রবিবার, ২৪ সেপ্টেম্বর, ২০১৭ ০০:০০ টা

আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কীভাবে বাস্তবায়ন হবে

গণহত্যার দায় মিয়ানমারের

নিজস্ব প্রতিবেদক

আন্তর্জাতিক আদালতের রায় কীভাবে বাস্তবায়ন হবে

রোহিঙ্গা ইস্যুতে মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ে দোষী সাব্যস্ত হয়েছে মিয়ানমার। দেশটির বিরুদ্ধে এখন আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতের (আইসিসি) প্রসিকিউশন বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত করতে পারে। তদন্তকালে ওই গণ-আদালতের রায়, গণমাধ্যমের ছবি ও ভিডিও রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারে প্রসিকিউশন। এরপর আইসিসিতে মামলা হলে সেই আদালতও এগুলো রেফারেন্স হিসেবে ব্যবহার করতে পারবে। কেনিয়াসহ কয়েকটি দেশের বিরুদ্ধে আইসিসির এমন তদন্ত কার্যক্রম এখন চলছে। রোহিঙ্গা নিধন প্রসঙ্গে আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ের প্রেক্ষাপটে বাংলাদেশের আইনজ্ঞ ও বিশিষ্ট ব্যক্তিরা গতকাল বাংলাদেশ প্রতিদিনকে এসব কথা বলেন। তারা বলেন, মালয়েশিয়ার আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের রায়ের আইনগত ভিত্তি না থাকলেও এর প্রভাব রয়েছে। এই রায় রোহিঙ্গা ইসু্যুতে মিয়ানমারের বিরুদ্ধে বিশ্বে জনমত সৃষ্টিতে ভূমিকা রাখবে। তারা আরও বলেন, যদিও গণ-আদালতে প্রতীকী বিচার হয়েছে, বিচারকেরা প্রতীকীভাবেই আইসিসির বিধানগুলো অনুসরণ করেছেন, এর উদ্দেশ্য ছিল জাতিসংঘের নিরাপত্তা কাউন্সিল যাতে আন্তর্জাতিক আইনের বিধানগুলো অনুসরণ করে সু চিসহ মিয়ানমারের নেতৃবৃন্দের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক ফৌজদারি আইন মোতাবেক ব্যবস্থা গ্রহণ করে তাদের বিচার প্রক্রিয়া শুরু করে।

আন্তর্জাতিক অপরাধ ট্রাইব্যুনালের প্রসিকিউটর ড. তুরিন আফরোজ বলেন, এ গণ-আদালতের রায়ের আইনগত ভিত্তি না থাকলেও এটি আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জনমত সৃষ্টিতে ও প্রভাব বিস্তারে সক্ষম। যেখানে গণহত্যার বিচারের জন্য একটি স্থায়ী আন্তর্জাতিক আদালত আছে, সেখানে আন্তর্জাতিক বিশ্বের উচিত সেই স্থায়ী আদালত অর্থাৎ আন্তর্জাতিক অপরাধ আদালতে (আইসিসি) মিয়ানমারের নেতৃবৃন্দের বিচারের জন্য চাপ সৃষ্টি করা। রোম স্ট্যাটিউটের ১৩ অনুচ্ছেদের সেকশন-সি অনুযায়ী আইসিসিতে মিয়ানমারের গণহত্যার বিচার করার সুযোগ রয়েছে। এক্ষেত্রে আইসিসির প্রসিকিউশন বিভাগ স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে গণহত্যাকারী মিয়ানমার রাষ্ট্রটির বিরুদ্ধে বিচারের বিষয়টি নিয়ে অগ্রণী ভূমিকা পালন করতে পারে। তারা তদন্ত শুরু করতে পারে। ২০১০ সালে কেনিয়া, ২০১১ সালে আইভরিকোস্ট ও ২০১৬ সালে জর্জিয়ার বিরুদ্ধে আইসিসি স্বতঃপ্রণোদিত হয়ে তদন্ত শুরু করেছে, তা এখনো চলছে। মিয়ানমারের বিরুদ্ধেও এভাবে তদন্ত চলতে পারে।

