্রে সাইবার জগৎ থেকে উদ্ভূত হুমকি মোকাবিলা এখন জরুরি হয়ে পড়েছে। এক্ষেত্রে সমন্বিত উদ্যোগ নেওয়ার জন্য তিনি জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানান। শেখ হাসিনা বলেন, সন্ত্রাসবাদ এবং সহিংস জঙ্গিবাদ শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং উন্নয়নের জন্য সবচেয়ে বড় হুমকি। একজন সন্ত্রাসীর কোনো ধর্ম, বর্ণ বা গোত্র নেই। আমি নিজে বেশ কয়েকবার সন্ত্রাসী হামলার শিকার হয়েছি। সে হিসেবে আমি সন্ত্রাসের শিকার মানুষের প্রতি আমার সহানুভূতি প্রকাশ করছি। আমি মনে করি তাদের সুরক্ষা দেওয়া প্রয়োজন। আমরা ধর্মের নামে যে কোনো সহিংস জঙ্গিবাদের নিন্দা জানাই। সহিংস জঙ্গিবাদ বিস্তার রোধে তৃণমূল পর্যায়ে আমরা পরিবার, নারী, যুবসমাজ, গণমাধ্যম এবং ধর্মীয় নেতাদের সম্পৃক্ত করেছি। ১৯৭৪ সালে জাতিসংঘের সাধারণ পরিষদে বাঙালি জাতির পিতা বঙ্গবন্ধুর ঐতিহাসিক প্রথম ভাষণের কথা স্মরণ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, বাংলাদেশের হয়ে প্রথমবারের মতো এখানে ভাষণ দেওয়ার সময় এই মঞ্চে দাঁড়িয়ে আমার বাবা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান শান্তি ও ন্যায়বিচারের পক্ষে তার অঙ্গীকারের কথা বলে গেছেন। সেই ভাষণে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিব বলেছিলেন, এমন এক বিশ্ব ব্যবস্থা গঠনে বাঙালি জাতি উৎসর্গীকৃত, যে ব্যবস্থায় সব মানুষের শান্তি ও ন্যায়বিচার লাভের আকাঙ্ক্ষা প্রতিফলিত হবে এবং আমি জানি আমাদের এ প্রতিজ্ঞা গ্রহণের মধ্যে আমাদের লাখ লাখ শহীদের বিদেহী আত্মার স্মৃতি নিহিত রয়েছে। প্রধানমন্ত্রী আরও বলেন, স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই আমরা শান্তিকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছি। এ উপলব্ধি থেকেই সাধারণ পরিষদে ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ‘শান্তির সংস্কৃতি’ (কালচার অব পিস) শীর্ষক প্রস্তাব পেশ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

যুদ্ধাপরাধীদের বিচার প্রসঙ্গ তুলে ধরে প্রধানমন্ত্রী বলেন, ১৯৭১ সালের মুক্তিযুদ্ধে বাংলাদেশ ভয়াবহতম গণহত্যার শিকার হয়। ৯ মাসব্যাপী চলা মুক্তিযুদ্ধে পাকিস্তানি দখলদার বাহিনী ৩০ লাখ নিরীহ মানুষকে হত্যা করেছে এবং ২ লাখ মা-বোনের সম্ভ্রমহানি করেছে। জাতি, ধর্ম, বর্ণ এবং রাজনৈতিক বিশ্বাসের ভিত্তিতে চিহ্নিত ব্যক্তি এবং গোষ্ঠীকে নির্মূল করার উদ্দেশে তারা এই হত্যাযজ্ঞ চালায়। বাঙালি জাতিকে মেধাশূন্য করতে তারা দেশের বরেণ্য বুদ্ধিজীবীদের নৃশংসভাবে হত্যা করে। শেখ হাসিনা ২৫ মার্চকে ‘আন্তর্জাতিক গণহত্যা দিবস’ হিসেবে স্বীকৃতি দেওয়ার জন্য জাতিসংঘের প্রতি আহ্বান জানিয়ে বলেন, ৭১-এর শহীদদের প্রতি শ্রদ্ধা জানিয়ে বাংলাদেশের জাতীয় সংসদ সম্প্রতি ২৫ মার্চকে ‘গণহত্যা দিবস’ হিসেবে ঘোষণা করেছে। মূলত ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চ রাতেই ‘অপারেশন সার্চলাইট’-এর মাধ্যমে তারা এই গণহত্যার সূচনা করেছিল। এই গণহত্যার সঙ্গে জড়িত মূল অভিযুক্তদের আমরা ইতিমধ্যে আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের মাধ্যমে বিচারের মুখোমুখি করেছি। বিশ্বের কোথাও যাতে কখনই আর এ ধরনের জঘন্য অপরাধ সংঘটিত না হয় সেজন্য আমি বিশ্ব সম্প্রদায়কে সম্মিলিত পদক্ষেপ গ্রহণের আহ্বান জানাই। শেখ হাসিনা বলেন, আমি বিশ্বাস করি, ৭১-এর গণহত্যাসহ সব ঐতিহাসিক ট্র্যাজেডির আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি আমাদের এ লক্ষ্য অর্জনে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রাখবে। বাংলাদেশের পক্ষ থেকে ‘জাতিসংঘ শান্তিবিনির্মাণ তহবিল’-এ ১ লাখ মার্কিন ডলার প্রতীকী অনুদান প্রদানের ঘোষণা দিয়ে প্রধানমন্ত্রী বলেন, স্বাধীন জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশের পর থেকেই আমরা শান্তিকেন্দ্রিক অভ্যন্তরীণ এবং পররাষ্ট্রনীতি অনুসরণ করে চলেছি। এ উপলব্ধি থেকেই সাধারণ পরিষদে ২০০০ সাল থেকে প্রতি বছর ‘শান্তির সংস্কৃতি’ শীর্ষক প্রস্তাব পেশ করার ক্ষেত্রে বাংলাদেশ সর্বদা অগ্রণী ভূমিকা পালন করে যাচ্ছে।

তিনি বলেন, মধ্যপ্রাচ্য শান্তি আলোচনা পুনরায় শুরু করা এবং ভ্রাতৃপ্রতিম ফিলিস্তিনি জনগণের বিরুদ্ধে সব ধরনের বৈষম্য এবং শত্রুতা নিরসনের জন্য আমি সবার প্রতি আহ্বান জানাচ্ছি। আমরা আশা করি, শান্তিবিনির্মাণে জাতিসংঘের কার্যকর ভূমিকা অব্যাহত থাকবে। এ লক্ষ্যে ‘অব্যাহত শান্তি’র জন্য অর্থায়ন বিষয়ে জাতিসংঘ মহাসচিবের কাছ থেকে আমরা সাহসী এবং উদ্ভাবনমূলক প্রস্তাব প্রত্যাশা করছি। তিনি বলেন, জাতিসংঘের শান্তিরক্ষা কার্যক্রমে অন্যতম সেনা ও পুলিশ সদস্য প্রদানকারী দেশ হিসেবে বাংলাদেশ জাতিসংঘ শান্তি মিশনসমূহের কার্যকারিতা এবং বিশ্বাসযোগ্যতা সমুন্নত রাখার ওপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করে। এক্ষেত্রে আমরা আমাদের নিজস্ব প্রস্তুতি এবং সক্ষমতা বৃদ্ধির প্রক্রিয়া বজায় রেখে চলছি। যে কোনো জরুরি পরিস্থিতিতে তাত্ক্ষণিক অঙ্গীকার প্রদান, শান্তিরক্ষীদের প্রশিক্ষণের সুযোগ বৃদ্ধি এবং অধিক সংখ্যায় নারী শান্তিরক্ষী মোতায়েনে আমরা সদাপ্রস্তুত রয়েছি। এ প্রেক্ষাপটে ‘যৌন নিপীড়ন’ সংক্রান্ত যে কোনো অভিযোগের বিষয়ে আমরা ‘জিরো টলারেন্স’ নীতি মেনে চলি। জলবায়ু পরিবর্তন বিষয়ে ন্যায়বিচার নিশ্চিত করতে প্যারিস চুক্তির বাস্তবায়নে আশাবাদ প্রকাশ করে প্রধানমন্ত্রী বলেন, জাতীয় পর্যায়ে জলবায়ু সংবেদনশীলতার দিকে লক্ষ্য রেখে জলবায়ু পরিবর্তনের ক্ষতিকর প্রভাব মোকাবিলায় আমরা কার্যকর উদ্যোগ গ্রহণ করেছি। সামুদ্রিক সম্পদের টেকসই ব্যবহার এবং সামুদ্রিক পরিবেশ রক্ষার ক্ষেত্রে ‘ব্লু ইকোনমি’র সম্ভাবনার প্রতি আমরা আস্থাশীল।

সর্বশেষ খবর