আপিল বিভাগের অবসরপ্রাপ্ত বিচারপতি এ এইচ এম শামসুদ্দিন চৌধুরী বলেন, মিয়ানমার যে তাদের দেশে গণহত্যা চালাচ্ছে— গণ-আদালতের এই রায় তার প্রতিফলন। এই রায়কে আমাদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয় জাতীয় ও আন্তর্জাতিক পর্যায়ে জোরালোভাবে তুলে ধরতে পারে। জাতিসংঘের সিকিউরিটি কাউন্সিল এ বিষয়ে ভূমিকা নিতে পারে। মিয়ানমারে সংঘটিত গণহত্যা ও জাতিগত নিধনের বিচারের জন্য রুয়ান্ডা, যুগোস্লাভিয়ার মতো ট্রাইব্যুনাল গঠন করা যেতে পারে। জাতিসংঘ নিরাপত্তা কাউন্সিলের কাছে দাবি থাকবে মিয়ানমারের ক্ষেত্রেও এরকম ট্রাইব্যুনাল গঠন করা হোক। জেনেভা কনভেনশন অনুযায়ী মিয়ানমারে যা হচ্ছে তা জেনোসাইডের অন্তর্ভুক্ত। মিয়ানমার জেনেভা কনভেনশন লঙ্ঘন করেছে। এ বিষয়ে কোনো সন্দেহ নেই। জাতিসংঘ নিরাপত্তা পরিষদের উচিত হবে এই গণহত্যা বন্ধে ব্যবস্থা  গ্রহণ করা। মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিকভাবে অবরোধ আরোপ করা। তিনি বলেন, রুয়ান্ডা, যুগোস্লাভিয়া ও কম্বোডিয়ার মতো ট্রাইব্যুনাল গঠন করে মিয়ানমারের এই গণহত্যার বিচার হচ্ছে না বলে মালয়েশিয়ায় গণ-আদালত বসেছে। মিয়ানমার রোহিঙ্গাদের নাগরিকত্ব থেকে বঞ্চিত করেছে। আন্তর্জাতিক আইনের তত্ত্ব লঙ্ঘন করে তারা অপরাধ করেছে।

তিনি আরও বলেন, রোহিঙ্গা ইস্যুতে বিশ্ব বিবেক যদি জাগ্রত না হয় তাহলে এই সংকটের সমাধান হবে না। এই সমস্যার সমাধান না হলে এই অঞ্চলে সন্ত্রাস, জঙ্গিবাদ ও অস্থিরতা ছড়িয়ে পড়তে পারে। ১৯৭১ সালে ভারত আমাদের পাশে দাঁড়িয়েছিল বলে আমরা নয় মাসে স্বাধীনতা অর্জন করেছিলাম। রোহিঙ্গা সমস্যায় আমরা ভারতের কাছ থেকে সেই রকম সহযোগিতা আশা করছি। রোহিঙ্গাদের আশ্রয় দেওয়ার কারণে প্রধানমন্ত্রী এরই মধ্যে শান্তির দূত ও বিশ্বের অন্যতম মানবতাবাদী নেত্রী হিসেবে স্বীকৃতি লাভ করেছেন। কিন্তু রোহিঙ্গা ইস্যুতে আমরা এখন উভয় সংকটে পড়েছি। বিশ্বকে, জাতিসংঘকে আমাদের বিষয়টি দেখতে হবে যে, আমরা কতটুকু আশ্রয় দিতে পারি?

পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের সাবেক সচিব, বিশিষ্ট কলাম লেখক ও আন্তর্জাতিক সম্পর্ক বিশ্লেষক মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, মিয়ানমারের বিরুদ্ধে আন্তর্জাতিক গণ-আদালতের এই রায় বিশ্বের জনমত সৃষ্টিতে বড় ভূমিকা রাখবে। বিশিষ্ট ব্যক্তি ও আইনজীবীদের নিয়ে গঠিত এই আদালতের রায়ের প্রতি সারা দুনিয়ার শান্তিকামী মানুষের সমর্থন থাকবে। রাখাইন অঞ্চলে চলমান গণহত্যা, জাতিগত নিধন, হত্যা ও ধর্ষণের নিন্দায় এই রায়টি সারা দুনিয়াতেই একটি দলিল হিসেবে মর্যাদা ও গুরুত্ব পাবে। তিনি জানান, এমন একটি আদালত ষাটের দশকের শেষ দিকে বিশ্বনন্দিত বিজ্ঞানী ও দার্শনিক বার্ট্রান্ড রাসেল ভিয়েতনাম যুদ্ধের বিরুদ্ধে জনমত সৃষ্টি করতে গঠন করেছিলেন। এই আদালতটিও আমেরিকার বিরুদ্ধে ভিয়েতনাম যুদ্ধের ভয়াবহ সব চিত্র তুলে ধরেছিল। জাহানারা ইমামের নেতৃত্বে বাংলাদেশেও এ ধরনের একটি আদালত গঠিত হয়েছিল যুদ্ধাপরাধীদের বিচারের উদ্দেশ্যে। মহিউদ্দিন আহমদ বলেন, বাংলাদেশের জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান কাজী রিয়াজুল হকও অং সান সু চি ও গণহত্যার জন্য দায়ী তার জেনারেলদের বিচার আইসিসিতে হওয়ার প্রস্তাব করেছেন। তার এ প্রস্তাবের আইনগত, পদ্ধতিগত ও অন্যান্য সব প্রাসঙ্গিক দিক বিবেচনা করা যেতে পারে।

সর্বশেষ খবর